×

মুক্তচিন্তা

শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিশ্বনবীর ন্যায়বিচার

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২০ অক্টোবর ২০২১, ০৬:১২ এএম

শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিশ্বনবীর ন্যায়বিচার
রহমাতুল্লিল আলামিন, শান্তির অগ্রদূত, মানবতার মুক্তির দিশারি হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পবিত্র এ রবিউল আউয়াল মাসে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বিশ্বময় শান্তি আর ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। মহানবী (সা.) সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় এক বিরল আদর্শ স্থাপন করে গেছেন। নিরপেক্ষ ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে উঁচু-নিচু, ধনী-গরিব, আমির-ফকির, মুসলিম-অমুসলিম, আত্মীয় ও অনাত্মীয় এক কথায় ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার সঙ্গে তিনি ন্যায়বিচারের অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। পবিত্র কুরআনে ন্যায়বিচারের বিষয়ে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘হে যারা ইমান এনেছ! আল্লাহর উদ্দেশ্যে তোমরা ন্যায়ের পক্ষে সাক্ষী হিসেবে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হও আর কোনো জাতির শত্রæতা যেন কখনোই তোমাদের অবিচার করতে প্ররোচিত না করে। তোমরা সদা ন্যায়বিচার করো। এ কাজটি তাকওয়ার সবচেয়ে নিকটে। আর তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করো। তোমরা যা কিছু কর, নিশ্চয় আল্লাহ সে বিষয়ে পুরোপুরি অবগত আছেন’ (সুরা মায়েদা : ৮)। মহানবী (সা.) পবিত্র কুরআনের শিক্ষার ওপর পরিপূর্ণ আমল করে তা নিজ জীবনে বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছেন। একবার কুরাইশ বংশীয় মাখজুম গোত্রের এক সম্ভ্রান্ত মহিলা চুরির অপরাধে ধরা পড়লে রাসুলুল্লাহ (সা.) তার হাত কর্তনের নির্দেশ দেন। আভিজাত্য ও বংশমর্যাদার উল্লেখ করে সে মহিলার শাস্তি লাঘবের জন্য রাসুলুল্লাহর (সা.) কাছে তার একান্ত স্নেহভাজন উসামা ইবনে জায়েদ (রা.) সুপারিশ করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে বলেন, ‘তুমি কি আল্লাহর দণ্ডবিধির ব্যাপারে সুপারিশ করছ?’ অতঃপর লোকজনকে আহ্বান করে মহানবী (সা.) দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেন, ‘হে মানবমণ্ডলী! নিশ্চয়ই তোমাদের পূর্ববর্তী জনগণ পথভ্রষ্ট হয়েছে, এজন্য যে তাদের কোনো সম্মানিত লোক চুরি করলে তখন তারা তাকে রেহাই দিত। আর যখন কোনো দুর্বল লোক চুরি করত তখন তারা তার ওপর শাস্তি প্রয়োগ করত। আল্লাহর কসম! মুহাম্মদের কন্যা ফাতিমাও যদি চুরি করে, তবে অবশ্যই তার হস্ত কর্তন করে দিতাম’ (বোখারি ও মুসলিম)। ইসলাম একটি শান্তিপ্রিয় ধর্ম এবং এর শিক্ষা অত্যন্ত উচ্চাঙ্গের। ইসলামের শিক্ষাগুলোর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো সমাজ ও দেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। আল্লাহপাকের পক্ষ থেকে পৃথিবীতে এ পর্যন্ত যত নবীর (আ.) আগমন ঘটেছে, তাদের প্রত্যেককে