×

মুক্তচিন্তা

প্রফুল্লকুমার গুহের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৩ অক্টোবর ২০২১, ০১:১৯ এএম

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিনের শিক্ষক এবং প্রথম দিন থেকে হাতেগোনা যে ক’জন শিক্ষক সত্যিকার অর্থে নিবেদিত হয়ে জ্ঞান বিতরণ করে আসছিলেন তাদের অন্যতম ইংরেজি বিভাগের প্রফুল্লকুমার গুহ। প্রথম দিনের অনেক শিক্ষকের সঙ্গে তার অবস্থানের একটি স্পষ্ট স্বাতন্ত্র্য রয়েছে। তাদের অনেককে প্রথম ভিসি হার্টগ সাহেব নিজেই চিঠি লিখে কিংবা মৌখিকভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। গুরুত্বপূর্ণ অনেকেই এসেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কলকাতার অন্য কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে। ঢাকা ও জগন্নাথ কলেজের শিক্ষকদের ক’জন যোগ দিয়েছেন। প্রফুল্লকুমার গুহকে কেউ চাকরি অফার করেননি, তিনি কলকাতা থেকেও আসেননি। তিনি ময়মনসিংহ কলেজে শিক্ষকতা করতেন, তিনি নিজেই নবসৃষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির লেকচারার হওয়ার জন্য আবেদন করেন। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হওয়ার আগে বিভাগীয় প্রধানদের সভায় ফিলিপ হার্টগ বলেন, ‘মৈমনসিংহ কলেজের একজন নামকরা শিক্ষককে ইংরেজি বিভাগের লেকচারার নিযুক্ত করা হবে। কারণ তার যোগ্যতা সম্বন্ধে তিনি একজন বিশিষ্ট লোকের কাছে সংবাদ পেয়েছিলেন।’ এই তথ্যটি জানাচ্ছেন প্রথম দিনের একজন খ্যাতিমান শিক্ষক এবং পরবর্তীকালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর রমেশচন্দ্র মজুমদার। দুজনের প্রথম দেখা ১ জুলাই ১৯২১ বিশ্ববিদ্যালয়ের শুভযাত্রার দিন। রমেশচন্দ্র তার পাণ্ডিত্য, সারল্য ছাত্রদের সঙ্গে নৈকট্য ও সহৃদয়তার প্রশংসা করেছেন। ১৯৭৪-এ ভারতবাসী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা পুনর্মিলনের আয়োজন করেছিলেন। সেই মিলনের প্রস্তুতি সমিতির সদস্য ছিলেন রমেশচন্দ্র মজুমদার, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, প্রফুল্লকুমার গুহ, অমলেন্দু বসু, ননীকুমার চক্রবর্তী, সমর গুহ, দিলীপ কুমার সেনগুপ্ত, সারমা দত্ত মজুমদার, চামেলী বসু, শোভা রায়, বাণী ঘোষ, বীরেন্দ্রকুমার নাহা ও আশুতোষ ভট্টাচার্য। সাবেক শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের স্মৃতিকথার সংকলন ‘আমাদের সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ নামটিও দিয়েছেন প্রফুল্লকুমার গুহ। কিন্তু এই প্রকাশনাটি ছাপাখানা থেকে বেরোবার আগেই অল্প সময়ের ব্যবধানে বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু এবং প্রিয় শিক্ষক প্রফুল্লকুমার গুহের প্রয়াণ ঘটে। মৃত্যুর অল্পকাল আগে তার লেখা ‘আমাদের সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ থেকে তার কিছু স্মৃতিচিত্র ও বিবরণ তুলে ধরা হলো। প্রফুল্লকুমার গুহ লিখেছেন, ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত নতুন বিশ্ববিদ্যালয়টি পনেরো-ষোল বছরের মধ্যেই ‘ভারতবর্ষের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের মধ্যে একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠান রূপে খ্যাতি অর্জন করে’। কিন্তু অনেক প্রতিকূলকতার মুখোমুখি হতে হয়েছে এই প্রতিষ্ঠানটিকে। ‘ঢাকা শহরেরই বিদগ্ধ’ সমাজ এই নতুন বিশ্ববিদ্যালয়টিকে ঢাকার উচ্চ শিক্ষার অন্তরায় বলে মনে করলেন। ঢাকা নগরে রব উঠল : ‘They have killed a good college (Dhaka College) to make a bad University.’ প্রফুল্ল গুহ মনে করেন ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এই বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টির পেছনে কাজ করলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিকাশ ঘটল অরাজনৈতিক অসাম্প্রদায়িক পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে। প্রফুল্ল গুহ লিখলেন : কিন্তু ঢাকা শহরবাসীর শঙ্কা ও সন্দেহ এবং সরকারের দূরভিসন্ধি উভয়ই চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও প্রশাসকমণ্ডলীর জাদুস্পর্শে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সৌভাগ্য যে এর প্রাথমিক কর্ণধারগণের প্রত্যেকেরই এমন একটি উদারচিত্ত ও সাম্প্রদায়িক সঙ্কীর্ণতা হতে সম্পূর্ণ বিমুক্ত প্রকৃত শিক্ষকের বিশুদ্ধ একাডেমিক স্পিরিট ছিল যে তাদের পরিচালনায় প্রথম হতেই নতুন বিশ্ববিদ্যালয়টি একটি পবিত্র বিদ্যামন্দিরে পরিণত হলো। তাদের চোখে হিন্দু ও মুসলমান ছাত্রদিগের মধ্যে কোনো প্রভেদ ছিল না। তারা সব ছাত্রকেই সমান দরদ ও ভালোবাসা দিয়ে নিরপেক্ষভাবে শিক্ষাদান করেন এবং তাদের এই মহৎ সংকল্পে হিন্দু-মুসলমান ছাত্রদের মধ্যেও গড়ে উঠল এক প্রীতি ও বন্ধুত্বের বন্ধন। এ এফ রহমান, রমেশচন্দ্র মজুমদার, জ্ঞান ঘোষ, শহীদউল্লাহ, নরেশ সেনগুপ্ত শুধু তাদের ঔদার্য ও ব্যক্তিত্বের প্রভাবে এই অসম্ভবকে সম্ভব করলেন। প্রফুল্ল গুহ মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণির সৃষ্টি ও বিকাশের ওপর গুরুত্ব দিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম যুগের হিন্দু শিক্ষক ও প্রশাসকগণের সহায়তায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আলোকপ্রাপ্ত মুসলমান শিক্ষার্থীরাই মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণি সৃষ্টি করেছে। তাদের উত্তরসূরিরাই ‘শেখ মুজিবুর রহমানের পার্শ্বচর হয়ে স্বাধীন বাংলা স্থাপন করলেন।’ তিনি মনে করেন মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণি সৃষ্টি করাটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ‘গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক কীর্তি’। প্রফুল্ল গুহ মনে করেন, কবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌভাগ্য ফিলিফ হার্টগকে সৃষ্টিলগ্নে ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে লাভ করা। তিনি প্রকৃত অর্থেই ফাউজিং ভাইস চ্যান্সেলর- প্রথম ভাইস চ্যান্সেলরকে শক্ত ভিত্তির ওপর তার প্রতিষ্ঠানকে দাঁড় করাতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্ববিদ্যার আধারে পরিণত করতে শ্রেষ্ঠ মেধার সমন্বয় ঘটাতে হবে- আর এ কাজে তিনি ছিলেন প্রকৃত জহুরী। প্রফুল্ল গুহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের অন্তর্ভুক্তিতে হার্টগ সাহেবের ভূমিকার একটি আভাস দিয়েছেন : ‘বর্তমান লেখকের ময়মনসিংহ কলেজে শিক্ষক-ভাবে যে সামান্য একটু খ্যাতি ছিল তাও তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং আমারও সৌভাগ্য হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাথমিক শিক্ষকমণ্ডলীর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হওয়া।’ তিনি রেজিস্ট্রারের কাছ থেকে মামুলি নিয়োগপত্র পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিতে আসেননি। তিনি পেয়েছিলেন ভাইস চ্যান্সেলরের ব্যক্তিগত চিঠি, যাতে তার দস্তখতের ঠিক ওপরে লেখা ছিল ‘লুকিং ফরোয়ার্ড টু ইয়োর হার্টি কোঅপারেশন’। ১৯২০ এবং ১৯৩০ দশকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের যত স্মৃতিকথন আমার চোখে পড়েছে তাদের প্রায় সকলের প্রশংসার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন প্রফুল্লকুমার গুহ। ১৯৩০ দশকের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী কল্যাণী কর লিখেছেন, ‘আমাদের অধ্যাপকদের মধ্যে প্রথমেই মনে পড়ে শ্রদ্ধেয় প্রফুল্লকুমার গুহর কথা; তিনি আমাদের ইংরেজি অনার্স ক্লাসে যখন হ্যামলেট পড়াতেন তখন মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। কী গম্ভীর কণ্ঠস্বর, কী অর্থপূর্ণ অভিব্যক্তি। তার বর্ণনায় তার বাচনভঙ্গিতে যেন নাটকের পরিবেশ সৃষ্টি করে তুলতেন। অনেক সময় তিনি রেকর্ড নিয়ে এসে ক্লাসে বাজিয়ে শোনাতেন, হয়তো হ্যামলেটের ঝড়ষরষড়য়ুঁ, হয়তো বা অন্য কিছু। তাতে মনে ওপর গভীর রেখাপাত করত।’ বহু শিক্ষার্থীর উপস্থিতিতে বিএ পাস ক্লাসে যখন পড়াতেন সবাই অভিভূত হয়ে শুনতেন। শান্তি দত্ত লিখলেন, অধ্যাপক পি কে গুহ ম্যাকবেথ থেকে আবৃত্তি করে বলেছেন- টুমরো এন্ড টুমরো এন্ড টুমরো- গ্যালারি ভর্তি ছাত্রদের দল আমরা দুপাশে, সে স্মৃতি অটুট আছে। পি কে গুহর ক্লাস করার তিন দশক পরও শোভা রায় তার কণ্ঠের অনুরণন শোনেন। ইংরেজির অধ্যাপক পি কে গুহর অধ্যাপনা তার কাছে চিরস্মরণীয়। ‘তার ম্যাকবেথ পড়ানো আমাদের অপূর্ব আনন্দ দিয়েছিল। তার মর্মস্পর্শী আবেগময় আবৃত্তির গুণে আমরা যেন সমগ্র ম্যাকবেথ নাটকের ঘটনাবলি প্রত্যক্ষ করেছিলাম।’ লেডি ম্যাকবেথে রক্তাক্ত করতল এবং রক্তের ঘ্রাণ হরণে আরবের সকল সুগন্ধির ব্যর্থতা নিয়ে প্রদীপ হাতে এই নারীর পদচারণা পড়ানোর গুণেই তাদের সামনে সত্য হয়ে মূর্ত- শিক্ষকের এ সাফল্য শিক্ষার্থী মনে অমোচনীয় ছাপ রেখে যায়। তিরিশের দশকের ইংরেজির ছাত্রী চামেলী বসুর সশ্রদ্ধ মন্তব্য : শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক পি কে গুহ সমস্ত প্রাণ ঢেলে, কবির সমস্ত অনুভূতিকে নিজের অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করে পড়াতেন শেক্সপিয়ার। শেক্সপিয়ারের কুশীলবদের উচ্ছ¡াস, নিবিড় ব্যথা, চরম হতাশা আমাদের মনকে গভীরভাবে নাড়া দিয়ে যেত। আজো বিবেকহীন কৃতজ্ঞতাবিহীন পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝে মনে ভাসে অধ্যাপক গুহর উদাত্ত কণ্ঠস্বর King Lear -এর আর্তনাদ : Blow, Winds and crack your checks! raqe! blow! You cataracts and hurricanes spout Till you have drench’d our stecples drowned