×

মুক্তচিন্তা

কুরআন অবমাননাকারীরা ধৃত : আন্দোলনকারীরা এখন কী বলবে?

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৬ অক্টোবর ২০২১, ০৬:২৫ এএম

কুমিল্লায় দুর্গাপূজার অষ্টমী তিথিতে মুসলমানদের পবিত্র কুরআন রাতের অন্ধকারে নানুয়ার দীঘির একটি অস্থায়ী মণ্ডপে হনুমানের কোলে রেখে যে অবিশ্বাস্য কাণ্ড ঘটানো হয়েছিল, তার ফলে এবারের দেশব্যাপী দুর্গোৎসবই শুধু পণ্ড করা হয়নি, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মন্দির, বাড়িঘর, ব্যবসা-বাণিজ্য কেন্দ্র এবং জীবনের ওপর যে আক্রমণ সংঘটিত করা হয়েছিল তা ছিল একটি বিশেষ মহলের পূর্বপরিকল্পিতভাবে দেশকে নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দেয়া, ফায়দা লোটা এবং সাধারণ নিরীহ মানুষের স্বাভাবিক জীবনব্যবস্থা ধ্বংস করে দেয়ার অংশ। উদ্ধারকৃত সিসিটিভি ক্যামেরা থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কুরআন অবমাননার জন্য হিন্দু সম্প্রদায়কে দায়ী করে দেশে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের উত্তেজিত করার সঙ্গে জড়িত ছিল মুসলমান নামধারী কিছু তরুণ ও যুবক। যারা গোটা এই নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে থাকা মহলবিশেষের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছিল। তখনই ধারণা করা হয়েছিল মন্দিরে কুরআনের অবমাননার পেছনে দুর্গোৎসবে ব্যস্ত থাকা হিন্দু সম্প্রদায়ের কোনো ব্যক্তি জড়িত থাকার তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই। বরং রাতের আঁধারে অসৎ উদ্দেশ্যে পবিত্র কুরআনকে ব্যবহার করে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের ধর্মীয় অনুভূতি ব্যবহারের মাধ্যমে দেশকে বড় ধরনের বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেয়ার লক্ষ্যেই কোনো একটি গোষ্ঠী এই অপকর্মটি সংঘটিত করে থাকতে পারে। কুমিল্লায় যে তরুণটি সর্বপ্রথম লাইভে এসে হিন্দুদের মন্দিরে কুরআন অবমাননার দৃশ্য সম্প্রচার করে মুসলমানদের ঘর থেকে বের হয়ে আসার ডাক দিয়েছিল তার আচার-আচরণ ও কণ্ঠেই ছিল অসৎ মনোবৃত্তি। পোস্টটি দিয়ে নিজেই সটকে পড়েছিল। এরপর প্রস্তুত থাকা বেশ কিছু তরুণ মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর ও আক্রমণ শুরু করে। মুহূর্তের মধ্যে বিষয়টি ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়া হয়। একদল উচ্ছৃঙ্খল তরুণ চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে তৌহিদি জনতার নাম ব্যবহার করে মন্দিরে প্রার্থনাকারীদের ওপর হামলা চালায়। কর্তব্যরত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু উচ্ছৃঙ্খল যুবকরা পুলিশের ওপর আক্রমণ শুরু করলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়ম অনুযায়ী রাবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাস ও লাঠিচার্জ করতে বাধ্য হয়। পরবর্তী সময়ে গুলি চালাতেও বাধ্য হয়েছিল। চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ থেকে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে যে এখানেও পরিকল্পিতভাবে উঠতি কিশোর ও তরুণদের এই আক্রমণ সংঘটিত করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছিল। এরপর নোয়াখালীর চৌমুহনী, বেগমগঞ্জ, ফেনীসহ দেশের ২০টি জেলায় কয়েকশ মন্দিরে আক্রমণ এবং পীরগঞ্জে সাধারণ হিন্দুদের বাড়ি-ঘরে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ইত্যাদি সংঘটিত করা হয়। ঘটনা সবই এখন আমাদের জানা। দেশে এই নিয়ে ব্যাপকভাবে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ মিছিল হচ্ছে। আওয়ামী লীগ, কিছু বাম রাজনৈতিক দল, সামাজিক, সাংস্কৃতি সংগঠন, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদসহ কিছু সংগঠনের ব্যানারে দেশের সর্বত্র প্রতিবাদ, সমাবেশ এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করা হচ্ছে। একইসঙ্গে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার জন্য মুক্তিযুদ্ধের সব শক্তির প্রতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার আহ্বান জানানো হচ্ছে। সরকারের দিক থেকেও কিছু উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। কিন্তু শুরুতে বিএনপির পক্ষ থেকে কুমিল্লা ও অন্যান্য অঞ্চলে সংঘটিত ঘটনার জন্য সরকারকে দায়ী করে বলা হয়েছিল যে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি থেকে মানুষের দৃষ্টি অন্যত্র সরানোর জন্য সরকারই পরিকল্পিতভাবে এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত বিএনপিকে এসব ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় গিয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পাশে দাঁড়ানো, তাদের সহযোগিতা করা কিংবা এসব অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারীদের বিরুদ্ধে অবস্থান, সমাবেশ করতে দেখা যায়নি। ঢাকাতেও তাদের তেমন কোনো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের এ ঘটনার প্রতিবাদ করে কোনো সমাবেশ অথবা দোষীদের বিরুদ্ধে বিএনপি কোনো রাজনৈতিক অবস্থান পরিষ্কার করে বক্তব্য দেয়নি। বিএনপির নেতৃবৃন্দ এখনো যেসব সমাবেশে বক্তব্য দিচ্ছেন সেগুলোতে সরকারের পদত্যাগ, অবিলম্বে নির্বাচন এবং অল্প করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আলোচনা করলেও সাম্প্রতিক ঘটনার জন্য সরকারকে দায়ী করে বক্তব্য দিচ্ছেন। এরই মধ্যে কুমিল্লায় যেসব সিসিটিভি উদ্ধার করা হয়েছে তাতে স্পষ্ট হচ্ছে যে কয়েকজন পবিত্র কুরআনের কপিটি মন্দিরে রাখার জন্য নিয়োজিত ছিল। তাদের সিসিটিভি ফুটেজ অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ ঘটনা সংঘটিত করার কাজে যুক্ত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করেছে। শুরু থেকেই ফেসবুকে একটি গোষ্ঠী ইকবালকে মানসিকভাবে অসুস্থ, মাদকাসক্ত বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিল। সিসিটিভি ফুটেজ নিয়েও নানা রকম উদ্ভট মন্তব্য ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। পুরো ঘটনাটিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য ফেসবুক এবং তথাকথিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নানা গ্রুপে বিভক্ত হয়ে অনবরত বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার করে থাকে। এখন চেষ্টা করা হচ্ছে ধৃতদের নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য। প্রকৃত আসামিদের না ধরে সরকার ইচ্ছেমতো আসামি সাজিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে বলেও প্রচার-প্রচারণা চালানো হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে কুরআন অবমাননাকারী ব্যক্তিরা প্রাথমিকভাবে স্বীকারোক্তি দেয়ার পরও যারা তথাকথিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে তারা কারা? এখন কি তাদের কাছে কুরআন অবমাননার বিষয়টি গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। নাকি এটি কি তাদের দৃষ্টিতে কোনো অবমাননাই নয়? এছাড়া যেসব উঠতি তরুণ ১৩ তারিখ পরবর্তী সময়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র মন্দির ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, কয়েকজনকে হত্যা, আহত করা, বাড়িঘর, দোকানপাট ইত্যাদিতে হামলা করেছিল, তারা এখন কোথায়? তারাও কি তথাকথিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপপ্রচারকারীদের মতোই তাদের মত পাল্টে ফেলেছে? মুসলমানদের পবিত্র গ্রন্থের প্রতি মুসলমানদের যেমন আবেগ ও সম্মান প্রদর্শনের বিষয় রয়েছে, অন্য ধর্মাবলম্বীরাও যে কোনো ধর্মগ্রন্থের প্রতি সম্মান জানানোর কথা সবাই স্বীকার করে আসছে। অতীতে কখনোই এক ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠী অন্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্মগ্রন্থ অবমাননা করার মতো চিন্তা করেছে বলে মনে পড়ে না। সাধারণ ধর্মবিশ্বাসীরা ধর্মগ্রন্থকে সবসময় পবিত্র দৃষ্টিতে দেখে। ভক্তি-শ্রদ্ধাও করে থাকে। কিন্তু যারা অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে সমাজে বসবাস করে, হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মকে