×

মুক্তচিন্তা

আমাদের সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৬ অক্টোবর ২০২১, ০১:৫৭ এএম

‘আমাদের সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ সংঘটির অন্যতম উদ্যোক্তা আশুতোষ ভট্টাচার্য। ১৯৭৪-এ এর প্রস্তুতি সভায় সভাপতিত্ব করেন সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর রমেশচন্দ্র মজুমদার। তাদের প্রকাশনাটিরও সম্পাদক আশুতোষ ভট্টাচার্য। মেধাবী ছাত্র মেধাবী লেখক আশুতোষের জন্ম বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জে। ১৯২৬-এ কিশোরগঞ্জ থেকে ম্যাট্রিকুলেট এবং ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে ১৯২৮-এ আইএ পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত ও বাংলা অনার্সে ভর্তি হন। তিনি ১৯৩১ সালে অনার্সসহ বিএ এবং ১৯৩২ সালে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই পিএইচডি। ‘আমাদের সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’-এর সম্পাদক হিসেবে তিনি লিখেছেন : ‘ঢাকার রমনায় ছাত্র এবং শিক্ষক জীবনের যে নিরুপদ্রব পরিবেশ গড়িয়া উঠিয়াছিল, কোলাহলময় এবং সমস্যা-জর্জর কলিকাতা শহরে তাহার অবকাশ কোথায়… একদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাহা ছিল, তাহা আজ ফিরিয়া পাইবার উপায় নাই। আজ যেখানে ছাত্র এবং শিক্ষকের মধ্যে নিয়ত হানাহানি চলিতেছে সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সে যুগের ছাত্র শিক্ষক সম্পর্কের কথা কাহাকেও বুঝাইয়া বলা যাইবে না।’ অতঃপর উপসংহার টেনেছেন : ‘সুতরাং প্রাচীন ভারতের তক্ষশীলা, বিক্রমশীলা, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় যেমন লুপ্ত হইয়া গিয়াছে, তাহার কীর্তিটুকু এখনো আছে, তাহাও ক্রমে বিলুপ্ত হইয়া যাইবে। সুতরাং তাহাকে পুনরুজ্জীবিত করা যাইবে না- একমাত্র স্মৃতিচারণা ব্যতীত আর কোনো উপায় নাই।’ আশুতোষ ভট্টাচার্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলেও বার্ষিক প্রকাশনা বাসন্তিকা (জগন্নাথ হল), শতদল (ঢাকা হল), সলিমুল্লাহ মুসলিম হল বার্ষিকী (সলিমুল্লাহ মুসলিম হল), ছাত্রীদের সুপর্ণা এবং ঢাকা ইউনিভার্সিটি জার্নাল নিয়ে লিখতে গিয়ে কিছু স্মৃতিচারণও করেন। জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট, আইন বিভাগের প্রধান এবং খ্যাতনামা সাহিত্যিক নরেশচন্দ্র সেনগুপ্তের উদ্যোগ ও সম্পাদনায় ১৯২৯ সালে বাসন্তিকা প্রকাশিত হয়। বাসন্তিকার প্রথম সংখ্যার লেখকদের মধ্যে রয়েছেন : রমেশচন্দ্র মজুমদার (গবেষণামূলক প্রবন্ধ : বহির্ভারতে ভারতীয় সভ্যতা), হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (আলোচনা : বাঙ্গালা সাহিত্য), পরিমল রায় (আলোচনা : পল্লী সমস্যা), নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত (গল্প : একা), নরেন্দ্রমোহন