×

মুক্তচিন্তা

ফাইন্যান্সিয়াল লিটারেসি : আর্থিক প্রতারণা থেকে সুরক্ষার জন্য প্রয়োজন

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৬ অক্টোবর ২০২১, ০১:৫৬ এএম

সাম্প্রতিক সময়ে ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, ধামাকা প্রভৃতি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের লাগামহীন প্রতারণার শিকার হয়েছে দেশের লাখ লাখ গ্রাহক। অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে কাক্সিক্ষত পণ্যটি কেনার আশায় উল্লেখিত প্রতিষ্ঠানগুলোর লোভনীয়, অবাস্তব অফারে প্রলুব্ধ হয়ে এসব সাধারণ মানুষ তাদের কষ্টে উপার্জিত অর্থ, আবার কেউ কেউ ধার-কর্জ করে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন। অথচ তারা টাকা বিনিয়োগের সময় নিজেদের সাধারণ জ্ঞানবুদ্ধিকে কাজে লাগাননি মোটেও। এ ধরনের অবাস্তব অফার কোনোভাবেই দীর্ঘসময় ধরে চলতে পারে না। তাদের যদি সঠিক এবং যথাযথ আর্থিক শিক্ষা অর্থাৎ ফাইন্যান্সিয়াল লিটারেসি থাকত তাহলে কোনোভাবেই এ ধরনের প্রতারণার ফাঁদে পা দিতেন না তারা। কারণ যথার্থ আর্থিক শিক্ষায় শিক্ষিত একজন ব্যক্তি যে কোনো ধরনের বিনিয়োগের আগে তার নানা বিষয় ভালোভাবে খতিয়ে দেখে, বিচার বিশ্লেষণ করে এর ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা এবং সম্ভাব্য ঝুঁকিগুলো যাচাই করে তারপর সে অনুযায়ী পা ফেলবেন- এটাই স্বাভাবিক। এর আগে আমাদের দেশে গত প্রায় দুই দশক যুবক আইটিসিএল, ইউনিপে টু, ডেসটিনি ২০০০-সহ অসংখ্য এমএলএম কোম্পানির লাগাতার প্রতারণার শিকার হয়ে অনেক মানুষকে সর্বস্বান্ত হতে দেখেছি। সেই প্রতারণার ঘটনাগুলো থেকে শিক্ষা না দিয়ে আবারো ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর সাম্প্রতিক জালিয়াতি, প্রতারণার ফাঁদে পা রেখেছেন অগণিত মানুষ। তারা সবাই অশিক্ষিত কিংবা মূর্খ নন। পড়ালেখা জানা হলেও তাদের যথার্থ আর্থিক শিক্ষা অর্থাৎ ফাইন্যান্সিয়াল লিটারেসি না থাকায় এমনটি ঘটেছে। তাদের অসতর্কতা, অজ্ঞতা, অসচেতনতার সুযোগে কিছু অসাধু প্রতারক চক্র হাতিয়ে নিয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা। ফাইন্যান্সিয়াল লিটারেসি অবশ্যই তাদের জ্ঞানী এবং অবগত করত- যা তাদের প্রতারণার ফাঁদে পা দেয়া থেকে বিরত রাখত। এর পাশাপাশি তাদের সতর্ক ও সচেতন করত পুরোদমে। সমাজ সভ্যতার পরিবর্তন ঘটছে খুব দ্রুত। আর এই পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডেও নানা পালাবদল ঘটছে। আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও বদলে গেছে। বলা যায়, অনেক ক্ষেত্রে সহজ সাবলীল হয়েছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে আধুনিক কলাকৌশলের প্রয়োগে অনেকটা টেকনিক্যাল হয়ে উঠেছে। ৫০ কিংবা ১০০ বছর আগের মতো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কিছু নির্ধারিত বলয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। আধুনিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যাংক, বিমা এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান নানাভাবে মানুষকে আর্থিক সেবা