×

জাতীয়

সুশীল সমাজের নীরবতায় হতাশ সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৭ অক্টোবর ২০২১, ০৮:২৬ এএম

সুশীল সমাজের নীরবতায় হতাশ সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী

ছবি: সংগৃহীত

সন্ত্রাস-ধর্ষণ-মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িকতা-গণতন্ত্র-নারী অধিকার ইত্যাদি বিষয়ে দেশের সুশীল সমাজকে প্রায়ই সরব হতে দেখা যায়। নিয়মিত বক্তৃতা-বিবৃতির পাশাপাশি কোন কোন সময় তারা রাজপথে মিছিল-সমাবেশের মাধ্যমেও জানান প্রতিবাদ। কিন্তু এবার দুর্গাপূজায় দেশের ২৪টি জেলায় মণ্ডপে হামলা ও প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনার প্রতিবাদে তাদের খুব একটা সরব হতে দেখা যায়নি। দুয়েকটি বাম রাজনৈতিক সংগঠন ও তাদের নেতারা ছাড়া সুশীল সমাজের নেতৃস্থানীয় কেউ বিবৃতি দেননি, জানাননি নিন্দাও। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ছাড়া অন্যকোনো সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনও হয়নি প্রতিবাদে সরব। অকস্মাৎ তাদের এই নীরবতায় অনেক সনাতন ধর্মাবলম্বীই হতাশা প্রকাশ করেছেন।

একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র গৌতম অধিকারী ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, কত সামান্য বিষয়ে দেশের সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা সোচ্চার হন, অথচ আমাদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসবটা এ রকম বিবর্ণ ও ভীতিকর হওয়ার প্রতিবাদে কেউ তেমন কিছুই বলছেন না! তবে কী তারা অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিসর্জন দিয়েছেন? নাকি সাম্প্রদায়িক শক্তির ভয়ে ভীত হয়ে পড়েছেন?

জানতে চাইলে ‘সুশীল সমাজ উল্টো পথে হাঁটছে’ মন্তব্য করে নাট্যজন মামুনুর রশীদ ভোরের কাগজকে বললেন, আমরা জাতিতে বাঙালি, ধর্মীয় পরিচয় ভিন্ন। বাঙালির যেসব উৎসব আছে, সে উৎসব সবারই। পহেলা বৈশাখে সারা বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে কী চমৎকার উৎসব করে থাকে! গ্রীস্মের চরম তাপদাহ এ উৎসবকে ম্লান করতে পারে না। সেখানেও রমনার বটমূলে যে ঘটনা ঘটে গেল, সেকি দুএকদিনের ষড়যন্ত্রের ফল? দীর্ঘদিনের হিংস্রতা বজায় রেখে এ কাজটি সেরেও কেমন করে যেন ওই সম্প্রদায় পার পেয়ে যায়! ধর্মে রাজনৈতিক ব্যবহার রোধ করতে না পারলে, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে এর মোকাবিলা করতে না পারলে এই ধর্মহীন সাম্প্রদায়িক শক্তিকে রোখা যাবে না এবং সুশীল সমাজকেও উল্টো পথে না হেঁটে সোজা পথে হাঁটতে হবে।

ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন বলেন, প্রায় প্রতিবছরই এ ঘটনা ঘটে। সরকার ও প্রশাসন সবই জানে। তবে যখনই ঘটনা ঘটেছে, তখনই সরকারের পক্ষ থেকে যদি বলা হতো বিষয়টা আমরা দেখছি; তাহলে পরিস্থিতি এতটা গড়াত না। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এদের শাস্তি দেবেন। আমার কথা হচ্ছে- বিগত সময়ে রামু থেকে শুরু করে যতগুলো ঘটনা ঘটেছে এক হেফাজতের মোমিনুল ছাড়া এর বাইরে কোনোটারই শাস্তি হয়নি। বরং দেখা গেছে, যারা হিন্দুর ঘরবাড়ি ভেঙেছে তারা আওয়ামী লীগের নমিনেশনও পাচ্ছে। যদিও পরে তা বাতিল করেছে। এটা করে তাদের একধরনের প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছে। কিন্তু এসবে তো মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে যায়। অন্তত একবার ওদের শাস্তি দেয়া হোক।