আল্লাহতায়ালা বিশেষ যেসব দায়িত্ব দিয়েছেন তার মধ্যে প্রধান দায়িত্ব হলো ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। আল্লাহতায়ালার নির্দেশ অনুযায়ী সব নবীই (আ.) দেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করেছেন এবং এক্ষেত্রে সফলও হয়েছেন। পবিত্র কুরআন এবং মহানবী (সা.) সব ধর্মের অনুসারীদের নিজ নিজ রীতি অনুযায়ী ধর্ম-কর্ম পালনের শিক্ষা দিয়েছেন। মহানবী (সা.) বলেন- জেনে রাখ, যে ব্যক্তি কোনো অঙ্গীকারাবদ্ধ অমুসলমানের ওপর জুলুম করবে, তার অধিকার খর্ব করবে, তার ওপর সাধ্যাতীত কোনো কিছু চাপিয়ে দিবে বা তার অনুমতি ব্যতীত তার কোনো বস্তু নিয়ে নিবে আমি পরকালে বিচার দিবসে তার বিপক্ষে অবস্থান করব (আবু দাউদ)। অমুসলমানদের উপাসনালয়ে হামলা ইসলাম কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। শুধু তা-ই নয় অমুসলমানরা যেগুলোর উপাসনা করে সেগুলোকেও গালমন্দ করতেও বারণ করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন- ‘তোমরা তাদের গালি দিও না, যাদের তারা আল্লাহকে ছেড়ে উপাস্য রূপে ডাকে, নতুবা তারা অজ্ঞতার কারণে শত্রæতাবশত আল্লাহকে গালি দিবে (সুরা আনআম : ১০৯)। ফলে ইসলাম সব ধর্মাবলম্বীর মাঝে এক সামাজিক সম্প্রীতি সৃষ্টির ব্যবস্থাপত্র দিয়েছে। আল্লাহর এ নির্দেশের ওপর বিশ্বনবী পরিপূর্ণভাবে আমল করেছেন এবং তার পবিত্র সাহাবিদেরও আমল করার নির্দেশ দিয়েছেন। মহানবী (সা.) বিদায় হজের ভাষণে সবাইকে সতর্ক করে বলেছিলেন, ‘হে মানবমণ্ডলী! সাবধান, তোমরা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি কর না। কেননা তোমাদের পূর্বের জাতিগুলো ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করার কারণেই ধ্বংস হয়ে গেছে’ (ইবনে মাজা)। ইসলামে ন্যায়বিচারের শিক্ষা এমন এক অনিন্দসুন্দর শিক্ষা, যা ন্যায়পরায়ণ প্রত্যেক অমুসলিমও শুনে প্রশংসা না করে পারে না। পৃথিবীতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত করাই মহানবীর (সা.) আগমণের উদ্দেশ্য এবং তিনি নিজ আমল দ্বারা সর্বত্র ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষমও হয়েছিলেন। পবিত্র কুরআনে যেভাবে ইরশাদ করা হয়েছে ‘বল, আমার প্রভু আমাকে ন্যায়বিচার করার নির্দেশ দিয়েছেন’ (সুরা আরাফ : ২৯)। মহানবী (সা.) তা অক্ষরে অক্ষরে আমল করেছেন। আল্লাহতায়ালার অনুপম শিক্ষা এবং ইসলামের সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির বহিঃপ্রকাশ তখনই সম্ভব হবে, যখন প্রত্যেক মুসলমান আল্লাহপাকের প্রতিটি আদেশের ওপর আমল করবে। ন্যায়বিচারের আদর্শ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নিজেদের ঘর, সমাজ, আপন-পর, এমনকি শত্রæ-মিত্র নির্বিশেষে সবার সঙ্গে ন্যায়সুলভ ব্যবহারের মাধ্যমেই আমরা মহানবীর (সা.) প্রকৃত অনুসারী বলে দাবি করতে পারি। এছাড়া কেবল মুখে শ্রেষ্ঠ নবীর উম্মত হওয়ার দাবির কোনো মূল্য আল্লাহপাকের কাছে নেই। আমাদের নিজ জীবনে মহানবীর অনুপম আদর্শের প্রতিফলন ঘটাতে এবং নিজ কর্মের মাধ্যমে আমাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে হবে। সর্বক্ষেত্রে