×

অর্থনীতি

দ্রব্যমূল্যের লাগাম কোথায়

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ অক্টোবর ২০২১, ০৮:২৮ এএম

দ্রব্যমূল্যের লাগাম কোথায়

কোনো না কোনো অজুহাতে বেড়েই চলছে দ্রব্যমূল্য। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমার তো কোনো লক্ষণ নেই বরং যত দিন গড়াচ্ছে ততই বাড়ছে ‘বাজারের আগুন’। মাত্র এক মাসের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ৪৯ শতাংশ। করোনা চলাকালে মানুষের আয় কমলেও বছরের ব্যবধানে সয়াবিনের দাম বেড়েছে ৫০ শতাংশ। মানুষের পুষ্টি চাহিদা মেটানোর অন্যতম অনুষঙ্গ ব্রয়লার মুরগির দাম মাসের ব্যবধানে কেজিপ্রতি বেড়েছে ৪০ টাকা। সেই সঙ্গে আটা, ময়দা, চিনি, মশুর ডালসহ বেশ কিছু নিত্যপণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে সরকার পেঁয়াজে পুরোপরি ও চিনিতে আংশিক আমদানি শুল্ক প্রত্যাহারের পরও বাজারে তেমন কোনো প্রভাব নেই। তাই জনমনে প্রশ্ন উঠেছে- দ্রব্যমূল্যের লাগাম কোথায়? সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজারে সরবরাহের চরম ঘাটতি রয়েছে। এছাড়া দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কার্যকর উদ্যোগ না থাকায় বেড়েই চলছে দাম।

রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজারদরের চিত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মাসের ব্যবধানে দেশি পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ৫০ শতাংশ। গতকাল শনিবার রাজধানীর বাজারে প্রতিকেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৭০ টাকা, যা গত ১৪ সেপ্টেম্বর ছিল ৪২ থেকে ৪৫ টাকা। সরকার আমদানি শুল্ক ৫ শতাংশ প্রত্যাহার করে নেয়ার পরও মানভেদে আমদানি করা পেঁয়াজ প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা, যা গত মাসের এই সময়ে ছিল ৩৮ থেকে ৪০ টাকা। অর্থাৎ মাসের ব্যবধানে আমদানি করা পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ৪৯ দশমিক ৪৩ শতাংশ। এদিকে মাসের ব্যবধানে খোলা সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে প্রায় ১০ শতাংশ। ১৪ সেপ্টেম্বর ১৪০ টকায় বিক্রি হওয়া সয়াবিন তেল গতকাল বিক্রি হয়েছে ১৫০ টাকা। আর বছরের ব্যবধানে খোলা সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে ৫০ শতাংশের বেশি। গত বছর এ সময়ে ৯০ টাকায় বিক্রি হওয়া সয়াবিন তেল এখন বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকা।

সয়াবিন তেলের দাম বাড়ার বিষয়ে মৌলভীবাজার পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোলাম মাওলা ভোরের কাগজকে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম দিগুণের বেশি বেড়েছে। সরকার ভোজ্যতেল আমদানিতে শুল্ক প্রত্যাহার করলে দাম নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। কারণ ভোজ্যতেল আমদানি থেকে সরবরাহ পর্যন্ত কোনো সমস্যা নেই বলেও মনে করেন এই ব্যবসায়ী নেতা।

বাজার পর্যালোচনায় আরো দেখা গেছে, এই সময়ে সবচেয়ে আলোচিত ব্রয়লার মুরগির দাম। মাসের ব্যবধানে প্রতিকেজি ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে প্রায় ৪০ টাকা। গত ১৪ সেপ্টেম্বর ১৪০-১৪৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হওয়া ব্রয়লার মুরগি এখন ১৮০ টাকার কমে মিলছে না। শুধু মুরগি আর পেঁয়াজ নয়, বেড়েছে আটা, ময়দার দামও। মাসের ব্যবধানে প্রতিকেজি খোলা আটার দাম বেড়েছে ৭ দশমিক ৬১ শতাংশ, ময়দার দাম বেড়েছে ২০ শতাংশ। আর বছরের ব্যবধানে প্রতিকেজি ময়দার দাম বেড়েছে ৩০ দশমিক ৪৩ শতাংশ। এক মাস আগে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা বিক্রি হওয়া প্রতিকেজি ময়দা গতকাল বিক্রি হয়েছে ৪৪ থেকে ৪৬ টাকায়।

এদিকে মাসের ব্যবধানে চিনির দাম বেড়েছে প্রায় ৪ শতাংশ। গত ১৪ সেপ্টেম্বর ৭৫ টাকায় বিক্রি হওয়া চিনি গতকাল বাজারে বিক্রি হয়েছে ৮০ টাকা কেজি দরে। অথচ গত বছরের একই সময়ে চিনির দাম ছিল ৬০ টাকা। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে চিনির দাম বেড়েছে ২৭ দশমিক ২০ শতাংশ। প্রতিকেজি দেশি আদা বিক্রি হচ্ছে ১৯০ টাকা, যা গত মাসের একই সময়ে ছিল ১৪০ টাকা। অর্থাৎ মাসের ব্যবধানে দেশি আদার দাম বেড়েছে প্রায় ৩৫ শতাংশেরও বেশি। আর আমদানি করা আদার দাম বেড়েছে ৪৭ শতাংশ।

দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে আমরা প্রতিনিয়ত মিটিং করে যাচ্ছি। যেসব পণ্যের দাম বেড়েছে বলে কথা বলা হচ্ছে- যেমন : তেল, চিনি... প্রত্যেকটা পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বেড়েছে। তাই আমাদের দেশে এর প্রভাব পড়েছে। দাম নিয়ন্ত্রণ রাখতে গরিব কিংবা স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য টিসিবির মাধ্যমে কম দামে পণ্য বিক্রির চেষ্টা করছি। পেঁয়াজের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, পেঁয়াজে আমাদের ২০ শতাংশ ঘাটতি রয়েছে। যার ৯০ শতাংশ আমরা ভারত থেকে আমদানি করে পূরণ করি। ভারত যখন দাম বাড়িয়ে দেয়, তখনই আমাদের দেশে তার প্রভাব পড়ে। মিসরসহ অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি করাটা অনেক সময়ের ব্যাপার, অনেক সময় আমদানিকালে পথিমধ্যে পচে যায়। এ বিষয়টি সকলকে বুঝতে হবে বলেও মন্তব্য বাণিজ্যমন্ত্রীর।

ক্যাবের এক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত পাঁচ বছরে কেজিতে গরুর মাংস ও রুই মাছ যথাক্রমে ১৫০ ও ১৩০ টাকা বেড়েছে। কেজিপ্রতি চালে ১৭-২০ টাকা, ডাল ৩০ টাকা, চিনি ২০ টাকা ও দেশি পেঁয়াজের দাম কেজিতে ৪০ টাকা বেড়েছে। পাশাপাশি এই পাঁচ বছরে ব্রয়লার মুরগি কেজিতে ৬৫ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। প্রতি ডজন ডিমের (১২ পিস) দাম বেড়েছে ২৫ টাকা। তাছাড়া সবজির দাম গত পাঁচ বছরে অনেক বেড়েছে। ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ২০২০ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় ৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ এবং পণ্য ও সেবা-সার্ভিসের মূল্য ৬ দশমিক ৩১ শতাংশ বেড়েছে, যা গত তিন বছরে সর্বোচ্চ। কারণ ২০১৯ সালে এই হার ছিল যথাক্রমে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং ৬ দশমিক ০৮ শতাংশ। এছাড়া ২০১৮ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় এবং মূল্যবৃদ্ধি ছিল যথাক্রমে ৬ দশমিক শূন্য শতাংশ এবং ৫ দশমিক ১৯ শতাংশ। প্রতিবেদনে রাজধানী ঢাকায় ১৫টি খুচরা বাজার ও বিভিন্ন সেবা সার্ভিসের মধ্যে থেকে ১১৪টি খাদ্যপণ্য, ২২টি নিত্যব্যবহার্যসামগ্রী এবং ১৪টি সেবা-সার্ভিসের সংগৃহীত তথ্য-উপাত্ত বিবেচনায় নেয়া হয়।

এসব বিষয় নিয়ে কথা হয় কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমানের সঙ্গে। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, সরবরাহ পরিস্তিতির উন্নতি না হলে দ্রব্যমূল্যের লাগাম টানা সম্বব নয়। সবার আগে প্রয়োজন বাজারে পণ্যের অবাধ সরবরাহ। দ্বিতীয়ত পণ্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে উৎপাদন খরচ কমানোর বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। সরকার দাম নিয়ন্ত্রণে শুল্ক ছাড় দিয়েছে, যা ইতিবাচক। তবে সরকারের এই ছাড়ে বাজারে পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে আসবে এসব ভাবার কোনো কারণ নেই। তবে শুল্ক ছাড়ের কিছুটা প্রভাব হয়তো বাজারে পড়বে বলে মনে করেন ক্যাব সভাপতি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, কখনো আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধি, আবার কখনো সরবরাহ সংকটের অজুহাত দেখিয়ে প্রতিবছরই এসব পণ্যের দাম বাড়িয়ে মুনাফা লুটছেন মিল ও মোকাম মালিক এবং আমদানিকারকরা। এর নেপথ্যে সক্রিয় থাকছে অসাধু ব্যবসায়ীদের সেই প্রভাবশালী সিন্ডিকেট সদস্যরা। যারা সবসময়েই থাকেন অধরা। ফলে প্রতিবছরই তারা ভোক্তার পকেট কেটে নিয়ে যাচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। সব মিলে ক্রেতা সাধারণকে এসব পণ্য কিনতে সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই বাড়তি টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। এতে সবচাইতে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছে নিম্ন আয় ও খেটে খাওয়া মানুষ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কনসার্স কনজুমার্স সোসাইটির (সিসিএস) নির্বাহী পরিচালক পলাশ মাহমুদ ভোরের কাগজকে বলেন, গত কয়েকবছর ধরে নানা অজুহাতে দ্রব্যমূল্য বাড়ানো হচ্ছে। কারা, কীভাবে পণ্যমূল্য বাড়াচ্ছে তা খতিয়ে দেখা উচিত। করোনায় মানুষ কর্মসংস্থান হারিয়েছে। এই সময়ে দ্রব্যমূল্যের এমন ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষ চরম বিপাকে পড়েছেন। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করলে দেখা যায়, এই বাজারে আসলে সবাই অসহায়। তাই সরকারের উচিত, যত শিগগিরই সম্বব এই ঊর্ধ্বগতির লাগাম টানা। তাতে মানুষের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি আসবে বলে মনে করেন পলাশ মাহমুদ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App