×

জাতীয়

যুদ্ধাপরাধ বিচারে স্থবিরতা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ অক্টোবর ২০২১, ০৮:৪৯ এএম

* বাকি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এগিয়ে নিতে সরকারের আগ্রহ নিয়ে সংশয়!

* ট্রাইব্যুনালেও জনবল সংকট

২০১০ সালের মার্চে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর ৪২টি মামলার রায় হলেও কার্যকর হয়েছে মাত্র ছয়টি রায়। আর ২০১৫ সাল থেকে ঝিমিয়ে পড়া বিচার কার্যক্রম বর্তমানে একেবারে বন্ধ। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় থাকা ২৯টি মামলার মধ্যে গত চার বছরে শুনানি হয়েছে মাত্র একটির। জনবলের অভাবে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কার্যক্রমও অনেকটা স্থবির। পাকিস্তানি হাইকমান্ডের বিচারের বিষয়ে তদন্ত শেষ হলেও সেটিও আর বেশি দূর আগায়নি। রাজনৈতিক দল হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র বিরোধিতাকারী সংগঠন জামায়াতকে বিচারের মুখোমুখি করতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস আইন ১৯৭৩-এর সংশোধনের খসড়া প্রস্তুত থাকলেও অদৃশ্য কারণে তা গত সাত বছরেও মন্ত্রিসভায় ওঠেনি। ফলে দলটির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত হলেও বিচার শুরু করা যায়নি। এসব বিষয় বিশ্লেষণ করে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো বলছে, শীর্ষ কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীর রায় কার্যকরের পর এ বিচার এগিয়ে নিতে খোদ সরকারের মধ্যেই অনাগ্রহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ অবস্থায় তৃণমূল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা। অথচ সরকারের ঘোষণা ছিল, দেশে একজন মানবতাবিরোধী অপরাধী থাকা পর্যন্ত ট্রাইব্যুনালের কাজ চলবে।

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর আকাঙ্ক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারে ২০১০ সালের ২৫ মার্চ গঠন করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। প্রথম দিকে কয়েক বছর ট্রাইব্যুনাল যেভাবে আলোচিত ছিল, মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রে ছিল, সে আলোচনা, আগ্রহ বা উচ্ছ্বাস এখন ট্রাইব্যুনাল নিয়ে নেই। সাধারণ মানুষও আগের মতো রায়ের জন্য আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে না। এখন রায় হলে সংবাদমাধ্যমে গুরুত্বহীনভাবে খবর পরিবেশন হয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, এর একটা কারণ হতে পারে, আলোচিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ হয়ে গেছে। অনেকের দণ্ডও কার্যকর হয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষের আগ্রহ কমে গেছে। বর্তমানে বিচারে ধীরগতির বিষয়টি স্বীকার করে প্রসিকিউশন বিভাগসহ ট্রাইব্যুনাল-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে চাহিদা এখনো কমেনি। উল্টো তৃণমূল পর্যায়ের যুদ্ধাপরাধীদের মামলার চাপ রয়েছে। সেক্ষেত্রে একটি মাত্র ট্রাইব্যুনাল দিয়ে অথবা লোকবলহীন তদন্ত সংস্থা দিয়ে এত মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব নয়। এ অবস্থায় বিচারপ্রক্রিয়া স্থবির হয়ে পড়ায় বিচারপ্রার্থী ও মানবতাবিরোধীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে। বিচারপ্রক্রিয়া বিলম্বের কারণে সাক্ষ্যপ্রমাণ বিনষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ এ প্রসঙ্গে বলেন, করোনার কারণে অন্যান্য বিচারালয়ের মতো আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালেরও বিচার কাজের গতি কমে এসেছে। এর মধ্যে সেখানকার একজন বিচারক মারা গেছেন। এখন দ্রুত বিচারক ও জনবল নিয়োগের মাধ্যমে এ সংকট থেকে কাটিয়ে ওঠা প্রয়োজন। এটা পুরো জাতির চাওয়া।

