×

জাতীয়

সাম্প্রদায়িক অপশক্তির তাণ্ডব

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৬ অক্টোবর ২০২১, ০৮:৩৭ এএম

সাম্প্রদায়িক অপশক্তির তাণ্ডব

কুমিল্লায় কথিত ‘পবিত্র কুরআন অবমাননার’ প্রতিবাদে শুক্রবার রাজধানীর বায়তুল মোকাররম মসজিদ থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করে উগ্রবাদীরা। এতে পুলিশ বাধা দিলে উভয়পক্ষে সংঘর্ষ বেঁধে যায় -ভোরের কাগজ

কুমিল্লায় ‘কুরআন অবমাননার’ ষড়যন্ত্রের জেরে সারাদেশে তাণ্ডব চালাচ্ছে উগ্র সাম্প্রদায়িক অপশক্তি। শুক্রবারও তাদের নৃশংস তাণ্ডব অব্যাহত ছিল। রাজধানী ঢাকায় পুলিশের সঙ্গে উগ্রবাদীদের সংঘর্ষ ছাড়াও বন্দরনগরী চট্টগ্রামে পূজামণ্ডপে হামলা ও ভাঙচুর হয়েছে। নোয়াখালীর চৌমুহনীতে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী পূজামণ্ডপ ও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘরে তাণ্ডব চালিয়েছে। সেখানে যতন কুমার সাহা নামে একজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।

গত বুধবার থেকে সারাদেশে ধারাবাহিক এই হামলায় শুভবুদ্ধির মানুষ নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকেও কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের মূলমন্ত্রের পুনরাবৃত্তি করে ধর্মের নামে সহিংসতা সৃষ্টিকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু সরকারের কঠোর অবস্থানের পরও হামলা থামেনি।

যেসব জায়গায় হামলা হয়েছে, সেখানকার প্রশাসন যথাসময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারেনি। স্বাভাবিকভাবেই এসব হামলার ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ববোধ নিয়েও। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রশাসনে ঘাপটি মেরে থাকা জামায়াত-হেফাজতের দুষ্কৃতিকারীরা জল ঘোলা করছে। চলমান পরিস্থিতিতে প্রশাসন কিছুতেই দায় এড়াতে পারে না। তবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অটুট রয়েছে দাবি করে দায়িত্বে অবহেলার প্রমাণ পাওয়া গেলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

জুমার নামাজের পর শুক্রবার রাজধানী ঢাকায় বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ, পল্টন ও কাকরাইল এলাকায় এবং নোয়াখালী জেলার চৌমুহনীতে পুলিশের সঙ্গে উগ্রবাদীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের চৌমুহনীতে সংঘর্ষের জের ধরে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের দোকানপাট ও বাড়িঘরে হামলা চালানোর খবর পাওয়া গেছে। হামলায় একজনের মৃত্যুও হয়েছে।

ঢাকার মিছিলে ‘মালিবাগ মুসলিম সমাজের’ একটি ব্যানার দেখা গেছে। অন্যদিকে চৌমুহনীতে মিছিলকারীদের ব্যানার ছিল ‘তৌহিদী জনতা।’ সিলেট নগরীর হাওলদার পাড়ার দুটি পূজামণ্ডপে প্রতিমা ভাঙচুরের চেষ্টা চালানো হয়েছে। বেলা সোয়া ২টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। পরে পুলিশ ও হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন জড়ো হলে হামলাকারীরা পালিয়ে যায়। হামলাকারীরা মণ্ডপের পাশের বাসাবাড়িতেও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এছাড়া জুমার নামাজের পর চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ থেকে বের হয়ে একদল লোক জেএমসেন হল পূজামণ্ডপের গেট ভেঙে ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করেন। এ সময় তারা ঢিল ছোড়ে এবং পূজার ব্যানার ছিঁড়ে ফেলে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। জেএমসেন হলের পূজামণ্ডপে হামলার পর প্রতিমা বিসর্জন না দেয়ার ঘোষণা দেয় চট্টগ্রাম মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদ। অবশ্য পরে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের আশ্বাসে সেখানে প্রতিমা বিসর্জন হয়েছে। তবে হামলার প্রতিবাদে আজ শনিবার চট্টগ্রামে আধাবেলা হরতালের ডাক দিয়েছে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদে সব সময় পুলিশ থাকে, গতকাল হামলার সময় কোনো পুলিশ সেখানে ছিল না। এ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