দিয়ে যাচ্ছে। মানুষ আজকাল এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে এড়িয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি-বাকরি, কোনোটাই করতে পারে না। অতীতে একজন মানুষ ব্যাংকে না গিয়ে জীবন চালিয়ে নিতে পারলেও এখন তা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আর এই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে সঠিক, নিরাপদ, লাভজনক এবং স্থিতিশীল রাখার জন্য নানা ধরনের আর্থিক জ্ঞান থাকা জরুরি হয়ে উঠেছে। যার ফলে এখন আর্থিক শিক্ষা বা ফাইন্যান্সিয়াল লিটারেসি বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে সবার জন্য। সঠিক আর্থিক জ্ঞান না থাকায় এখন অনেকের জন্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড দারুণ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ব্যাংকিং কর্মকাণ্ড, ব্যবসা-বাণিজ্য, দৈনন্দিন আর্থিক লেনদেন প্রভৃতিতে আর্থিক শিক্ষা মানে ফাইন্যান্সিয়াল লিটারেসির যথার্থ প্রয়োগ এবং গুরুত্বের বিষয়টি এখন সবাই উপলব্ধি করছেন। ব্যাংকে হিসাব খোলা, আর্থিক লেনদেন করা থেকে শুরু করে বিভিন্ন সঞ্চয়ী স্কিমে টাকা জমা করার মাধ্যমে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন এবং তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সব কিছুতেই আর্থিক নানা কৌশল জানা থাকা প্রয়োজন। যার অভাবে ব্যাংকে নিজের জন্য মানানসই লাভজনক সঞ্চয় স্কিমটি নির্বাচন করতে গিয়ে অনেকেই বিভ্রান্তিতে পড়ছেন। আবার কেউ ভুল পথে পরিচালিত হয়ে অহেতুক আর্থিক গচ্চার শিকার হচ্ছেন। সঠিক আর্থিক শিক্ষা বা জ্ঞানের অভাবে আমাদের দেশে প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ নানাভাবে প্রতারকদের খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব খোয়াচ্ছেন। মাঝে মধ্যে পত্র-পত্রিকায় সমবায় সমিতি, মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কোম্পানির নামে বিভিন্ন প্রতারক চক্রের লোভনীয় ফাঁদে পড়ে কোটি কোটি টাকা হারিয়ে সহজ-সরল সাধারণ মানুষের নিঃস্ব রিক্ত হয়ে যাওয়ার খবর প্রকাশিত হয়। ফাইন্যান্সিয়াল লিটারেসির চর্চা থাকলে প্রতারক চক্র এভাবে সহজ-সরল সাধারণ মানুষকে নয়ছয় বুঝিয়ে, অবিশ্বাস্য মুনাফার লোভ দেখিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার সুযোগ পেত না কোনোভাবেই। শেয়ার বাজারে না বুঝে, না জেনে স্রেফ হুজুগে মেতে রাতারাতি অনেক টাকার মালিক হয়ে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে নিজের সর্বস্ব ভিটেমাটি সম্বল বিক্রি করে, বন্ধক রেখে, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেছিল অনেকেই। ন্যূনতম আর্থিক শিক্ষা অর্থাৎ ফাইন্যান্সিয়াল লিটারেসি থাকলে এভাবে আত্মঘাতী আর্থিক কর্মকাণ্ডে কেউ কোনোভাবেই লিপ্ত হতেন না। আজো শেয়ার ব্যবসায় সর্বস্ব হারানো অনেক মানুষ চরম দুরবস্থা এবং অসহায়ত্বের মধ্যে দিনযাপন করছেন। তাদের দীর্ঘশ্বাস আর আর্তনাদে বুক ভারি হয়ে ওঠে সবার। নিজেদের অজ্ঞতা এবং অসতর্কতার কারণেই তারা ভুল পথে পরিচালিত হয়েছিলেন, এটা এখন ঠিকই উপলব্ধি করছেন। যদি