×

জাতীয়

বুড়িগঙ্গার তীর নিয়ে টানাপড়েন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৩ অক্টোবর ২০২১, ০৮:৪৭ এএম

বুড়িগঙ্গার তীর নিয়ে টানাপড়েন

সদরঘাট ঘিরে এমন দৃষ্টিনন্দন প্রকল্প পরিকল্পনা করে বিআইডব্লিউটিএ। অন্যদিকে নদী থেকে আহসান মঞ্জিল, লালকুঠি ও রূপলাল হাউস দৃশ্যমান করতে বিআইডব্লিউটিএকে সদরঘাট টার্মিনালের অংশবিশেষ সরাতে বলেছে ডিএসসিসি। তাই নিয়ে দুই সংস্থার টানাপড়েন। ফলে থেমে যায় সব উদ্যোগ -ছবি : বিআইডব্লিউটিএর গ্রাফিক্স ডিজাইন

বুড়িগঙ্গা তীরের বিভিন্ন প্রকল্প ও স্থাপনাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) মধ্যে টানাপড়েন তৈরি হয়েছে। দুই সংস্থাই নদীর তীরে প্রায় একই ধরণের উন্নয়ন কাজ করতে চায়। এর আগে সিটি করপোরেশনের আপত্তির মুখে প্রস্তাবিত কয়েক প্রকল্প থেকে সরে এসেছিল বিআইডব্লিউটিএ। কাটছাঁট করেছিল ওয়াকওয়ে নির্মাণ প্রকল্পেও। তবে সম্প্রতি ডিএসসিসি আহসান মঞ্জিল, লালকুঠি ও রূপলাল হাউজের সামনে থেকে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালের কিছু অংশ ও অন্যান্য স্থাপনা সরিয়ে নিতে বলায় জটিলতা দিকে মোড় নিয়েছে। এতে যাত্রী ও পণ্য পরিবহণে সংকট দেখা দেবে বলে মনে করছে বিআইডব্লিউটিএ। আর সিটি করপোরেশন বলছে, ঐহিত্য সংরক্ষণে এর কোনো বিকল্প নেই।

গত ২৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ফজলে নূর তাপস পুরান ঢাকার লালকুঠি ভবন পরিদর্শনে যান। এ পরের দিনই দুটি চিঠি দেয়া হয় বিআইডব্লিউটিএকে। অতিরিক্ত সচিব ফরিদ আহমেদ স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে ‘অনতিবিলম্বে’ লালকুঠি, রূপলাল হাউজ ও আহসান মঞ্জিলের সামনে থেকে সদরঘাট টার্মিানাল ও অন্যান্য স্থাপনা সরানোর অনুরোধ জানানো হয়। এর আগে গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বরও লালকুঠি ভবন পরিদর্শনে গিয়ে দক্ষিণের মেয়র ফজলে নূর তাপস সদরঘাট টার্মিনালের কিছু অংশ অপসারণের কথা বলেছিলেন।

চিঠিতে বলা হয়, মোঘল নির্মাণশৈলী ও কৌশল অবলম্বনে ১৮৭২-১৮৭৯ সালে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে হ্যারিটেজ ভবন নর্থব্রুক হল (লালকুঠি) নির্মিত হয়। ১৯৬২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি এ ভবনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ঢাকা পৌরসভার পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। এক সময় এ ভবনের সৌন্দর্য্য নদী থেকে দেখা যেত। কিন্তু স্থাপনা নির্মাণের ফলে এখন আর সেটি দেখা যায় না। পার্শ্ববর্তী রাস্তা, ভাসমান হকার, কুলি ও মালামাল বহনকারী পরিবহনের কারণে এর পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। লালকুঠি সংস্কারে একটি প্রকল্প নেয়া হয়েছে জানিয়ে এতে বলা হয়, শিগগিরই ভবনের চারপাশে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হবে। ভবনটি নদী থেকে দৃশ্যমান হওয়ার জন্য বিআইডব্লিউটিএর টার্মিনালসহ অন্যান্য স্থাপনা অপসারণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন মেয়র। তাই অবিলম্বে যেন সেগুলো স্থানান্তর বা অপসারণ করা হয়। আরেক চিঠিতে ১১ নম্বর ফরাশগঞ্জের রূপলাল হাউজ ও সদরঘাটের পশ্চিমে আহসান মঞ্জিলের সামনের স্থাপনাগুলো সরিয়ে নেয়ার অনুরোধ জানানো হয়।

