×

জাতীয়

এই বাংলাদেশ তো আমরা চাইনি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২ অক্টোবর ২০২১, ০১:০৬ এএম

রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার রঘুনাথপুর ইউনিয়নের মাঝিপাড়া গ্রামের পরিতোষ চন্দ্র রায় নিজের স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে ধানের ক্ষেতে লুকিয়েছিলেন মাঝরাত পর্যন্ত। ভীত, সন্ত্রস্ত ও যে কোনো মুহূর্তে হামলার আশঙ্কায় আতঙ্কিত ছিলেন তিনি। দূর থেকে দেখছেন দাউ দাউ করে জ্বলছে তিলে তিলে গড়া তার সংসার।

ভাঙচুর আর অগ্নিসংযোগের পর যা কিছু ছিল তাও লুটপাট করে নিয়ে গেল তারা। কেন তার ওপরে হামলা, কী তার অপরাধ, কেন লুটপাটের শিকার তিনি- কিছুই জানলেন না। শুধু একটি ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে এ রকম একটি ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হলো তাদের। হামলাকারীরা ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পর পুলিশ ও প্রশাসনের লোকজন যখন মাইকে ডাকাডাকি করছে, তখন তিনি ধানক্ষেত থেকে বেরিয়ে আসেন।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের বহু মানুষকে এরকম দুঃসহ সময় কাটাতে হয়েছে- যখন রাজাকার, আল বদর আর পাকিস্তানি বাহিনী একের পর এক গ্রামে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল। কিন্তু এখন তো স্বাধীন বাংলাদেশ। এখন তো পাকিস্তানি বাহিনী নেই। কোনো পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীও নেই। তারপরও কেন পরিতোষ চন্দ্র রায়কে নিজের জীবন বাঁচাতে ধানক্ষেতে লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে? তার মানে হলো- পরিতোষ চন্দ্র রায়দের জীবনে কোনো পরিবর্তন আসেনি।

বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ৫০ বছর। এই ৫০ বছরে আমরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা বলছি। সামাজিক ও অর্থনৈতিক নানা উন্নয়নের কথা বলছি, আমরা একটি স্বাধীন ভূখণ্ড পেয়েছি, মানচিত্র পেয়েছি। কিন্তু পরিতোষ চন্দ্র রায়কে স্বাধীনভাবে বাঁচার নিরাপত্তা দিতে পারিনি। আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি তাদের রক্ষা করতে পারেনি।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আজীবন সংগ্রাম ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও শোষণহীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার। দেশের সব মানুষের দল করার জন্য আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে তিনি

সর্বজনের কাছে গ্রহণযোগ্য নাম বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ করেছিলেন। জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর দেশ আবার চলে গিয়েছিল পাকিস্তানি ভাবধারায়। তার দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আজ একটানা ১২ বছর ক্ষমতায়। দুর্ভাগ্য হলেও সত্য যে বঙ্গবন্ধুর আজীবনের লালিত আদর্শ থেকে মনে হয় দেশ অনেকখানি বিচ্যুত হয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নে কোনো রাষ্ট্রধর্ম ছিল না। এখন আমাদের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম আছে। সমাজে, রাষ্ট্রে সাম্প্রদায়িকতা বেড়েছে, উগ্রবাদ আরো প্রকট হয়েছে, শিক্ষা-সংস্কৃতির অধঃপতন ঘটেছে। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার বেড়েছে। সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে আপসকামিতাও বেড়েছে। ফলে এই আপসকামী মনোভাবের জন্য সাম্প্রদায়িক শক্তি আরো বেশি নিজেদের প্রভাব বাড়িয়েছে রাজনৈতিক শক্তির ওপরে। সাম্প্রদায়িকতার এই বিষধর সাপ প্রায়ই ছোবল মারে। এসব অপরাধের কোনো বিচার হয় না বলে বারবারই তারা আঘাত হানতে উদ্যত হয়। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার আগে ও পরে যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছিল তার বিচার এখনো পর্যন্ত হয়নি।

পরবর্তী সময়ে ২০১২ সালে রামুর ঘটনা কিংবা ২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা- কোনো ঘটনারই বিচার হয়নি। বিচারহীনতার এই সংস্কৃতি সাম্প্রদায়িকতাকে আরো উসকে দিয়েছে সমাজে। সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একে অপরকে দোষারোপ করেছে। ফলে প্রকৃত অপরাধীরা থেকে গেছে আড়ালে। বিচারের কাজ তাই বেশি দূর এগোয়নি। অন্যদিকে সমাজ ও রাষ্ট্রে সাম্প্রদায়িকতার শিকড় পৌঁছে গেছে অনেক গভীরে। আমরা মুখে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা বলি। বাস্তবে রাষ্ট্র পরিচালনায় ও জীবনচর্চায় প্রতিনিয়ত সাম্প্রদায়িক চিন্তাকে প্রাধান্য দিই। আমাদের স্বীকার করতে হবে, বিগত কয়েক দশকে দেশের সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর মনস্তত্ত্বে সাম্প্রদায়িকতা আরো প্রকট হয়েছে। উগ্রবাদের আরো প্রসার ঘটেছে। সংকীর্ণ মানসিকতার বিকাশ ঘটেছে। এবারের দুর্গাপূজার সময় সাম্প্রদায়িক সহিংসতার যে সমস্ত ঘটনা ঘটে গেল সারাদেশে, তাতে এ কথায় প্রমাণিত হয় যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির যে চিন্তাটা আমরা লালন করি তা আসলে কতখানি ঠুনকো। সামান্য একটি ঘটনা মুহূর্তেই বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গের মতোই ছড়িয়ে যেতে পারে।