এসব ঘটনার সঙ্গে সম্প্রীতির বন্ধনের কোনো সম্পর্ক নেই মন্তব্য করে মুনতাসীর মামুন আরো বলেন, ঘটনাগুলো দুঃখজনক, যেটা আমরা কেউই চাই না। কিন্তু এ রকম ঘটনা ঘটানোর জন্য অন্যরা সবসময়ই তৈরি থাকে। তাই আরো সতর্ক থাকা উচিত। সরকার চেষ্টা করছে। আমরাও সবসময় সরকারের পাশে আছি। এতে উত্তেজিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। কারণ পার্শ্ববর্তী দেশে এ ধরনের অনেক ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু আমরা এখানে শান্ত থাকতে বলেছি সবাইকে। আমরা যদি নিজেদের শান্ত রাখতে না পারি, তাহলে পরিস্থিতি ঘোলাটে হলে কারো উপকার হবে না।

রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সম্প্রীতির বন্ধন কেউ আলগা করতে পারবে না এমন মন্তব্য করে কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বলেন, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে যদি আমাদের এ ধরনের ঘটনা দেখতে হয় তাহলে হতাশই লাগে। দেশটা তো স্বাধীন হয়েছে সবার জন্যই। অথচ এখন কি দেখছি? বরাবরই লেখার মধ্য দিয়ে উচ্চারণ করছি, সকল ধর্মকে সমানভাবে শ্রদ্ধা করা, সব উৎসবকে নিজেদের উৎসব মনে করা- এটাই হোক আজকের বাংলাদেশের স্বপ্ন। কিন্তু বারবার এমন ঘটনা ঘটিয়ে আমাদের মর্মাহত করছে। এমন বাস্তবতায় স্বাধীনতার স্বপ্নকে কী করে আকাশচুম্বি করব? বঙ্গবন্ধু নিজেও বলেছেন, ‘আমার সামনে সবাই মানুষ। সবার অধিকার এক।’ কিন্তু ৫০ বছর পরও দুর্গাপুজার উৎসবে যখন এমন ভাঙচুর দেখি, তখন খুবই মর্মাহত হই। সরকারের উচিত যারা এমন কাজ করে তাদের কঠিন শাস্তি দেয়া। ওই অপরাধীদের কঠিন শাস্তি না দিলে এ ধরনের বিচাহীনতার সংস্কৃতি আমাদের এভাবে গ্রাস করবে। এর থেকে উত্তরণ পাব না। আমরা চাই না বিচারহীনতার সংস্কৃতি আমাদের এভাবে গ্রাস করুক।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য নূহ উল আলম লেনিন বলেন, ঐতিহাসিকভাবে রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব আছে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগই হয় ধর্মের ভিত্তিতে। তবে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর জিয়াউর রহমান আবার বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সুযোগ করে দেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে সমাজ এবং রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরকে ঢেলে সাজাতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থাকেও ঢেলে সাজাতে হবে। এছাড়া দেশের প্রতিটি মানুষ যার যার অবস্থান থেকে একসঙ্গে কাজ করলে অসাম্প্রদায়িক কল্যাণমুখী রাষ্ট্র গড়ে তোলা সম্ভব। এ ব্যাপারে গণমাধ্যমেরও ভূমিকা আছে। আরেকটি বিষয় হলো, কেবল সুশীল সমাজ নয়, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে সকল ধর্মের সবাই মিলে যার যার অবস্থান থেকে একযোগে কাজ করতে হবে।

আমরা নিষ্ক্রিয় নই, বরাবরই স্বোচ্চার- এমন মন্তব্য করে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুস বলেন, কোনো ধর্মই মানুষের অকল্যাণের কথা বলে না। পৃথিবীর সব ধর্মই মানুষের কল্যাণের কথা বলে। তাই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে কেউ যাতে ধর্মের অপব্যাখ্যা করে তাকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতে না পারে সেদিকে নজর দিতে হবে। দেশের প্রতিটি মানুষকে যদি প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করা যায় তাহলেও দেশ থেকে সাম্প্রদায়িকতা দূর হবে। তবে বারবার এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকলে এবং এর বিচার না হলে সাম্প্রদায়িকতা পরোক্ষভাবে জিতে যায়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App