×

মুক্তচিন্তা

অনিঃশেষ ষড়যন্ত্রের মূল্য একদিন দিতেই হবে

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৯ অক্টোবর ২০২১, ০১:১৭ এএম

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দুর্গোৎসবকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ থেকে আবারো একটি বীভৎস ষড়যন্ত্র আর আক্রমণের সংবাদ ছড়াল বিশ্বজুড়ে। ১৩-১৫ অক্টোবর পর্যন্ত একটানা সহিংস তাণ্ডবে বিপর্যস্ত হয়েছে হিন্দুদের বহু প্রতীক্ষিত ধর্মীয় অনুষ্ঠান, শারদীয় দুর্গাপূজা। কুমিল্লায় যার সূত্রপাত, মুহূর্তেই তা ছড়িয়ে পড়েছে চাঁদপুর, মৌলভীবাজার, সিলেট, হবিগঞ্জ, গাজীপুর, কক্সবাজার, ভোলা, নোয়াখালীসহ ২৪টি জেলার অভ্যন্তরে। সর্বশেষ পীরগন্জে। পূজামণ্ডপ, দোকানপাট, বাড়িঘর ভাঙচুর করা হয়েছে। আহতের সংখ্যাও শতাধিক। এবারো সেই চিরাচরিত অভিযোগ, কুরআন শরিফকে অবমাননা করা হয়েছে। নোয়াখালীর ইস্কন মন্দিরে ১৫ অক্টোবর হত্যাকাণ্ডও ঘটেছে। বাংলাদেশে ৫০ বছরের স্বাধীনতা লাভের ইতিহাসে মোটা দাগের দুটি ঘটনা লক্ষ্যে ও অলক্ষ্যে সমান্তরাল ঘটছেই। এক. দেশ থেকে সব ধরনের সংখ্যালঘুর নিশ্চিহ্নকরণ। দুই. রাষ্ট্রক্ষমতায় সাম্প্রদায়িক শক্তির সুপ্রতিষ্ঠা দিতে আসম্প্রদায়িক শক্তির পরিপূর্ণ উৎখাত। বলাবাহুল্য, সংখ্যালঘু পপুলেশনের মতো অসাম্প্রদায়িক পপুলেশনকেও এখানে ক্রমাগত ক্ষয়িষ্ণু করার চক্রান্ত চলছে স্বাধীনতাপূর্ব সময় থেকেই। সুতরাং সাম্প্রদায়িক চেতনার উপস্থিতি সব ধরনের প্রতিষ্ঠান থেকে সর্বস্তরের জনসমাজেই ক্রমশ দৃশ্যমান। ১৫ ও ১৬ অক্টোবর আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের দুই খবর- ‘The rise in communal tensions came as the minority Hindus celebrated their largest religious festival, Durga Puja,Õ (ABC News). এবং ‘Hours after Bangladesh PM’s warning, mob vandalizes ISKON temple, attacks its devotees on Dussehra,Õ (First post). যারা এখনো টেলিভিশন চ্যানেলে বসে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা উল্লেখ করে দৃষ্টান্ত স্থাপনের প্রশান্তি খুঁজছেন, তারা হিপোক্রিসির কারণে হয়তো সংখ্যালঘুর বুকফাটা আর্তনাদটাই শুনতে পাননি কখনো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য চেষ্টা করেছেন ২২ জেলায় বিজিবি নামিয়ে পরিস্থিতি অনুকূলে নিয়ে আসার। কেন্দ্রীয় সরকার থেকেও দু’চারজনের তৎপরতা ছিল লক্ষণীয়। কিন্তু পরিস্থিতি যাতে নাগালের বাইরে যায়, দেশব্যাপী সহিংসতা ছড়িয়ে দিয়ে যাতে সংখ্যালঘু নিধনযজ্ঞ মহাসমারোহে চলে, তার জন্য মদদদাতাদের কারসাজি তাতে থেমে থাকেনি। গণতন্ত্র রক্ষার নামে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি উজ্জ্বল করার নামে যারা সর্বদাই হন্তদন্ত হয়ে পড়ে, যত সম্ভব জল ঘোলায়ে তোলার কাজে পিছিয়ে থাকেনি তারাও। কিন্তু এ কথা কি সত্যিই কেউ বিশ্বাস করে, ইসলাম অবমাননার উদ্দেশ্য থেকেই দুর্গামন্দিরের অভ্যন্তরে কুরআন রাখা হয়েছিল? এবং সেটা হিন্দুরাই রেখেছিল? তাহলে হিন্দুরা জানার আগেই পুলিশ প্রশাসন কী করে জানল সেই খবর? আর হিন্দুরা জানার আগেই মুসলিম জনতাই বা উত্তেজিত হলো কী করে? দেবীমন্দিরে কুরআন রাখায় কিসের আগ্রহ হিন্দুদের? হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সব ধরনের সংখ্যালঘুর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ এর আগেও তোলা হয়েছে বহুবার। প্রমাণিত হয়নি কোনোবারই। কিন্তু সংখ্যালঘুর ওপর আক্রমণের সহিংসতা কিংবা জীবন বিপর্যয়ের ঘটনা থেমেও থাকেনি তাতে। মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন- ‘অষষ ৎবষরমরড়হং ষবধফ ঃড় ঃযব ংধসব এড়ফ. ঞযব বংংবহপব ড়ভ ধষষ ৎবষরমরড়হং রং ড়হব. ঙহষু ঃযবরৎ ধঢ়ঢ়ৎড়ধপযবং ধৎব ফরভভবৎবহঃ.’ সব ধর্মই এক ঈশ্বরের কথা বলে। সব ধর্মের একই মর্মকথা। কেবল আরাধনার আলাদা পথ। এ কথা সনাতন ধর্মের মর্মবাণী। এবং সে মর্মবাণী হিন্দুরা অনুসরণ করতেও জানে। কারণ নিজের ধর্মের প্রতি সনাতন ধর্মানুসারীদের শ্রদ্ধাবোধ কিংবা ভালোবাসার অভাব নেই। তাহলে কেন সর্বৈব মিথ্যাচারের ভিত্তিহীন অভিযোগে বারবার একই ধরনের নির্বোধ ষড়যন্ত্র করা হয়? কখনো শিবঠাকুরের মাথায় কুরআন রাখার ছবি পোস্ট করে, কখনো নবীর নামে নেতিবাচক মন্তব্য ছাপিয়ে, কখনো নামাজের সময় শঙ্খধ্বনি কানে যাওয়ার অজুহাত তুলে কেন সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ইসলাম অবমাননার দায়ে নারকীয় পাপাচার করা হয়? এজন্যই করা হয়, বাংলাদেশকে পেছনে ঠেলে ফেলার চক্রান্ত যারা যুগ যুগ ধরে চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের প্রতিনিধিরা সর্বস্তরের জনসমাজ থেকে সব ধরনের প্রতিষ্ঠানেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। এ ধরনের ফৌজদারি অপরাধের জন্যও অপরাধীদের কাউকেই তাই শাস্তি পেতে হয় না। অন্তত এখন অবধি পেতে হয়নি। অথচ ৭২-এর বাংলাদেশ সংবিধান অনুযায়ী, রাজনীতি এবং রাষ্ট্রীয় আচারে ধর্মকে ব্যবহার না করে ব্যক্তিগত পর্যায়ে রাখার নির্দেশ ছিল। প্রতিশ্রæতি ছিল সব ধর্মের অনুসারিদের সমান অধিকার নিশ্চিত করার। সপরিবারে জাতির জনকের হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে মুসলিম বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমান প্রথমেই বাঙালি জাতীয়তাবাদ আর ধর্মনিরপেক্ষতার পিলার দুটোকে কেটে অঙ্গহীন করে রক্তাক্ত করেছিল সংবিধানকে। সেই থেকে যন্ত্রণাদগ্ধ সংখ্যালঘুর মতো সংবিধান যেমন ক্ষতাক্ত জীবনের প্রতীক, তেমনি প্রবল প্রতিকূলতার চাপে মাইনোরিটি জনসংখ্যারও আরো নিচের দিকে নামতে থাকা। ১৯৪৭-এ সংখ্যালঘুর পরিসংখ্যান ছিল ২৯.৭ শতাংশ। ৭০ সালে তা নেমে দাঁড়ায় ২২ শতাংশে। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পরে ফের চাপ বাড়ানো হয় নানা ধরনের সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা সৃষ্টি করে। চঊড জবংবধৎপয ঈবহঃবৎ-এর ২০১১-র সেন্সাস রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১১-য় বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৮.