the cocks! ১৯৪০ দশকের প্রথমার্ধের ছাত্রী করুণা চক্রবর্তী লিখেছেন : … তার বক্তৃতা শুনতে গিয়ে আমাদের মন কখনো বৃদ্ধ কিং লিয়ারের মতো ঝটিকা-বিক্ষুব্ধ প্রান্তরে ঘুরে বেড়াত, কখনো ইহুদি সাইলকের বিচার সভায় উপস্থিত হয়ে… দ্বৈতসত্তার দৃষ্টিভঙ্গিতে সাইলককে একই সঙ্গে সুদখোর মহাজন ও নিপীড়িত ইহুদি সমাজের প্রতিভূ রূপে বিচার করতে শিখত। প্রফুল্লকুমার গুহ সূচনাকালে ইংরেজির বিভাগীয় প্রধান সি এল রেন সম্পর্কে বলছেন তার মতো ইংরেজি সাহিত্য ও ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী তার কেউ ভারতবর্ষে তখন ছিলেন না। হার্টগ সাহেব পদার্থবিজ্ঞানের জন্য বেছে নিলেন ডক্টর কে এস কৃষ্ণানকে; অর্থনীতিতে ড. পানাডিকার এবং ড. যোগীন্দ্র সিংহ, ইতিহাসে কালিকাররঞ্জন কানুনগো ও সুশোভন সরকার। চারু বন্দ্যোপাধ্যায়, মোহিতলাল মজুমদার, ড. হীরেন্দ্রলাল দে, ভুপতিমোহন সেন, দেবেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, এ এফ রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্ব বাড়িয়ে দিলেন। তখন একঝাঁক মেধাবী তরুণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে স্বনামধন্য হয়ে উঠলেন : মন্মথ রায়, বুদ্ধদেব বসু, আশুতোষ ভট্টাচার্য, অমলেন্দু বসু, ক্ষিতীশ চৌধুরী, অমিয় দাশগুপ্ত, পরিমল রায়, ননী চক্রবর্তী, অবনী কুমারী, সুরেশচন্দ্র দাশ, লীলা রায়, করুণাকনা গুপ্তা, চারুপমা বসু প্রমুখ। প্রফুল্ল গুহ প্রফেসর রেনের তত্ত্ব যে পর্দা ও সহশিক্ষা একসঙ্গে চলতে পারে না তা অন্তত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রমাণিত হয়নি বলে মনে করেন- ছাত্রীদের শোভন আচরণ, ছাত্রদের ছাত্রীদের প্রতি যথাযথ সম্ভম ও শ্রদ্ধা দ্বারা রেন সাহেবের এই উক্তি অমূলক প্রমাণিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে তখন প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলা কতটা সমীচীন হয়েছে এ নিয়ে বিতর্ক বরাবরই ছিল, বিশেষ করে অক্সফোর্ডফেরত কেউ মানতে চাইলেন না, আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কিছুদিনের জন্য অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে সেখানে থেকে ও বক্তৃতা শুনে হতাশাই প্রকাশ করেছেন রমেশচন্দ্র মজুমদার। প্রফুল্ল গুহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রসঙ্গে বলেছেন, এটা কখনো অপরিচিতদের সমষ্টি ছিল না। ‘এটা যেন শিক্ষক ও ছাত্রদের একটি যৌথ পরিবার।’ তিনি লিখেছেন : ‘ক্লাস ঘরের বাইরে একটি এক্সট্রা একাডেমিক জমাট কর্মসূচি ছিল যে প্রতি সন্ধ্যায় কোনো না কোনো অনুষ্ঠান শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে মিলন ঘটাত। এতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি আদর্শ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছিল। একে ‘অক্সফোর্ড অব দ্য ইস্ট’ যে আখ্যাটি দেয়া হয়েছিল তাতে বিশেষ কোনো অত্যুক্তি ছিল না। তার সময় বিভিন্ন হলে উচ্চাঙ্গের নাট্যাভিনয় হতো। সংস্কৃতের অধ্যাপক ড. প্রবোধচন্দ্র লাহিড়ী এবং বাংলার চারু বন্দ্যোপাধ্যায় সোৎসাহের ছাত্রদের সঙ্গে অভিনয়ে নামতেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল কলেজের প্রশংসা করেন। ডক্টর নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত অভিমান করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে গেলে তার জায়গায় আসেন নগেন্দ্রনাথ ঘোষ, তারপর ডক্টর জে এন দাশগুপ্ত। সে সময় হলে হলে বার্ষিক রিইউনিয়ন ডিনার হতো, পুরনো ছাত্ররা স্মৃতিচারণ করতেন। এই উৎসবে সাগ্রহে উপস্থিত থাকতেন সত্যেন্দ্রনাথ ভদ্র, পদ্মিনীভূষণ রুদ্র, এ কে চন্দ; যোগ দিতেন, ইংরেজির অধ্যাপক জগন্নাথ কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ললিতমোহন চ্যাটার্জি এমন পুনর্মিলনীতে সাহিত্য নিয়ে উচ্চাঙ্গের ভাষণ দিয়েছিলেন। কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ডি-লিট দেয়ার অভিজ্ঞতা স্মরণ করেন। বিশেষ করে শরৎচন্দ্রে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি না থাকায় তাকে প্রাপ্য এ সম্মান দিয়ে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় যখন এগিয়ে আসেনি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানিত করে আর সবার ব্যর্থতা দেখিয়ে দিল। রমেশচন্দ্র মজুমদারের ভাইস চ্যান্সেলরশিপের শেষদিকটাতে তার সঙ্গে সান্ধ্য ভ্রমণে বেরোতেন প্রফল্ল গুহ, মোহিতলাল মজুমদার এবং আরো ক’জন। মোহিতলাল নিজেদের নিয়ে ষোল পঙ্ক্তির একটি কবিতা লিখেছেন, তার শেষে চার পঙ্ক্তি : এইচ এল দে, কে ডি, গুহ, আর মিত্র, গাঙ্গুলী, কবি, সর্বশেষের নামটাই সার- বিপরীত তার সবই!! এক সাথে হাতে দিয়েছিনু মোরা একটু মোহের একটি স্নেহের রঙিন রাখীর ডোরা। প্রফুল্লকুমার গুহ কেমন করে স্বনামধন্য হয়ে উঠলেন তা বলতে গিয়ে ডক্টর জে সি ঘোষের নাম নিয়েছেন যার গুরুত্বপূর্ণ কথাটি হচ্ছে : আমি রমনাতে আমার শিক্ষা সমাপ্ত করেছি আর সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, আমি যা, আমার ছাত্ররাই আমাকে তা তৈরি করেছে। তিনিও তাদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে অকুণ্ঠচিত্তে বলেছেন : ওঃ রং ঃযব ংঃঁফবহঃং ড়ভ উযধশধ টহরাবৎৎংরঃু যিড় যধাব সধফব সব যিধঃ ও ধস. রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছেন : ‘প্রফুল্লবাবুর পাণ্ডিত্য ও শিক্ষকতায় নৈপুণ্যের খ্যাতি কলিকাতায় পৌঁছিয়াছিল। সুতরাং ঢাকা হইতে অবসর গ্রহণ করিয়া তিনি সুরেন্দ্রনাথ কলেজের অধ্যক্ষ হইয়াছিলেন। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ও সিন্ডিকেটের সদস্যও ছিলেন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়েও তিনি অধ্যাপনা করিয়াছেন। তিনি অর্ধ শতাব্দীরও অধিককাল অধ্যাপনায় ব্যস্ত রয়েছেন এবং শিক্ষার্থীদের সাহিত্যরসে উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত করেছেন। তার মৃত্যুর পর শোক প্রস্তাবে এটাও উল্লেখ করা হয় যে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহিত যুক্ত প্রতিটি মানুষের উপর তাহার টান ছিল অপরিসীম। সুদীর্ঘ দিন জ্ঞানের আলোতে তিনি অসংখ্য ছাত্রছাত্রীকে উদ্ভাসিত করিয়াছেন, তাহার রশ্মি বহুকাল বিচ্ছুরিত হইবে সন্দেহ নাই।’ ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে, নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App