আর্থিক শিক্ষার যথার্থ বিকাশ ঘটত এখানে তাহলে এত বড় বিপর্যয়ের শিকার হতে হতো না হতভাগ্য মানুষগুলোকে। এসব কারণেই এখন ফাইন্যান্সিয়াল লিটারেসির গুরুত্ব এবং এর যথার্থ প্রয়োগ নিয়ে সবাই ভাবছেন। ফাইন্যান্সিয়াল লিটারেসির জন্য বাণিজ্য কিংবা হিসাব বিজ্ঞান কিংবা অর্থনীতি, ব্যবসা প্রশাসন বিষয়ে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ডিগ্রির প্রয়োজন নেই। আর্থিক লেনদেনকে নিরাপদ, নিশ্চিত, লাভজনক এবং টেকসই করতে কিছু ন্যূনতম জ্ঞান থাকা জরুরি সবার। আর এটাকেই ফাইন্যান্সিয়াল লিটারেসি বা আর্থিক শিক্ষার ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। আর ফাইন্যান্সিয়াল লিটারেসির যথার্থ বিকাশ হলে ব্যাংকিং খাত, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য, খুচরা-পাইকারি ব্যবসা সবই নিরাপদ হয়ে উঠবে, এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। গত এক দশকে যে সব আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে আমাদের ব্যাংকিং খাতে, তার পেছনেও আর্থিক শিক্ষার অর্থাৎ ফাইন্যান্সিয়াল লিটারেসির অভাবকে দায়ী করা যেতে পারে অনেকাংশে। ব্যাংকারদের মধ্যে কারো কারো যথার্থ আর্থিক শিক্ষা ও বুদ্ধিমত্তার অভাব হলমার্ক, বিসমিল্লাহ, বেসিক ব্যাংকের লোপাট কেলেঙ্কারির ঘটনাগুলোর জন্য অনেকটাই দায়ী। এটা অনেক আর্থিক বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষক মন্তব্যও করেছেন। আর্থিক অন্তর্ভুক্তির (ফাইন্যান্সিয়াল ইনক্লুশন) ব্যাপারে গত ১০ বছরে যেভাবে জোরদার কার্যক্রম চালানো হয়েছে এর পাশাপাশি যদি সমানভাবে ফাইন্যান্সিয়াল লিটারেসির প্রসারের বিভিন্ন কার্যক্রম চালানো হতো তাহলে ফাইন্যান্সিয়াল ইনক্লুশন বা আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারটি টেকসই হতো। যদি সমাজের বিভিন্ন স্তরে অর্থনৈতিক সাক্ষরতা বা ফাইন্যান্সিয়াল লিটারেসির যথাযথ বিকাশ ঘটত তাহলে আজকের বাংলাদেশ যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার চেয়ে আরো অনেক দূর সামনে এগিয়ে যেতে পারত অনায়াসেই। অর্থনীতির মূলধারার বাইরে রয়েছেন যারা তারাও শামিল হতে পারতেন এর সুফল হিসেবে। এখনো ব্যাংকিং কর্মকাণ্ডের বাইরে রয়েছেন সমাজের বিরাট একটি অংশের মানুষ। ফিন্যান্সিয়াল লিটারেসি তাদেরকে খুব সহজেই ব্যাংকিং কর্মকাণ্ডে উদ্ধুদ্ধ এবং উৎসাহী করে তুলতে পারে। বিশ্বব্যাপী আজ ফাইন্যান্সিয়াল লিটারেসির ধারণাটি বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বিশেষ করে দুনিয়াজুড়ে আর্থিক মন্দা দূরীকরণে এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য অর্থনৈতিক সাক্ষরতা বা ফাইন্যান্সিয়াল লিটারেসি দারুণ গুরুত্বপূর্ণ উপায় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সম্পদের সুষম বণ্টন, ধনী-দরিদ্রের আয় বৈষম্য প্রভৃতি দূরীকরণে প্রত্যেককে সচেতন এবং সচেষ্ট করে তুলতে বর্তমান সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ফাইন্যান্সিয়াল লিটারেসির কোনো বিকল্প নেই। রেজাউল করিম খোকন : সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App