×

মুক্তচিন্তা

আফসার আহমদ স্যার এ চিঠি পাবেন কি না জানি না

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৭ অক্টোবর ২০২১, ০১:৫৩ এএম

স্যার, এ এক অর্থহীন পত্র লেখা। অর্থহীন, কেননা আপনাকে উদ্দেশ্য করে লিখছি ঠিকই; কিন্তু আপনি তা পাবেন না কোনোদিন, দেখবেনও না কোনোদিন। এখন আপনার নাম-পরিচয় বদলে গেছে, বদলে গেছে সহজ ঠিকানাটাও। এমনি করে নাম-পরিচয় ও ঠিকানা বদলের এত তাড়া কিসের ছিল আপনার জানি না। তবু আপনি বদলে ফেলেছেন আপনার ঠিকানাসহ সমুদয় পরিচয়! আপনি আজ অন্য ভুবনের বাসিন্দা! আমরা আজ ‘দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা’। মৃত্যু নামের কঠিন এক বাস্তবতায় আজ আপনি ভিন্ন এক পরিচয়ের অবলেশ ধারণ করেছেন! ভিন্ন পথেরও অভিযাত্রী হয়েছেন। আমাদেরও পথ আজ ভিন্ন- যারা জীবনটাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচেবর্তে রয়ে গেছি! সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, মায়া-মমতায় ৩৩টি বছর একসঙ্গে একই সুর ও ছন্দের ভেতর ছিলাম আমরা। কত কথা, কত কাজ, কত গবেষণা, কত মত-মতান্তর কত বিচিত্র জীবনবোধের নাটক রচনা ও উপস্থাপনা আর সেসবের কত বিচিত্রতর চরিত্রের কত বিচিত্র অবয়ব আমরা ভেঙেছি গড়েছি! একটি নক্ষত্র পতনের মধ্য দিয়ে সবই সাঙ্গ হলো অকস্মাৎ! সব সুর পাল্টে গেল, সব ছন্দ হারিয়ে গেল! কোথা থেকে এক লোভাতুর মৃত্যু এসে আমাদের চারপাশ শূন্য করে আপনাকে নিয়ে উড়াল দিল অচিন দেশের পানে। মৃত্যু নিয়ে আপনার এক দার্শনিক বক্তব্য আমাকে কষ্ট দিয়েছিল একদিন। আজ আপনার মৃত্যু শুধু আমাকে নয়, আমাদের অনেককেই কষ্টকর এক আবহের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এক চাঁদনি রাত। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের পরতে পরতে বিলিয়ে দেয়া জোসনার সৌন্দর্য দেখতে দেখতে তামাম বিশ্বনিখিলের রূপৈশ্বর্য নিয়ে আপনি বলেছিলেন ‘পৃথিবীটা অদ্ভুত সুন্দর! আর মৃত্যু হলো ভীষণ কষ্টের- মৃতের জন্য নয়, জীবিতের। আশ্চর্য হলো মৃত্যুও নানা দিক থেকে পৃথিবীকে সুন্দর করে তোলে।’ সদ্য পিতৃবিয়োগের পর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের এক মাসের মাথায় সেদিন আপনার এ কথা শুনে প্রথমে যারপর নাই কষ্ট পেয়েছি, মর্মাহত হয়েছি। ভেবেছি এ কেমন কথা? আমি তো আব্বার মৃত্যুটাকে কোনোভাবেই ভুলতে পারছি না। আব্বার মৃত্যুতে পরিবারের সবাই নানাভাবে ভেঙে পড়েছিলাম, বিপর্যস্তও হয়েছিলাম। আব্বার মৃত্যুর সঙ্গে আমি তো