এ ব্যাপারে একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি, গবেষক শাহরিয়ার কবির ভোরের কাগজকে বলেন, এসবই জামায়াত-বিএনপির এজেন্ডা বাস্তবায়ন। আফগানিস্তানে তালেবান সরকার প্রতিষ্ঠার পর এই গোষ্ঠী প্রাণ ফিরে পেয়েছে। ২০০১ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তাদের চরম অবস্থা দেখা গেছে। দেশে যতদিন জামায়াত থাকবে ততদিন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি কল্পনা করা যায় না। কুমিল্লায় যে ঘটনা ঘটেছে তা বিশ্লেষণ করলে সহজেই বোঝা যায়, কোনো হিন্দু ধর্মাবলম্বীর এত সাহস নেই- তারা কুরআন শরিফের অবমাননা করবে। পুরো ঘটনাটিই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রয়োজন। একই সঙ্গে সাক্ষী সুরক্ষা আইনও থাকতে হবে। তিনি বলেন, কুমিল্লার ঘটনায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৪৩ জনকে। সরকার কঠোর অবস্থানে রয়েছে। তবে হেফাজতের মতো সংগঠনও আছে এই দেশে। প্রশাসনে জামায়াত-হেফাজতের লোকজন বসে আছে। এরা উসকে দিচ্ছে। কুমিল্লার ওসি কী করেছে? আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দায়িত্ব এড়াতে পারে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ভোরের কাগজকে বলেন, ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা দেখি। আগে দেখি না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কঠোর নির্দেশনার পর প্রশাসন, গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাফিলতি চোখে পড়ার মতো। তাদের ভূমিকা আরো জোরদার হতে হবে। বিভিন্ন সময়ে সাম্প্রদায়িক ঘটনার সঙ্গে জড়িত অপরাধীরা জামিনে ঘুরে বেড়ায়। তাদের ষড়যন্ত্র থেমে নেই। এদের কঠোর নজরদারিতে রাখা প্রয়োজন। তিনি বলেন, নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধ শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। দেশপ্রেম, সংস্কৃতি, সততার শিক্ষা দিতে হবে। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি। এটি কঠিন কাজ। এজন্য শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন দরকার।

বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতা সুব্রত চৌধুরী বলেন, এটি পরিকল্পিত ঘটনা। মোটেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। রামু থেকে কুমিল্লা, কারো ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। রামুর ২২ মামলার অভিযোগপত্রও দেয়া হয়নি।

চলছে দোষ চাপাচাপির রাজনীতি : চলমান পরিস্থিতিতেও থেমে নেই বাহাসের রাজনীতি। একে অপরের ওপর দোষ চাপিয়ে কথার রাজনীতি করছে রাজনৈতিক দলগুলো। ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, বিএনপি আবারো তাদের সেই পুরনো রূপে ফিরে এসেছে। তারা নতুন করে সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দিচ্ছে এবং এসব কাজে সহযোগিতা করছে। এদিকে পূজামণ্ডপে সৃষ্ট উত্তেজনার ঘটনায় আওয়ামী লীগ পুরোপুরি মদত ও উসকানি দিচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি হাজার বছর ধরে আছে।

দুঃখজনকভাবে এই অবৈধ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে, তাদের ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখার জন্য তারা সব সময় বিভিন্নভাবে বিভিন্ন রকম সমস্যা তৈরি করছে। মাঝে মাঝে তাদের মূল সংকটগুলো থেকে জনগণের দৃষ্টি দূরে সরিয়ে নেয়ার জন্য ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেছেন, বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক দেশ। এখানে এই ধরনের হামলা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। পূজামণ্ডপ রক্ষার মূল দায়িত্ব সরকারের, ব্যর্থতার দায়ও সরকারের। সরকারের চরম ব্যর্থতায় এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। এখানে পুলিশের ব্যর্থতা আছে। তাদের সাসপেন্ড করা দরকার। ব্যর্থ পুলিশের ট্রাইব্যুনালে বিচার করা দরকার। গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, আমরা এর বিচার চাই। মানুষ প্রতিবাদ করলে পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়। সেটা প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি।

পুলিশের বক্তব্য : পুলিশের আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদসহ বেশ কয়েকজন পদস্থ কর্মকর্তা বিদেশে অবস্থান করছেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিমা ভাঙচুর এবং পূজামণ্ডপে হামলা ও গুজব ছড়িয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি প্রসঙ্গে পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি পদমর্যাদার একাধিক কর্মকর্তা ভোরের কাগজকে বলেন, কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে, যা ছিল অনাকাক্সিক্ষত ও অপ্রত্যাশিত। সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সব সময় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়ে থাকে। শারদীয় দুর্গোৎসব উপলক্ষে সর্বত্র নেয়া হয় বাড়তি নিরাপত্তা। এর মধ্যে যেসব ঘটনা ঘটেছে সেসব ঘটনা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। জড়িত অনেকেই ধরা পড়েছে। অন্যদের শনাক্ত করে আটকের চেষ্টা চলছে। এসব ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো ব্যর্থতা ছিল না দাবি করে তারা বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থা সমন্বিতভাবে কাজ করছে। যদি কারো বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার প্রমাণ পাওয়া যায় অবশ্যই তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এমনিতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অটুট রয়েছে বলেও তারা দাবি করেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App