ব্যবহার করে তারা ধর্মগ্রন্থকেই শুধু অবমাননা করে না। নিজেদের স্বার্থে যে কোনো অপকর্মে ধর্মগ্রন্থ, ধর্ম বিশ্বাসী মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা, গির্জা ইত্যাদিকেও ধ্বংস করতে দ্বিধা করে না। ইতিহাসে তেমন নজির বহু আছে। এবারো সেটি ঘটেছে। সে কারণেই দেখা যাচ্ছে যে ১৩ তারিখ মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ কুরআন শরিফের কপি অস্থায়ী পূজামণ্ডপে হনুমানের হাতে বসিয়ে দৃশ্য ধারণপূর্বক লাইভ প্রচার করে মুসলমানদের জেগে ওঠার ডাক জানিয়েছিল যে বা যারা তাদের পক্ষে এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় যেমন একটি বিরাট গোষ্ঠী অবস্থান নিয়েছে, একইভাবে রাজনীতি ও সমাজে অনেকেই নীরবতা প্রদর্শন করছে। ক’দিন আগের কুরআন অবমাননার ঘটনাটি যেন এখন আর নেই। প্রশ্ন জাগে- ধৃত ব্যক্তিরা যদি অপরাধী না হয়ে থাকে তাহলে প্রকৃত অপরাধীদের ধরার দাবি কেন করা হচ্ছে না? সেই আলোচনা কেন থেমে গেল? তাহলে বুঝতে বাকি থাকে না কুরআন অবমাননা দেখিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের সঙ্গে মুসলমানদের রক্তারক্তি একটি সংঘাত তৈরির জন্য এ ঘটনা সংঘটিত করা হয়েছিল। হিন্দুদের ওপর দায় চাপিয়ে যে ঘটনা ঘটানোর চেষ্টা করা হয়েছিল তা ধর্মের দিক থেকেই শুধু নয় রাজনীতি, মানবতা এবং বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতার দিক থেকেও একটি চরম গর্হিত অপকর্ম হিসেবে বিবেচনাযোগ্য। এ ঘটনা উপমহাদেশব্যাপী ছড়িয়ে যাওয়ারও সম্ভাবনা সৃষ্টি হতে পারত। পবিত্র ধর্ম নিয়ে এমন অপবিত্র কাজ যারা করে তাদের সম্পর্কে জনমত সৃষ্টি করা এখন সময়ের দাবি। কুমিল্লায় পবিত্র কুরআনকে নিয়ে এমন ন্যকারজনক ঘটনা যারা ঘটিয়েছে তারা জনগণের দৃষ্টিকে অন্য খাতে প্রবাহিত করতে উঠেপড়ে লেগেছে। এরাই ২০১৩ সালের ৫ মে তারিখে শাপলা চত্বরে সমাবেশ সংঘটিত করার আগে বায়তুল মোকাররম এলাকায় যে ধর্মগ্রন্থ বিক্রয়কেন্দ্র ছিল সেগুলোতে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল। তাতে অসংখ্য পবিত্র কুরআনের কপি পুড়ে গিয়েছিল। সেই দৃশ্য লাইভ টেলিকাস্টে দেশব্যাপী দেখেছিল। কারা কীভাবে তখন আগুন জ্বালিয়েছিল সেটিও দেখা গিয়েছিল। দুর্ভাগ্যজনক সত্য হচ্ছে বায়তুল মোকাররমে ওইদিন অসংখ্য কুরআন শরিফের কপি ও বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ আগুনে পুড়ে যাওয়ার বিষয়টি জামায়াত, বিএনপি, হেফাজতসহ সমাবেশে অংশ নেয়া কোনো দলের পক্ষ থেকেই ব্যক্ত করা হয়নি। কুরআনের এমন একটি কপি অন্য কারো হাতে যদি পোড়া যেত তাহলে বাংলাদেশে কী পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো, আগুন কোথায় না লাগত সেটি ভাবতেই শরীর শিউরে ওঠার কথা। অথচ ২০১৩ সালে কোনো প্রতিক্রিয়ায় শোনা যায়নি। অনেক দোকানি সর্বস্ব হারিয়েছিলেন তাদেরও কেউ সহযোগিতা করেনি। গত ১৩ তারিখ কুমিল্লায় নিজের পবিত্র ধর্মগ্রন্থকে অপমান করার দায় অন্য ধর্মাবলম্বীদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার জন্য যেই অদৃশ্য নাটকটি মঞ্চস্থ করার চেষ্টা করা হয়েছিল সেটিও এখন আলোচনার পথ হারিয়েছে। কোথাও সেই আলোচনাটি গুরুত্ব পাচ্ছে বলে মনে হয় না। যেসব মসজিদ থেকে প্রায়ই ধর্ম অবমাননার বিষয় নিয়ে কথা বলতে শোনা যায়, শুক্রবারগুলোতে নানা ধরনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয় তারাও এখন দেখি নীরব। চৌমুহনীতে গত শুক্রবারে হিন্দুদের ভাঙা মন্দিরে ঢিল ছোড়া হয়েছিল পবিত্র মসজিদের জায়গা থেকে। অথচ আত্মসমালোচনা করা যেখানে জরুরি ছিল সেখানে নীরবতা পালন করতে অনেককেই দেখা যাচ্ছে। পবিত্র কুরআনের প্রতি আমাদের মুসলমানরা কতটা সম্মান দেখাচ্ছেন ও জানাচ্ছেন সেটি বোধহয় এ দুটি ঘটনার অভিজ্ঞতা থেকে তুলে ধরা উচিত। পবিত্র কুরআনকে এভাবে রাজনীতির বলিখেলায় যারা অপব্যবহার করে তাদের বিরুদ্ধেই এখন প্রতিটি মুসলমান এবং ধর্মাবলম্বীর সমালোচনা জারি থাকা উচিত। সমাজে ধর্ম নিয়ে এমন অপরাজনীতির এখানেই ইতি ঘটাতে হবে। মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App