সিটি করপোরেশন যেসব স্থানের সামনে থেকে স্থাপনা সরাতে বলছে, ওই সব এলাকায় বিআইডব্লিউটিএর বেশ কয়েকটি ঘাট, পন্টুন, জেটি, বিশ্রামাগার প্রভৃতি রয়েছে। এছাড়া পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীক গুরুত্বপূর্ণ এলাকাও সেগুলো। সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, আহসান মঞ্জিলের ঠিক উল্টো দিকেই বুড়িগঙ্গার তীরে রয়েছে বিনয় সরকার বিনা স্মৃতি স্নানঘাট, একটি মসজিদ ও কয়েকটি খেয়াঘাট। পুরো এলাকাটিতে রয়েছে বাদামতলী পাইকারি ফলের আড়তসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। সেখানে বিআইডব্লিউটিএর ঘাট রয়েছে যেখানে অপেক্ষমান লঞ্চগুলো বেঁধে রাখা হয়। এছাড়া সেখানে একটি আরসিসি জেটি রয়েছে। যা স্থানীয়ভাবে এসপি ঘাট নামে পরিচিত। নদী থেকে আহসান মঞ্জিলকে দৃশ্যমান করতে হলে এসবের অনেক কিছুই অপসারণ করতে হবে।

সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালের মূল ভবনের উত্তর-পূর্বদিকে, রাস্তার ওপারে লালকুঠি ভবন অবস্থিত। লালকুঠির সামনের বুড়িগঙ্গায় রয়েছে সদরঘাট টার্মিনালের বর্ধিত অংশ। সেখানে বিআইডব্লিউটিএর পার্কিং ইয়ার্ড, ৩টি টিকেট কাউন্টার, যাত্রীদের লাউঞ্জ, কয়েকটি পন্টুন, গ্যাংওয়ে, স্পাড প্রভৃতি রয়েছে। চাঁদপুর, ইলিশা, বরিশাল (ডে-সার্ভিস) ও শরীয়তপুর রুটের যাত্রীবাহী লঞ্চগুলো এখান ছেড়ে যায়। এছাড়া বিআইডব্লিউটিসির খুলনাগামী স্টিমারও ছাড়ে লালকুঠি ঘাট থেকে। অন্যদিকে, লালকুঠি ভবনের আশপাশে পেঁয়াজ, আদা-রসুনসহ বিভিন্ন পণ্যের পাইকারি আড়ৎ দেখা গেছে। এরও কিছুটা পূবে শ্যামবাজারের দিকে রূপলাল হাউজের অবস্থান। সেখানে বিআইডব্লিউটিএর কোনো স্থাপনা দেখা না গেলেও কয়েকটি পণ্য ওঠানামার ও যাত্রীদের জন্য খেয়াঘাট রয়েছে। অসংখ্য ট্রাক, ভ্যান, রিকশা, ঠেলাগাড়ি আর ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড়ে ঐতিহাসিক এই ভবনটি খুঁজে পাওয়াই এখানে মুশকিল।

ডিএসসিসি সূত্র জানায়, নগরীর এই তিন স্থাপনার সৌন্দর্য্য, ইতিহাস ও ঐহিত্য সংরক্ষণের সিটি করপোরেশন বিশদ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। শিগগিরই এর আশেপাশের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হবে। সেখানে ভ‚মি ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন করে জনগণের চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা তৈরি করা হবে।

অন্যদিকে, নদীর তীরে বিআইডব্লিউটিএ প্রায় একই ধরণের কয়েকটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল বিভিন্ন সময়ে। ২০১৮ সালে সংস্থাটি ঢাকার চারপাশের বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালুর তীর রক্ষায় ওয়াকাওয়ে নির্মাণ প্রকল্পের দ্বিতীয় ফেইজ বাস্তবায়ন শুরু করে। দখলদার উচ্ছেদের পর সংস্থাটি সেখানে সড়ক নির্মাণও শুরু করে। তবে সড়ক নির্মাণ বিআইডব্লিউটিএর কাজ নয় বলে এ নিয়ে আপত্তি জানায় ডিএসসিসি। এতে প্রকল্পের কয়েকটি স্থানে সংশোধন আনতে হয় বিআইডব্লিউটিএকে। একই সঙ্গে সদরঘাট থেকে বাবুবাজার পর্যন্ত ১ কিলোমিটার এলাকার উন্নয়নে একটি প্রকল্প ডিজাইন করেও সেখান থেকে সরে আসতে হয় তাদের। নদী তীরে এম্ফিথিয়েটার, বসার বেঞ্চ নির্মাণ, বিনা স্নান ঘাট ঘাট ও আহসান মঞ্জিলের সামনে দৃষ্টিনন্দন পরিবেশ তৈরি, সবুজায়নসহ বিভিন্ন উন্নয়ন করতে চাওয়া হয়েছিল প্রস্তাবিত ওই প্রকল্পে।

বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেলের সৌন্দয্যবর্ধনে কামরাঙ্গীর চর এলাকায়ও একটি প্রকল্প ডিজাইন করেছিল বিআইডব্লিউটিএ। তবে পরিবেশবাদী কয়েকটি সংগঠন ও ডিএসসিসির আপত্তির কারণে সেটিও আর এগোয়নি। ফলে আদি বুড়িগঙ্গা চ্যানেল উদ্ধারের কাজে আগ্রহ হারায় সংস্থাটি। আদি চ্যানেলের ৭৪টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের নামে গত ১৫ জুন মাত্র কয়েক ঘণ্টার উচ্ছেদ অভিযান চালাতে দেখা যায় ঢাকা জেলা প্রশাসন ও বিআইডব্লিউটিএকে। তখন কামরাঙ্গীরচরের লোহারপুল এলাকা থেকে ব্যাটারি ঘাট পর্যন্ত ১০টি ছোটখাট স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। এরপর সেখানে সীমানা পিলার স্থাপন করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রতিনিধিরা। এরপর আর উচ্ছেদ কার্যক্রম দেখা যায়নি। শ্যামপুরে নদীর তীরে উচ্ছেদ করা জমিতে বিআইডব্লিউটিএর ইকোপার্ক নির্মাণ নিয়েও আপত্তি রয়েছে ডিএসসিসির।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহাম্মদ বলেন, নগর ব্যবস্থাপনা বিশ্বব্যাপী একটা সামগ্রিক বিষয়। বিআইডব্লিউটিএ শুধু যাত্রী ও পণ্য পারাপারের বিষয়টি দেখছে। কিন্তু অন্যান্য সুবিধা তৈরি ও সমন্বয়ের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। রাজধানীতে ২২টির মত সেবাদাতা সংস্থা যদি বিচ্ছিন্নভাবে নিজেদের বিষয়টি ভাবে-তবে হবে না। ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের জারি করা পরিপত্রে এটি স্পষ্ট করা আছে। তিনি বলেন, রূপলাল হাউজ, নর্থব্রুক হল (লালকুঠি), আহসান মঞ্জিলের মত স্থাপনা চাইলেই আমরা তৈরি করতে পারিনা। এগুলোর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেক। ২০০ বছরের বেশি পুরোনো এসব নিদর্শন দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে তুলে ধরা ও সংরক্ষণ করা আমাদের আইনি দায়িত্ব। এতে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন সেবায় বিরূপ প্রভাব পড়বে কিনা-এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমরা পুরো টার্মিনাল সরাতে বলিনি। ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো নদী থেকে যেন ৪৫ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে পরিষ্কার দেখা যায়, এমন ব্যবস্থা করতে বলেছি। এ কারণে কতোগুলো স্থাপনা অপসারণ করতে হবে, এর আর্থিক ও অন্যান্য বিষয়গুলো নিয়ে সমীক্ষা করা হচ্ছে। ২ সপ্তাহের মধ্যে প্রধান পরিকল্পনাবিদ এ বিষয়ে প্রতিবেদন দিবেন। নৌযাত্রীদের কল্যাণে বিকল্প চিন্তা করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

অন্যদিকে, বিআইডব্লিউটি এর চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেক বলেন, আমাদের সব স্থাপনাই তৈরি করা হয়েছে মূলত যাত্রী পরিবহন ও পণ্য ওঠানামার সুবিধার জন্য। আইন অনুযায়ী ঘোষিত নদী বন্দরের সংরক্ষক বিআইডব্লিউটিএ। ফলে এসব সুবিধা তৈরি করা আমাদের দায়িত্ব। এ বিষয়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশনাও রয়েছে। এখন হঠাৎ করে সেগুলো অপসারণ করা হলে যাত্রী পারাপার ও ব্যবসা বাণিজ্যে সংকট তৈরি হবে। তিনি বলেন, দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের যাতায়াতের অন্যতম মাধ্যম এই নৌপথ। সে কারণে প্রতি ঈদ ও উৎসবের ছুটিতে সদরঘাটে যাত্রীর চাপ সামলাতে হিমশিম অবস্থা হয়। তবে টার্মিনাল এলাকা সম্প্রসারণ করায় আগের চেয়ে যাতায়াত অনেক সহজ করা গেছে। ঐতিহ্য সংরক্ষণে সিটি করপোরেশনের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে বিআইডব্লিউটি এর চেয়ারম্যান বলেন, কোন পদ্ধতিতে কাজ করলে দুই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নই সহজ হয়-এখন সেটা ভাবতে হবে। তিনি জানান, এ জন্য ঢাকা নদীবন্দরের কর্মকর্তার নেতৃত্বে একটি কমিটি করা হয়েছে। তারা ডিএসসিসির সঙ্গে কথা বলে বিষয়গুলোর সমাধান করবেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App