পৃথিবীর কোনো সৌন্দর্যের সম্পর্ক দেখিনি। প্রথম বর্ষের মাস খানেকের ছাত্র আমি। কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের দার্শনিক কথার প্রতিবাদ করি সে ভাষা তৈরি হয়নি! আপনি জানতেন অল্প কয়েকদিন আগেই আব্বা মারা গেছেন। আমার মধ্যে সবসময় একটা ‘মনমরা’ ভাব ছিল! সর্বদা সেই ভাবের মধ্যেই হয়তো আপনি আমাকে দেখেছিলেন। তাই সান্ত¡না দেয়ার জন্য সেদিন এভাবে ভরা জোসনায় আমাকে নিয়ে ক্যাম্পাসে হেঁটেছিলেন। তখন বুঝিনি তা, বুঝেছি অনেক পরে। কিন্তু প্রথম বর্ষের অনেকটা অবুঝ ছাত্র হিসেবে শুধু জানতে চেয়েছিলাম মৃত্যু পৃথিবীকে কীভাবে সুন্দর করে? আপনি বলেছিলেন ‘মনে করো তুমি আমি হাঁটছি এমন সময় রবীন্দ্রনাথ, নজরুল কিংবা ধরো শেক্সপিয়র এসে যদি উপস্থিত হন তোমার ভালো লাগবে? আমার কিন্তু লাগবে না। তাই বলছি যুগ যুগ ধরে অন্যান্য অনেক কিছুর মতো মৃত্যুও পৃথিবীকে সুন্দর করে চলেছে। সেই আদম (আ.) থেকে শুরু করে মুসা (আ.), ঈসা (আ.), মুহম্মদ (স.) সবাই যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে পৃথিবীটা কেমন হতো?’ মাঝখানে আবার কিছুটা হাস্যরস তৈরি করে বলেছিলেন, ‘মনে করো তুমি বাজারে গিয়ে দেখলে হোমার কিংবা সফোক্লেসের সঙ্গে মাছ বিক্রেতার কথা কাটাকাটি চলছে, কিংবা সক্রেটিস, প্লেটো বা অ্যারিস্টটল অন্য কিছু কেনার জন্য কিংবা ধরো বিক্রি করতে বসে আছেন তখন কেমন লাগত তোমার? আমি নিশ্চিত তুমি কেন, কেউ এ দৃশ্য সহজভাবে নেবে না। কাজেই তারা মরে গিয়ে ভালোই করেছেন, কী বলো? মৃত্যুই পৃথিবীকে সুন্দর করে!’ আমি বলেছি হোমার, সক্রেটিস, প্লেটো, সফোক্লেসেরা মহৎ মানুষ, তারা মরুক কিন্তু আমার আব্বা কেন মরবেন? বিশেষ করে মধ্যবিত্ত পরিবারের একটি ছেলের এডমিশন টেস্টের রেজাল্টের পরই কেন তার আব্বা মরে যাবেন? হোমার, সফোক্লেস বা অ্যারিস্টটলদের তো এ সমস্যা ছিল না। কিন্তু স্যার, আপনাকে কী করে এ কথা বলি সেই রাতে তা বুঝতে পারিনি! ১৯৮৮ সালের কথা। পরে ভেবেছি কোনো একদিন মৃত্যু নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করব। কিন্তু সেই ‘কোনো একদিন’ আর আসবে না! সুতরাং অমীমাংসিতই থেকে গেল মৃত্যু ও সৌন্দর্যের আলোচনা। ২০২১ সালের শেষ প্রান্তে এসে যখন আপনিও মৃত্যুকে বরণ করে নিলেন তখনো মৃত্যুর সঙ্গে সৌন্দর্যের কোনো সম্পর্ক আবিষ্কার করতে পারছি না, স্যার। কেবল অন্তহীন আবেগে চোখ ঝাঁপসা হয়ে আসছে! কেবল ভাবছি নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন এবং