রায় (গবেষণামূলক প্রবন্ধ : মধ্য এশিয়ার ভারতীয় সভ্যতা), কবিতা লিখেছেন : প্রতিপ্রসন্ন ঘোষ, উমা প্রসন্ন দে, রথীন্দ্র কুমার গুহরায় ও ভূপেন্দ্রচন্দ্র হাজরা ও সুশীল রায়, ক্ষিতীশচন্দ্র চৌধুরী, হেরম্ব ভট্টাচার্য, মলয় রায়। নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত যে ভালো চিত্রশিল্পীও ছিলেন বাসন্তিকা তার স্বাক্ষর বহন করছে। ঢাকা হলের শতদল প্রকাশিত হয়েছে প্রথম প্রভোস্ট ডক্টর জ্ঞানচন্দ্র ঘোষের উদ্যোগ ও প্রেরণায়। তিনি চলে যাওয়ার পর এই দায়িত্ব পালন করেন বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু। সুপর্ণার প্রথম সংখ্যায় দীর্ঘ মুখবন্ধ লিখেছেন ভাইস চ্যান্সেলর রমেশচন্দ্র মজুমদার। রসহীন রসায়ন ১৯২৭-এ রসায়ন শাস্ত্রের অনার্স ক্লাসে ভর্তি হলেন সুনীল দাস। রসায়নে শুরুতে রস থাকলেও বিষয়টি রসালো নয়; কিন্তু জ্ঞানচন্দ্র ঘোষের মতো আচার্য যদি হয় রসায়নের শিক্ষক তাহলে চুম্বকার্ষণের মতোই তিনি টেনে রাখেন তার ছাত্রছাত্রীদের। রসায়নের পাঠ দিয়েছেন ডক্টর জে কে চৌধুরী, ডক্টর সর্বানীসহায় গুহ, পদার্থ বিজ্ঞান শিখিয়েছেন অধ্যাপক কৃষ্ণান, গণিতের শিক্ষক এম এন বসু, ডি এন গাঙ্গুলী। অধ্যাপক গাঙ্গুলী জীবন নৈর্ব্যক্তিক, যেন ব্ল্যাকবোর্ডের সঙ্গেই কথা বলতেন। ‘আচার্য সত্যেন্দ্রনাথকে (সত্যেন বসু) ছাত্রজীবনের প্রথমটায় মনে হয়েছে একজন আত্মমগ্ন দ্বৈপায়ন পুরুষ। কিন্তু অল্পকালের মধ্যেই এই আত্মমগ্ন মানুষটির নৈর্ব্যক্তিক পরীক্ষা ডিঙ্গিয়ে ছাত্ররা তার অন্তরঙ্গ হয়েছেন, ‘তুমি’ থেকে ‘তুই’ সম্বোধনে মর্যাদা অর্জন করেছেন। ১৯২০’র দশকেই ঢাকায় ‘সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার লিগ’ আত্মপ্রকাশ করে। এর বহিরঙ্গে সমাজসেবার কথা এবং বেশ কিছু কাজ থাকলেও অন্তরঙ্গে ছিল বিপ্লবের দাবানল। জেনেশুনে কিংবা না জেনে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট শিক্ষক ও ছাত্রদের কেউ কেউ এর সঙ্গে জড়িত হয়েছেন। এমন সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে যান সুনীল দাসও। জড়াবেন না কেন- এই প্রথম সভাপতি তো ছিলেন অধ্যাপক জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ। সম্পাদক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক মেধাবী ছাত্র অনিল রায়। এই সংগঠনেরই বাংলা নামায়ন হল শ্রীসংঘ। সুনীল দাস লিখেছেন, ‘আমার এমএসসির গবেষণাপত্র প্রস্তুতির বছরের দিনগুলো আমলাপাড়ার মাঠে, সার্পেন্টাইন লেকের ধারে রাত্রির অন্ধকারে, ‘শ্রীসংঘের বিপ্লবী নেতাদের সঙ্গে গোপন বৈঠকে আকীর্ণ হয়ে রয়েছে।’ তবু ভাগ্য সুনীল দাস পরীক্ষা শেষ করেছেন, ফলও প্রকাশিত হয়েছে কিন্তু এর পরপরই তার গবেষণা জীবনে ছেদ পড়ল। জীবনের খাত বদলে গেল- গ্রেপ্তার, কারাবাস, বহিষ্কার বন্দিনিবাস ভিন্ন এক পরিক্রমায়। ২১ জুলাই ১০৩০ (আইন অমান্য) আন্দোলনের ডাকে কার্জন হলের গেটের বিপরীত দিকে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজের গেটে পিকেটিং চলছে। পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট হডসন সাহেবের নির্দেশে পাঠান পুলিশ কার্জন হল চত্বরে প্রবেশ করে বেপরোয়া লাঠিচার্জ করে। একটি ছেলে অজ্ঞান হয়ে পড়লে একটি ছেলেকে তুলে ফিজিক্যাল ল্যাবরেটরিতে আনা হলো। তারপর হাসপাতালে নেয়ার পথে তার মৃত্যু ঘটল। অজিত নামের ছেলেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য সেদিনই ঢাকায় এসেছিল। ছাত্ররা লাশ নিয়ে যাতে মিছিল করতে না পারে সে জন্য রাতের অন্ধকারে পুলিশের সাহায্যে অজিতের শেষকৃত্য সম্পাদন করে। পরদিন ছাত্ররা কালোব্যাজ ধারণ করলেন, হরতাল পালিত হলো শহরে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকল। সুনীল দাস অনেক ভুগেছেন, তারপরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনকে তিনি এবং তার মতো আরো অনেকেই স্বাদেশিকতার সঙ্গে উচ্চশিক্ষার সমন্বিত জীবন হিসেবেই দেখেছেন- এ জীবন তাদের ঝড়-ঝঞ্ঝা ও সংগ্রামের মুখোমুখি দাঁড়াতে প্রস্তুত করে দিয়ে গেছে। গগণেন্দ্রনাথ ঠাকুর বিদ্রুপ কষাঘাতে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে নেহায়েত গ্র্যাজুয়েট তৈরির কারখানা বলে ছবি এঁকেছিলেন। এটা অমলেন্দু বসু বেশ মনে রেখেছেন। অমলেন্দু ঢাকা শহরেরই বাসিন্দা, আরমানিটোলার ক’জন তরুণকে নিয়ে সপ্তাহে চারদিন সাঁতার কেটে বুড়িগঙ্গা পার হন; ফুটবল ক্রিকেটের কথা শুনলেই খেলার মাঠে ছোটেন আবার একই সঙ্গে ‘শ্রীসংঘের নিয়মনিষ্ঠায় নিগড়াবদ্ধ হয়ে ভবেশ নন্দী, সত্য গুপ্ত, ভুপেন রক্ষিত, অনিল রায় প্রমুখ ব্যক্তিত্বের কাছে সমর্পিত প্রাণ’। জগন্নাথ ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে পাস করে ১৯২৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে কিছুকাল কাটাবার পর বুঝতে পারলেন এটা নেহায়েত গ্র্যাজুয়েট তৈরির কারখানা নয়- ‘এখানে জ্ঞান-বিজ্ঞানের নিরন্তর সাধনা চলে, এখানে ব্যক্তিত্বের বিকাশের সংযত বিকাশের অমূল্য সুযোগ… সহসা বোধ করলাম এখানে এসেছি কতকগুলো সুদৃশ্য ও বিশাল হর্ম্যে বিচরণ করার জন্য নয়, এসেছি সর্বজন-অবলম্বিত সমাজ-জীবনের ঊর্ধ্বে এক অন্তহীন আলোকিত মনোজগতে বিচরণ করার জন্য। সহসা যেন আমার অনভিজ্ঞ, আদর্শ-সন্ধানী তরুণ সত্তায় অনুভব করলাম একটি বিরাট দায়িত্ব।’ প্রথমে ছাত্র হয়ে এবং তারপর শিক্ষক হয়ে এই দায়িত্ব পালনের অনির্বাণ সন্তোষ উপভোগ করেছেন। ছাত্র ও শিক্ষকের পঞ্চধারা অমলেন্দু বসু বললেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেক্কা অব দ্য ইস্ট যেমন নয়, তেমনি অক্সফোর্ড অব দ্য ইস্টও নয়। ১৯২৬ থেকে ১৯৪৮ অমলেন্দু বসু তার ‘ছাত্রজীবন ও শিক্ষকজীবনে অমুসলমান ছাত্রদের খেলাধুলা, বিদ্যাচর্চা, সামাজিক জীবন কোনো সঙ্কুচিত ছিল বলে মনে করেন