২০১০ সালের ২৫ মার্চ গঠন করা একটি ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে বিচারকাজ শুরু হলেও ২০১২ সালের ২২ মার্চ আরেকটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। দুটি ট্রাইব্যুনাল একযোগে আড়াই বছর কাজ করে। এরপর ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর দুটি ট্রাইব্যুনালকে একীভূত করা হয়। ফলে ওই সময় থেকে এখন পর্যন্ত একটি ট্রাইব্যুনালেই বিচারকাজ চলছে। এ দুই ট্রাইব্যুনাল মিলে গত ১১ বছরে ৪২ মামলায় মোট সাজা দেয়া হয়েছে ১০৩ জনকে। এর মধ্যে মৃত্যুদণ্ড হয়েছে ৭১ জনের। কিন্তু বর্তমানে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালের দ্বিতীয় সদস্য বিচারপতি আমির হোসেন গত ২৪ আগস্ট মারা গেলে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় বিচারকাজ। এখনো শূন্য পদে কোনো বিচারক নিয়োগ দেয়া হয়নি। বর্তমানে ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন ৩৬টি মামলায় আসামির সংখ্যা ২৩৭। এ অবস্থায় একটি ট্রাইব্যুনালের পক্ষে বছরে ৪-৫টির বেশি মামলার বিচারকাজ সম্ভব হয় না। এই একটি ট্রাইব্যুনালে স্বাভাবিক গতিতে বিচার কাজ পরিচালিত হলে ৩৬টি মামলার বিচার শেষ করতে সময় লাগবে ৮ থেকে ১০ বছর।

এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার সাঈদ আহমেদ বলেন, বিচারপতি আমির হোসেন মারা যাওয়ার পর ট্রাইব্যুনাল আর পুনর্গঠন হয়নি। ফলে বিচার কার্যক্রম আপাতত বন্ধ রয়েছে। তবে প্রশাসনিক সব কার্যক্রম চলছে। ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠিত হলেই মামলার বিচারকাজ পুরোদমে শুরু হবে। এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, দ্রুতই ট্রাইব্যুনালে বিচারক নিয়োগ দেয়া হবে। এরপর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম স্বাভাবিক হবে বলে আশা করছি। ট্রাইব্যুনালের অন্যতম প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী বলেন, ভিআইপি মামলার যে গুরুত্ব থাকে, সে রকম গুরুত্ব তো অন্য মামলায় থাকে না। তখন শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে যে রকম পরিস্থিতি ছিল, প্রায় প্রতিটি রায়ের দিনই হরতাল থাকত। এখন তো সেই পরিস্থিতি নেই। তবে আমরা মনে করি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে চাহিদা এখনো কমেনি। আমাদের ওপর মামলার চাপ রয়েছে। সেক্ষেত্রে একটি ট্রাইব্যুনাল দিয়ে এত মামলার নিষ্পত্তি দ্রুত সম্ভব হয় না।

এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর তাপস কান্তি বলেন, একজন বিচারপতির মৃত্যুর কারণে ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজ সাময়িকভাবে বন্ধ আছে। তবে মামলার তদন্ত থেকে শুরু করে অন্য সব কার্যক্রম চলছে। করোনা মহামারির কারণে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটেছে। মহামারি পরিস্থিতি এখন উন্নতির দিকে। আশা করি নতুন বিচারক নিয়োগ হলে ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠিত করে দ্রুত বিচারকাজ শুরু করা হবে।

এদিকে তদন্ত সংস্থায় সাড়ে তিন হাজার আসামির বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত সাতশর মতো তদন্তযোগ্য অভিযোগ রয়েছে। এখনো অভিযোগ আসছে বলে তদন্ত সংস্থা সূত্রে জানা গেছে। অথচ পর্যাপ্ত লোকবলের অভাবে সংস্থার তদন্ত কার্যক্রমে স্থবিরতা বিরাজ করছে। তদন্ত সংস্থা সূত্র জানায়, এ পর্যন্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বেশ কয়েকবার লোকবল নিয়োগের জন্য লিখিত সুপারিশ দেয়া হলেও অদৃশ্য কারণে জনবল নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তাদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ রয়েছে।