জাতীয় অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলামের প্রয়াণের পর আমরা একটি পরিবারের মধ্যে আপনার অভিভাবকত্বের অধীনে ছিলাম। আমাদের মাথার ওপর আজ কোনো অভিভাবক রইল না! স্বজন হারানোর বেদনায় এখনো বুঝতে পারছি না আপনার এই মৃত্যু পৃথিবীর কী সৌন্দর্য বৃদ্ধি করল! একটু বুঝিয়ে বলবেন, স্যার! সৌন্দর্য বৃদ্ধি করলেও তা বুঝতে চাই না। সেদিনের জোসনাভরা রাতের ক্যাম্পাসে যেমন বুঝিনি আজো সেই অবুঝের দলেই থাকতে চাই- অবুঝের দলভুক্ত হয়ে আবেগের চোখের জলেই ভাসতে চাই নিরন্তর। আপনার মৃত্যু আমাদের হঠাৎ ঝড়ের মতো লণ্ডভণ্ড ও দিশেহারা করে দিল, স্যার! আমরা দিশাহীন হয়ে পড়েছি, হে নাট্য দিশারী! এভাবে হঠাৎ আপনি চলে যাবেন বুঝতে পারিনি, স্যার। আপনি কি জানতেন এভাবে চলে যাবেন সহসা অকস্মাৎ! আপনার চলে যাওয়াকে তাই আমরা নাম দিয়েছি ‘আকস্মিক চলে যাওয়া’! ৩০ সেপ্টেম্বর আমরা আপনার ৬২তম জন্মদিন উদযাপন করলাম। করোনার অতিমারির প্রকোপ কমতে থাকায় আপনার জন্মোৎসবে সমবেত হয়েছিল আপনার স্নেহধন্য ও গুণমুগ্ধ ছাত্রছাত্রীরা! অনেকে আবার অনলাইনে যুক্ত হয়ে আপনাকে অভিবাদন, অভিনন্দন ও জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমাও চেয়ে নিয়েছেন সশরীরে উপস্থিত হতে না পারার জন্য। আবার এও তো অনেকে বলেছিলেন- এবার আসতে পারলাম না স্যার, আগামী জন্মদিনে অবশ্যই আসব! এই প্রতিশ্রæতি এখন সেসব শিক্ষার্থীর কানে প্রতিনিয়ত হাহাকারের আর্তনাদ হয়ে প্রতিধ্বনি করে চলেছে সারাক্ষণ! ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে ৯ অক্টোবর- একি খুব লম্বা সময় ছিল স্যার? আপনার জন্মোৎসবের আমেজটাই তো শেষ হলো না! জন্মদিনের আনন্দ-আমেজের ঘোরের মধ্যে আমাদের ফেলে রেখে আপনি বিদায় নিলেন, হাসতে হাসতে চলে গেলেন চিরদিনের মতো। ছাত্রের বিয়ের আশীর্বাদ করতে খুলনা গেলেন ৭ তারিখ, ফিরলেন ৯ তারিখ সকালে ঢাকায়। আপনার বুকের ভেতর গোপন শত্রæ বাসা বেঁধেছিল, বিমানে বসে টের পেয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু অন্য সব ব্যথার মতোই এ ব্যথাকেও পাত্তা দেননি! তাই শত্রæও সুযোগ নিয়ে আপনাকে বাড়ি পর্যন্ত ফিরতে দিল না! দ্রুতই যেতে হলো হাসপাতালে! সেখান থেকে মৃত্যুদূত আমাদের কাছ থেকে আপনাকে ছিনিয়ে নিয়ে পাড়ি জমাল দূর অসীমের পানে- যেখান থেকে কেউ ফেরে না, আপনিও ফিরবেন না আর আমাদের মাঝে! আপনার এই আকস্মিক চলে যাওয়াকে মৃত্যু যদি বলি তবে স্বাভাবিক পথে তার আসার সময় যে হয়নি তা তো বলতেই পারি। এ যেন হঠাৎ শূন্যে উড়াল দেয়া পাখি! আপনারই লেখা ও গাওয়া সেই গানের কথার মতো : ‘করতলের পাখি হঠাৎ পাথর হয়েছে/ তুমি উড়াল দিয়েছো, তুমি উড়াল দিয়েছো।’ নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের লেখা আর আপনারই সুর করা ও গাওয়া সেই গানের কথার মতো : ‘ছায়ার নীচে বসবো ভেবে/ তাকিয়ে দেখি লঘু/ মেঘের রূপান্তরে তুমি উড়াল দিয়েছো/ করতলের পাখি হঠাৎ পাথর হয়েছে/ তুমি উড়াল দিয়েছো, তুমি উড়াল দিয়েছো।’ আপনার উদ্দেশ্যে এ আমাদের বেদনাসিক্ত রোদনের সাতকাহন। এত দ্রুত কেন চলে গেলেন স্যার, আমাদের পেছনে ফেলে? জ্ঞানে-গরিমায় আপনিই তো অগ্রগামী ছিলেন! ছিলেন জীবনযাপনেও অগ্রগামী চিন্তার পথিকৃৎ। তবু আপনার এমন চলে যাওয়ায় আমরা মর্মাহত, বেদনায় ভারাক্রান্ত, বিমর্ষ ও দিকভ্রান্ত। আপনার সহসা প্রয়াণ আমাদের দিকভ্রান্তই শুধু করেনি আমরা দিশাহীনও হয়ে পড়েছি। ভবিষ্যতের কোনো রূপরেখা মনের সম্মুখে ভাসাতেই পারছি না- সবাই কেমন এলোমেলো ও অস্থির! কেবল আপনার সঙ্গে থাকা আপনার শিল্পভাবনার সংলগ্ন থাকার দীর্ঘ অভ্যাসে অতীতই সতত উজ্জ্বল হয়ে মনের পর্দায় ভাসে। সেই ভাসমান অতীতের স্মৃতিকেই আপনি আমাদের সম্বল করে দিয়ে হঠাৎ উধাও হলেন, হঠাৎ উড়াল দিলেন শূন্যে- মহাশূন্যে! কী দ্রুত সেই উড়ালের গতি যে আপনার সঙ্গে পাল্লা দেয়া সহজ হয়ে উঠবে না কারো পক্ষেই। পুনশ্চ : ব্যক্তিগত ত্রæটিবিচ্যুতির ঊর্ধ্বে খুব কম মানুষই আছেন। তাই অ্যারিস্টটলও অনেকটা এরূপ বলেছিলেন, বড় বড় জ্ঞানীদের যতই কাছে যাবে, তাদের আচার-আচরণ দেখে ততই হতাশ হবে। মৃত্যুর পর আফসার আহমদের শিক্ষকসত্তাই তার ছাত্রছাত্রীদের কাছে মূল বিবেচনার কেন্দ্র হোক। আলোচনার বিষয় হোক তিনি ছাত্রস্বার্থ রক্ষায় কতটা আন্তরিক ছিলেন, কতটা ছাত্রবান্ধব ছিলেন তাও। আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে চাই- এ দুটো বিষয়ে তার ছাত্রদের নম্বর দিতে বললে তারা তিন অঙ্কের নিচে নামবেনই না, অর্থাৎ ১০০-তে ১০০-ই পাবেন আফসার স্যার! তার সমকক্ষ ছাত্রবান্ধব শিক্ষক আমাদের মধ্যে অল্পই আছেন। জ্ঞান ও সাধনার মার্গীয় পথ নিয়ে গুরুশিষ্য মতান্তর-মতভেদ থাকতেই পারে। মতান্তর-মতভেদের মধ্য দিয়েই জ্ঞানের চূড়ান্ত বিকাশ। সম্মুখ-সাক্ষাতে অমীমাংসিত বিষয়ের সমাধান কেবল তার রেখে যাওয়া রচনাবলির সাহায্যেই সম্ভব- অনুপস্থিত শিক্ষককে বিতর্কের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে নয়। আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App