না। তবে পিছিয়ে পড়া মুসলমান এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বী তপশিলভুক্ত সম্প্রদায়ের ছাত্রদের বিদ্যোৎসাহী করার জন্য বিশেষ অর্থ সাহায্য ছিল। তিনি উল্লেখ করেছেন, সায়েন্স ও কমার্স ফ্যাকাল্টিতে সম্ভবত মুসলমান কোনো শিক্ষক ছিলেন না; উর্দু আরবি ও ফার্সি বাদ দিলে তিনি কেবল তিনজন মুসলমান শিক্ষকের কথা স্মরণ করতে পারেন- ইতিহাসের আহমদ ফজলুর রহমান, ইংরেজির মাহমুদ হাসান এবং বাংলা ও সংস্কৃতের মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। অমলেন্দু বসু লিখেছেন, আচার্য সত্যেন বোসের যে নিরভিমান মহত্ত্ব তা যে কোনো কালে যে কোনো স্থানে বিরল। তিন তরুণ শিক্ষক অমিয় দাশগুপ্ত, ধীরেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলি এবং অক্ষয় ঘোষাল এক বাড়িতে থাকতেন, সে বাড়িতে অমলেন্দুদের ছিল অবাধ যাতায়াত। কেবল বিএ ডিগ্রিধারী চারু বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন প্রকৃত পণ্ডিত; মোহিতলাল মজুমদারও ছিলেন সাদাসিধে বিএ ডিগ্রিধারী- কিন্তু কাব্য ও সমালোচনায় তার মহার্ঘ অবদান তো সুবিদিত। অর্থনীতিতে এম এ হয়েও বাংলা পড়িয়েছেন কাজী আবদুল ওদুদ- অপ্রথাগত বিষয় বিবেচনা করার উদারতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছিল। তিনি নিজে যখন শিক্ষক মহাযুদ্ধের বছরগুলোতে অমলেন্দু বসুর বাড়িতে তার যেসব ছাত্রের খুব আসা-যাওয়া ছিল তাদের মধ্যে যাদের নাম মনে করতে পারছেন তারা হচ্ছেন : জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, সুনীল চৌধুরী, সরদার ফজলুল করিম, সরওয়ার মুর্শেদ, সুবিমল মুখার্জি, সানাউল হক প্রমুখ। অমলেন্দু বসু মনে করেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃহৎ যৌথ পরিবারে চারটি ক্রস-কারেন্ট ছিল। প্রথমত, শিক্ষক ও ছাত্র; তাতে হিন্দু বৌদ্ধ মুসলমান, খ্রিস্টান, স্ত্রী-পুরুষ; বাঙালি-অবাঙালি বিভাজন ছিল। অবাঙালি অধ্যাপকদের কয়েকজন যেমন গণিতের বিজয় রাঘবন, পদার্থ বিজ্ঞানের কৃষ্ণান, অর্থনীতির পাঞ্চণ্ডিকার, কমার্সের জুন্নারকার, প্রমুখ। দ্বিতীয় হলকেন্দ্রিক ছাত্র ও শিক্ষক; আন্তঃহল লড়াইটা হতো নিজেদের মর্যাদার লড়াই। তৃতীয় স্রোতে বিভাগের প্রতি আনুগত্য। যেমন অমলেন্দু বসু বার্ধক্যেও দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ ‘ভারতীয় উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে অতীব উঁচুস্থান অধিকার করেছিল। তিনি তখন আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রধান, তার এক ‘শ্রদ্ধাভাজন ধূর্জটি-দা প্রায়ই বলতেন, দেখ অমল, তোমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফার্স্ট রেট ছেলেমেয়ে বেরিয়েছে। আমি অবশ্য প্রত্যুত্তর করতাম, আপনি ইদানীং বুঝেছেন এ কথা, কিন্তু আমরা ছাত্রকাল থেকেই সে বিষয়ে নিঃসংশয়।’ তিনি যে চতুর্থ স্রোতের কথা বলেছেন তা হচ্ছে অনাবাসী ছাত্রদের একান্ত এলাকা- যেমন কলতাবাজার বনাম শাঁখারীবাজার কিংবা ওয়ারি বনাম ভিক্টোরিয়া। তিনি একটি পঞ্চম স্রোতের কথাও বলেছেন- তা হচ্ছে সাহিত্যমুগ্ধ ছাত্র ও শিক্ষক- এই দলে অমলেন্দু বসু ছিলেন- এটা বুদ্ধদেব বসুকেন্দ্রিক সাহিত্যচক্র। গুপ্ত সংগঠনের সদস্য বীরেন্দ্রকুমার সাহা ১৯৩৪ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে বিজ্ঞানের বিষয় নিয়ে আইএ পাস করে বিজ্ঞানে সাধারণ একটি স্নাতক করবেন বলে ইন্টারভিউ দিতে এলেন। ঢাকা হলের প্রভোস্ট এবং বিখ্যাত রসায়নবিদ ডক্টর জ্ঞানচন্দ্র ঘোষের সামনে হাজির হতে হবে। তার সহকারী সদা হাসিমুখ কালীবাবু, খগেন্দ্রনাথ কালী। সামরিক ঢঙ-এ প্রার্থীদের একে একে ডক্টর ঘোষের সামনে হাজির করছেন। ‘ঘরে ঢুকেই দেখলাম ইংরেজি পোশাকে সজ্জিত, সৌম্যদর্শন, ¯িœগ্ধ, ধীর ও দীপ্তিমান এক ব্যক্তি। কতকটা উত্তেজনায়, কতকটা ভয়ে ভয়ে ঘরে ঢুকেছি, একে দেখে যেন সে ভাবটা আরো বেড়ে গেল।’ তার আবেদন ও পরীক্ষার ফলাফল হাতে নিয়ে ডক্টর ঘোষ বললেন, রেজাল্ট ভালো তাহলে পাস কোর্স কেন? কেমেস্ট্রি ভালো না লাগলে ফিজিক্স-এ অনার্স পড়ো। তাই হলো, সরাসরি বিজ্ঞানতাপস সত্যেন বসুর ছাত্র হবেন, এর চেয়ে বড় ভাগ্য আর কী হতে পারে! তাকে দেখার জন্য ক’দিন এদিক ওদিক অপেক্ষা করে একদিন সত্যিই দেখলেন ‘ধুতি পাঞ্জাবি পরিহিত এই মহান পুরুষ- হাতে একটা সিগারেটের টিন- ধীর পদক্ষেপে কার্জন হলের অফিস ঘরে আসছেন।’ তিনি তার প্রণম্য ক’জন শিক্ষকের কথা বলেছেন : পদার্থ বিজ্ঞানের ডক্টর কেদারেশ্বর ব্যানার্জীর আচরণে তার মনে হয়েছে ছাত্ররাই যেন তার অভিভাবক; হাতে পোর্টফোলিও ব্যাগ, সদাগম্ভীর স্বল্পবাক ডক্টর সুধীররঞ্জন খাস্তগীর সম্পর্কে তাদের অন্তহীন আগ্রহ; ইংরেজির অধ্যাপক ডক্টর সত্যেন্দ্রনাথ রায় এতটাই বিনয়ী এবং এমনই অমায়িক ব্যবহার ছাত্ররাই অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে; একমাত্র নারী শিক্ষক চারুপমা বসুর সামনে গেলে ভালোমন্দ দূরন্ত ডানপিঠে সব ছাত্র মাথা নত করে আনে। রমেশচন্দ্র মজুমদারের বক্তৃতা শ্রোতাদের জাদুমুগ্ধ করে রাখে। বীরেন্দ্রকুমার সাহা একটি বড় স্বীকারোক্তি করলেন : বিশ্ববিদ্যালয়ে নাম লিখিয়েছেন যতটা না পড়াশোনার জন্য তার চেয়ে একটি রাজনৈতিক দল সংগঠনে সাহায্য করতে। তিনি অল্প বয়স থেকেই একটি আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত। প্রথম বছর ভালোই কাটল, দ্বিতীয় বছর ধরা পড়ে গেলেন এবং পুলিশের হেফাজতে গৃহ অন্তরীণ থাকলেন, তারপর পুরোপুরি অন্তরীণ। ছাড়া পেয়ে ১৯৩৭-এ ফিরে এলেন ঢাকা হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৩৮-এর ছাত্র ইউনিয়ন নির্বাচনে জড়ালেন। ছুটির সময় হল বন্ধ রাখার সনাতন চর্চার বিরুদ্ধে তিন হল (জগন্নাথ, মুসলিম ও ঢাকা) সংগঠিত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে প্রথম সর্বাত্মক আন্দোলন গড়ে তুললেন। লাভ হলো একটি সংবিধান প্রাপ্তি, শিক্ষার্থীদের অধিকারের স্বীকৃতি এবং নির্বাচন ঘোষণা। তখনকার ছাত্র অশোক কুমার বললেন বীরেন্দ্রকুমার হয়ে উঠলেন নির্বাচনের কিং মেকার। ১৯৩৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নে অনার্স নিয়ে পড়তে আসা অশোক কুমার রায় চৌধুরী একবার বরোদায় এক পূজার মজলিশে পরিচিত হলেন বরোদার মহারাজা সয়াজীরাও বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিগরি ফ্যাকাল্টির ডিন ডক্টর এস এন সেনের সঙ্গে। কথায় কথায় বেরিয়ে এলো তিনি প্রফেসর সত্যেন বসুর ছাত্র। ১৯৩৮-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞানে অনার্স পড়তে আসেন। অশোক কুমার অবাক হন তাদের সাক্ষাতের ২৬ বছর আগে তিনিও তো একই বছরে রসায়নে অনার্স ক্লাসে ভর্তি হয়েছেন- অথচ কেউ কাউকে মনে করতে পারছেন না, কিন্তু তাদের দু’জনের অনেক স্মৃতিই কমন, মানে মিলে যাচ্ছে। অশোক কুমার ১৯৪১ সালে রসায়ন ছেড়ে কৃষিবিজ্ঞানে বিএসসি পাস করলেন। তারপর এলেন মনিপুরে স্থাপিত ঢাকা থেকে ৫/৬ মাইল দূরের কৃষি কলেজে এবং হোস্টেল প্রথম ম্যাচের ১৯ ছাত্রের তিনি একজন। হোস্টেলের নৈঃসঙ্গ কাটাতে একটি রেডিও চাই। স্কটিশ প্রিন্সিপাল মিস্টার ক্লার্ক আসলে হাড়কিপ্টে স্কটিশ। তিনি হাত গুটিয়ে বসে থাকলেন। ভাইস চ্যান্সেলর রমেশচন্দ্র মজুমদার কৃষি কলেজের কাছাকাছি একটি স্কুলের উদ্বোধন করতে এলে অন্য ছাত্ররা উপাচার্যের রোষ এড়াতে অশোককেই পাঠান- একটি রেডিও চাইতে হবে। উপাচার্য রেডিওর অর্ধেক দাম মঞ্জুর করলেন। বাকিটা নিজেদের জোগাতে হবে। অশোক কুমার সাইকেলে টো টো করে ঘুরে বেড়ান। জীববিজ্ঞান বিভাগের ডক্টর পঞ্চানন মহেশ্বরী জানালা দিয়ে দেখতে পেয়ে ডাকলেন, বললেন ল্যাবরেটরির কাজ শেখো। তিনি শিখলেন মাইক্রোটোন টেকনোলজি। ঢাকার মিলিটারি ব্যারাকে চাকরিরত হকির জাদুকর হাবিলদার ধ্যানচাঁদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাথলেটিক্স ক্লাব তাকে সংবর্ধিত করতে রাতের খাবারে আমন্ত্রণ জানায়। কিন্তু ‘সামান্য হাবিলদার’ নিয়ে মাতামাতি ব্রিটিশ অধিনায়ক পছন্দ করেননি এবং তাকে ব্যারাক থেকে বেরোতে দেননি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে সৈন্যদের আবাসনের জন্য কলেজ আর হোস্টেল ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ এলে কলেজে ব্রিটিশ প্রিন্সিপাল আর কৃষি বিভাগের ব্রিটিশ ডিরেক্টর দর কষাকষি করে তাদের প্রতিষ্ঠান রক্ষা করলেন। আর কেউ দখল করতে না এলেও কলেজের কাছে তৈরি হলো অ্যারোড্রাম, মার্কিন ঘাঁটি। অশোক কুমার যখন স্মৃতিকথা লিখছেন তিনি জানেন না আদৌ সেই বেঙ্গল এগ্রিকালচারাল ইনস্টিটিউট আছে না নেই। ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে, নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App