সারাদেশে ধর্মের অবমাননার কথা বলে মুহূর্তের মধ্যেই দেশে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করা সম্ভব। পুলিশ সেখানে নির্বিকার থাকে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোনো ভূমিকা পালন করে না। একজন ভবঘুরে ইকবাল হোসেন যদি বাংলাদেশের কোনো একটি পূজামণ্ডপে একটি কুরআন শরিফ রেখে দিতে পারেন, একজন ফয়েজ আহমদ যদি স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তার সামনেই সেটা ফেসবুকে লাইভ করে ইসলাম অবমাননা বলে সবাইকে ইসলাম রক্ষার জন্য এগিয়ে আসার আহ্বান জানাতে পারে, মুহূর্তেই আগুনে পুড়ে যেতে পারে হাজার হাজার সংখ্যালঘুর ঘরবাড়ি। এমনই ঠুনকো আমাদের রাষ্ট্র, এমনই ঠুনকো আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। রাষ্ট্র, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সেখানে নির্বিকার। একজন কুরআন রাখবেন কুমিল্লায়, ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এনে সেখান থেকে ফেসবুকে লাইভ করবেন আরেকজন। অন্যদিকে তৌহিদি জনতার আগুনে বান্দরবানের লামায় হিন্দু দোকানগুলো পুড়ে যাবে, ফেনীতে হিন্দু মন্দির ভাঙবে, হাজীগঞ্জে, বাঁশখালীতে, চকরিয়ায়, গাজীপুরে মন্দির পোড়ানো হবে, নোয়াখালীর চৌমুহনীতে ইসকনের মন্দিরে প্রাণ দেবে পুজারিরা। অন্যদিকে রংপুরের রঘুনাথপুরের পরিতোষ চন্দ্র রায় তার বাড়িঘর হারিয়ে ফেলে নিঃস্ব হয়ে যাবে। এই হচ্ছে আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির চেহারা।

সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, কোনো একটি দেশে যদি একটানা তিন দিনের বেশি সাম্প্রদায়িক সহিংসতা চলে, তাহলে বুঝতে হবে সেই দেশে এই সহিংসতার পেছনে রাষ্ট্রের কোনো না কোনো পক্ষের মদত আছে। এবারের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিশ্লেষণে সেই সত্যটাই উঠে আসে। কুমিল্লার নানুয়ার দীঘিরপাড়ের পূজামণ্ডপে যখন কুরআন শরিফ পাওয়া গেল- তখন স্থানীয় ওসির উপস্থিতিতেই ফেসবুকে লাইভ করে ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগ এনে এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি করা কী করে সম্ভব হলো? এই ধরনের পরিস্থিতি সেখানেই সীমাবদ্ধ রাখা সম্ভব ছিল। এবার পূজামণ্ডপে কেন স্থায়ী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দেয়া হলো না?

কুমিল্লার ঘটনার পর কেন দেশের স্পর্শকাতর এলাকাগুলোতে দ্রুত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন করা হলো না? প্রতিমা বিসর্জন ও শুক্রবারের জুমার নামাজ একই দিনে হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পূর্ব প্রস্তুতি ছিল না। সর্বোপরি এসব অপশক্তির বিরুদ্ধে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলার জন্য সরকারি দল আওয়ামী লীগ মাঠে নামতে সময় নিয়েছে পাঁচ দিন। কেন এই দীর্ঘসূত্রতা? এর কোনো সদুত্তর নেই।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এখন বলছেন, সব অপরাধীকে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন কঠোর হস্তে দমনের। সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপি-জামায়াতের ইন্ধনে এসব কাজ হচ্ছে। এর মধ্যে কোনটা ঠিক আর কোনটা বেঠিক- এই চিন্তায় সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত-দিশাহারা। সত্য এই যে, রামুতে বৌদ্ধ মন্দির পুড়েছে, নাসিরনগরে হিন্দু মন্দির পুড়েছে, সুনামগঞ্জের শাল্লার ঝুমন দাসকে নিরাপত্তা দেয়া না যাওয়ায় জেলেই থাকতে হয়েছে।

এবার বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় দুর্গাপূজা আক্রান্ত হয়েছে, হিন্দুদের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান লুটপাট হয়েছে। তা নিয়ে সৃষ্ট নগরকেন্দ্রিক প্রতিবাদ-মিছিল, মানববন্ধন একদিন থেমে যাবে। একদিন আবার সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কিন্তু হৃদয়ের রক্তক্ষরণ কোনোদিনই থামবে না। এক নিরাপত্তাহীনতা ও অসহায়ত্ব কুরে কুরে খাবে ধর্মীয় সংখ্যালঘুর হৃদয়কে। এই রক্তক্ষরণ কখনোই থামবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠী তা বন্ধের উদ্যোগ না নেয়। আমরা যদি রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার বন্ধ না করি, আমরা যদি অপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় না করাই, তাহলে এই অপরাধ চলতেই থাকবে আগামীতে অন্য কোনো সময়, অন্য কোনো জায়গায়। আর এই দুঃখটা বেশি হবে তখন, যখন বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এবং নিরাপত্তাহীনতায় থাকতে হচ্ছে ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে। কারণ তাদের কাছে তো এ জনগোষ্ঠীর প্রত্যাশাটা সবচেয়ে বেশি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App