তদন্ত কার্যক্রমের স্থবিরতা সম্পর্কে তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক এম সানাউল হক বলেন, আমাদের কার্যক্রম চলমান আছে। তবে যে পরিমাণ গতি নিয়ে কাজ করার কথা, লোকবলের অভাবে আমরা সেভাবে এগোতে পারছি না। এক বছর আগে লোকবল চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কয়েকবার লিখিত আবেদন দিলেও এখন পর্যন্ত আমাদের দাবি পূরণ হয়নি। এছাড়া ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা কম হওয়ায় বিচারের গতি অনেকটাই কমে গেছে। ফলে মামলা জমে যাচ্ছে। এছাড়া আপিল শুনানি হচ্ছে না। আপিল শুনানি না হলে তো মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয় না, রায়ও কার্যকর হয় না। এসব মামলার বাদী, বিবাদী, সাক্ষী- প্রায় সবারই বয়স ৭০ বছরের ঊর্ধ্বে। সবাই প্রত্যাশা করেন জীবদ্দশায় যেন বিচারটা দেখে যেতে পারেন। কারণ বিচার বিলম্ব হলে অনেক সাক্ষ্যপ্রমাণ হারিয়ে যাবে। ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা, প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থার লোকবল বাড়ানোর ওপর সরকারের সদিচ্ছা প্রত্যাশা করেন তিনি।

এদিকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাজাপ্রাপ্ত ২৯ যুদ্ধাপরাধীর বিচার গত কয়েক বছর ধরে আপিল বিভাগে ঝুলে আছে। এর মধ্যে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকা জামায়াত নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলাম ও জাতীয় পার্টির সাবেক মন্ত্রী সৈয়দ মো. কায়সারের রিভিউ আবেদনও আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায়। যুদ্ধাপরাধের মামলাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রায় তিন বছর ঝুলে থাকার পর ২০১৯ সালের শেষের দিকে আপিল শুনানিতে কিছুটা গতির সঞ্চার হয়। ওই সময়ে আপিল শুনানি শেষে জামায়াত নেতা এ টি এম আজহার ও সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। এরই মধ্যে দেশে আঘাত হানে করোনা ভাইরাস। বন্ধ হয়ে যায় আদালত। একই সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায় যুদ্ধাপরাধীদের আপিল শুনানি। তবে বর্তমানে ভার্চুয়ালি আপিল বিভাগের কার্যক্রম চললেও যুদ্ধাপরাধের মামলা শুনানি নিয়ে কোনো উদ্যোগ নেই।

এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, এখন তো আপিল বিভাগে রিভিউ শুনানি শুরু হয়েছে। আশা করছি দুই যুদ্ধাপরাধীর রিভিউ শুনানি ২১ অক্টোবর আদালত খোলার পর শুরু হবে। আপিল শুনানিতে বিচারক-স্বল্পতার প্রসঙ্গ তুলে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আগে আপিল বিভাগে দুটি বেঞ্চ ছিল। এ কারণে তখন আপিল দ্রুত নিষ্পত্তি হতো। এখন বিচারক-স্বল্পতার কারণে আপিল বিভাগের একটি বেঞ্চে বিচারকাজ চলছে। এ কারণে সময় লাগছে। পর্যায়ক্রমে যুদ্ধাপরাধীদের আপিল শুনানি শুরু হবে।

এ বিষয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সরকার দুটি ট্রাইব্যুনাল থেকে একটি করেছে। পরবর্তীতে আর ট্রাইব্যুনাল বাড়ানো হলো না। বর্তমানে তো বিচারই বন্ধ। আপিল বিভাগে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি মামলা ঝুলছে। জামায়াতের বিচার কেন হচ্ছে না? পাকিস্তানি হাইকমান্ডের বিচার করবেন না, কেন এসব হচ্ছে সেটা আইনমন্ত্রী ভালো বলতে পারবেন। সরকারের আগ্রহ থাকলে কি আর এমন হতো। তিনি বলেন, বিচারপতি এস কে সিনহা প্রধান বিচারপতি থাকা অবস্থায় যুদ্ধাপরাধীদের আপিল শুনানি বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এখনো এসব মামলার আপিল নিষ্পত্তিতে ধীরগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। আইনমন্ত্রী ও সংশ্লিষ্টদের কোনো উদ্যোগ দেখছি না। আমি মনে করি, শহীদদের আত্মার শান্তির জন্যই যুদ্ধাপরাধীদের আপিল দ্রুত নিষ্পত্তি প্রয়োজন। আমরা আগেও বলেছি, এখনো বলছি, মামলাজটের কারণে যদি আপিল বিভাগ যুদ্ধাপরাধীদের মামলা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুনানি করতে না পারেন, তাহলে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আরো বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হোক। তিনজন বিচারপতিকে দিয়ে ট্রাইব্যুনালের ভেতরেই খণ্ডকালীন আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন করা যেতে পারে। সেখানে তিন থেকে সাত দিনের মধ্যে যুদ্ধাপরাধ মামলার আপিল নিষ্পত্তি করা সম্ভব।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App