৯৬ শতাংশ ছিল সংখ্যালঘু সম্প্রদায় (বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ)। ক্ষুদ্র আকারের বাংলাদেশে সংখ্যালঘু ছাড়াই জনসংখ্যার আকার বিরাট। সুতরাং অতি ক্ষয়িষ্ণু জনসম্প্রদায়কে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করলেও লাভ বিশেষ হবে না। আপাতত যেসব দুর্যোগ এবং আক্রমণের ধার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর দিয়ে যাচ্ছে, তারা সম্পূর্ণ নিঃশেষিত হলে স্বাভাবিকভাবে নির্যাতন, নিপীড়নের আঘাত সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের ওপরেই বর্তাবে। কারণ মধ্যযুগীয় চেতনা কোনোদিনই পারস্পরিক সহমর্মিতা কিংবা পারস্পরিক সহাবস্থানের প্রতি আস্থাশীল নয়। যারা রাজনৈতিক কিংবা অন্যান্য কৌশলগত উদ্দেশ্য থেকে এখনো এদের টুল হিসেবে ব্যবহার করে উস্কানি আর মদত দিয়ে চলেছে, এই বাস্তবতা উপলব্ধি করার সময় তাদের এসে গেছে। দেশের সব স্বঘোষিত সুশীলদের, শিক্ষিত জনসমাজ আর বুদ্ধিমান রাজনীতিকদেরও এ ব্যাপারে সচেতন হওয়া দরকার যে, একুশ শতকের পৃথিবীতে পরস্পরের টিকে থাকার বিষয়টি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ওপর কতখানি নির্ভরশীল। অন্তত দুই বছর ধরে করোনা ভাইরাসের তাণ্ডব সেটা চোখে আঙুল দিয়েই দেখিয়েছে সবাইকে। নিকট ভবিষ্যতে এমন বৈরী পরিস্থিতি মানবজাতির অস্তিত্বকে আরো বড় বড় চ্যালেঞ্জের দিকে ঠেলে দেবে, বিজ্ঞান সতর্ক করেছে সেই বিষয়েও। তারপরও বিভিন্ন কৌশলগত কারণে চরমপন্থিদের প্রশ্রয় দেয়া মানে পুরো দেশটাকেই অস্থির করে তোলা। অন্তত বর্তমান ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেন, আফগানিস্তানের নাগরিক জীবনের বিপজ্জনক পরিস্থিতি সেই বাস্তবতাই মনে করিয়ে দেয়। দেখিয়ে দেয়, কেবল অন্য ধর্মমতের মানুষের বিরুদ্ধে নয়, একই ধর্মের শিয়া সুন্নীরাও পরস্পরের বিরুদ্ধে কতটা হিংস্র হতে পারে। আধুনিক বিশ্বের মানবাধিকারের প্রতি কতটা অশ্রদ্ধা এদের অন্তরে। মানুষের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক কিংবা ব্যক্তিস্বাধীনতায় কতটা বিশ্বাসহীন তারা। এ ধরনের মানসিকতাই ধীরে ধীরে সমাজ আর রাষ্ট্রকে হিংসাময় করে দেয়। ক্রমাগত তলিয়ে দেয় অপরাধ সংঘটনের মধ্যে। সেটা কীভাবে হতে থাকে, সে সম্পর্কে বিস্তৃত বিশ্লেষণ করেছেন পাকিস্তানের গবেষক আরিশ উল্লা খান, তার ‘ঞযব ঃবৎৎড়ৎরংঃ ঃযৎবধঃ ধহফ ঃযব চড়ষরপু জবংঢ়ড়হংব রহ চধশরংঃধহ,’ নামক গবেষণা গ্রন্থে। তিনি দেখিয়েছেন, পাকিস্তানের শাসকরা, গোয়েন্দা বিভাগের শীর্ষ অফিসাররা চরমপন্থিদের আশ্রয় দিয়ে কত বড় অনিশ্চিত পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছেন দেশ এবং দেশের বাইরে। বলাবাহুল্য, এমন পরিস্থিতির জন্ম হয়েছে তাদের কৌশলগত পদক্ষেপের ফলেই। একদিন সংখ্যালঘুর বিরুদ্ধে বিরামহীন তৈরি করা অনিঃশেষ ষড়যন্ত্রের মূল্যও দিতে হতে পারে বাংলাদেশকেও।

দীপিকা ঘোষ : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App