আমরা যখন ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবো, তখনই আমরা আল্লাহর প্রেমিকও হতে পারব আর খায়রে উম্মত হিসেবে নিজদের প্রকাশ করতে পারব এবং আল্লাহর দরবারে মুমিন হিসেবে বিবেচিত হবো। মহানবীর (সা.) নির্দেশ হলো ‘তুমি নিজের জন্য যা পছন্দ কর, অন্যদের জন্যও তা পছন্দ কর’। আমরা যদি এই হাদিসের ওপর দৃঢ়-প্রতিষ্ঠিত হই, তাহলেই কেবল ন্যায়বিচার করা সম্ভব। সাধারণত আমরা কি দেখি, নিজের অধিকার পুরোপুরি আদায়ের ক্ষেত্রে আমরা বদ্ধপরিকর, অথচ অন্যের অধিকারের বিষয়ে সামান্যতম চিন্তাও করি না। সত্য ও ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকার জন্য আমাদের যদি নিজ আত্মীয়স্বজন ও বয়োজ্যেষ্ঠদের অসন্তুষ্টিরও সম্মুখীন হতে হয়, তারপরও ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের পক্ষপাতিত্ব করা যাবে না। আমরা নিজেরা যখন ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকব, তখনই আমরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে পারব। নিজের মধ্যেই যদি ন্যায়পরায়ণতা না থাকে, তাহলে অপরকে কীভাবে উপদেশ দিতে পারি? আজকে ন্যায়বিচারের বড়ই অভাব আর এ কারণেই সর্বত্র বিশৃঙ্খলা, সামাজিক অস্থিরতা আর অরাজকতা দেখা দিচ্ছে। মহানবী সমাজে শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন। তিনি শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় ছিলেন এক মূর্ত প্রতীক। মহানবী (সা.) দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা দেন, ‘আরবের ওপর অনারবের, অনারবের ওপর আরবের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। সব মানুষ একে অপরের ভাই। সব মানুষ আদমের বংশধর আর আদম মাটি থেকে তৈরি।’ (মুসনাদে আহমাদ) মহানবী (সা.) সব মানুষের প্রতি ছিলেন উদার। ধর্ম-বর্ণ-জাতি-গোষ্ঠী বিচারে তিনি করো প্রতি জুলুম-অন্যায় করেননি। কারো প্রতি অবিচার করেননি। সমাজে বসবাসকারী সব সদস্যের সঙ্গে ন্যায়বিচার এবং উত্তম আচরণ করার শিক্ষাই বিশ্বনবীর শিক্ষা। ন্যায়, শান্তি ও নিরাপত্তার আচরণ অবলম্বন করার বিষয়ে মহানবী (সা.) ইসলামী শিক্ষামালার সারাংশ এভাবে বর্ণনা করেছেন, ‘প্রকৃত মুসলমান সে-ই, যার কথা এবং হাত থেকে কোনো মানুষ কোনোরূপ কষ্ট বা ক্ষতির সম্মুখীন হয় না’ (সুনানে নিসাই, কিতাবুল ইমান)। এই ভাষ্যে মুসলমান, অমুসলমান, বর্ণ ও জাত বা পূর্বসূরির সম্পর্কের ভিত্তিতে কোনোরূপ তারতম্য করা হয়নি। এই সুপ্রতিষ্ঠিত ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সমাজ উন্নতি করে জাতীয় শান্তি ও নিরাপত্তার জামিনদার হয়ে যায় এবং অবশেষে যদি বিশ্বের সব রাষ্ট্র নিজ নিজ স্বার্থের ঊর্ধ্বে গিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য এসব মূলনীতিতে সংঘবদ্ধ হয়ে যায় এবং কুরআনি শিক্ষামালা ও মহানবীর আদর্শকে পথনির্দেশক বানিয়ে এসব মূলনীতি বাস্তবায়ন করে তাহলে দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে বলা যায়, বিশ্বশান্তি পুরো বিশ্বের ভাগ্যে অবশ্যই জুটবে। মাহমুদ আহমদ : ইসলামি গবেষক ও লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App