×

মুক্তচিন্তা

শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতি আমাদের উদ্বিগ্ন করে

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১১ অক্টোবর ২০২১, ১২:৫০ এএম

সম্প্রতি (২৯ সেপ্টেম্বর) ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল-বাংলাদেশ (টিআইবি) ‘মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়ন : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন পেশ করে। এতে শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতির কয়েকটি চিত্র ফুটে উঠেছে, যা যে কোনো বিবেকবান মানুষকে ভাবিয়ে তুলবে। প্রতিবেদন বলছে- অধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক, সহকারী প্রধান শিক্ষক, সহকারী শিক্ষকের যোগদান, সহকারী গ্রন্থাগারিক নিয়োগ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন ও নিরীক্ষা, পাঠদান অনুমোদন, স্বীকৃতি নবায়ন থেকে শিক্ষক বদলিতে ঘুষ দিতে হয়। এছাড়া প্রতিবেদনে শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতাসহ অনিয়ম, সীমাবদ্ধতা ও ভালো-মন্দ নানা চিত্র উঠে এসেছে। স্কুল-কলেজের অধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক, সহকারী প্রধান শিক্ষক নিয়োগ, বদলি থেকে এমপিওভুক্তির জন্য মাধ্যমিকে সাড়ে ৩ থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। শিক্ষক বদলিতে জনপ্রতি ১-২ লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেন হয়। এই বদলি বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত থাকে মধ্যস্বত্বভোগী এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এনটিআরসি এ কর্তৃক সুপারিশকৃতদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যোগদানের ক্ষেত্রে ৫০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা, সহকারী গ্রন্থাগারিক নিয়োগে ২-৩ লাখ টাকা, শিক্ষক এমপিওভুক্তিতে ১ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন ও নিরীক্ষায় ৫০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা, পাঠদান অনুমোদন ১-৫ লাখ টাকা, স্বীকৃতি নবায়ন ৫-৩০ হাজার টাকা এবং শিক্ষক বদলিতে ১-২ লাখ টাকা আদায় করা হয়। কোথায় যোগ্যতা, কোথায় সততা আর কোথায় পেশাদারিত্ব? শিক্ষকতা পেশা তো অন্য যে কোনো পেশা থেকে আলাদা, এটিকে তো অন্য কোনো কিছুর সঙ্গে তুলনা করলে চলবে না। টিআইবির রিপোর্টের ব্যাপারে শিক্ষক নেতারা বলেন, ‘টিআইবির রিপোর্ট সঠিকই। তাদের রিপোর্টে ঘুষের যে টাকার কথা বলা হয়েছে, সেটি কম-বেশি হতে পারে। কিন্তু বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গেই পরিচালনা পরিষদ জড়িত। তাদের অনৈতিক চাহিদা মেটাতে গিয়েই অনেক সময় প্রতিষ্ঠানের শিক্ষককেও অনিয়মের আশ্রয় নিতে হয়। তারা ম্যানেজিং কমিটির প্রথা বাতিলের দাবি জানান। এমপিও পেতে মাউশির মাঠপর্যায় থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত সব স্তরেই কম-বেশি ঘুষ দিতে হয়। এই ঘুষ বন্ধে একমাত্র সমাধান হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা।’ স্থানীয় দুর্নীতিপরায়ণ ও প্রভাবশালীদের হাত থেকে বেসরকারি শিক্ষক সমাজ মুক্তি চায়, এটির সঙ্গে আমরাও একাত্মতা ঘোষণা করছি। দেশের শিক্ষাকে, ভবিষ্যৎ উপযুক্ত নাগরিক তৈরির কারখানাগুলোকে এভাবে পেশিশক্তির অধিকারীদের নেতৃত্বে কিংবা বলয়ে থাকতে দেয়া ঠিক নয়। যার কারণে চলছে এসব ঘুষ বাণিজ্য। প্রশ্ন হচ্ছে প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হলেই কি দুর্নীতি কমবে? সরকারি শিক্ষকদের বদলি, পদোন্নতি, পদায়ন সব ক্ষেত্রেই তো দুর্নীতি বিদ্যমান। মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরে অন্তত আট পর্যায়ে সেবাপ্রার্থীদের মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ দিতে হয়। এছাড়া বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে রয়েছে অনিয়ম। নিয়ম লঙ্ঘন করে শিক্ষক ও কর্মকর্তারা একই কর্মস্থলে ৩ বছরের পরিবর্তে ২০ বছর পর্যন্ত অবস্থান করছেন। এভাবেই পদে পদে বিরাজ করছে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থান যথেষ্ট শক্ত না হলে দেশ থেকে দুর্নীতির মূলোৎপাটন করা কঠিন। দেশের মাধ্যমিক শিক্ষায় এমন ঘটনা ঘটলে তা কতটা ভয়াবহ সেটি এড়ানোর সুযোগ নেই। ফলে সংশ্লিষ্টদের কর্তব্য হওয়া দরকার এই প্রতিবেদন আমলে নিয়ে খতিয়ে দেখা এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে যত দ্রুত সম্ভব কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিতকরণে বিভিন্ন কৌশল নির্ধারণ করা হলেও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কার্যকর উদ্যোগের ঘাটতি রয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাউশির পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) বলেন, ‘আমরা টিআইবির রিপোর্টটি এখনো হাতে পাইনি। এটি পূর্ণাঙ্গভাবে বিশ্লেষণ করে আমরা একটি জবাব দেব। তারা কীভাবে রিপোর্টটি তৈরি করেছেন, কোন মেথডলজি ব্যবহার করেছেন, কীভাবে তথ্য পেলেন, রিপোর্টের সত্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু- এসব বিষয় বিশ্লেষণ করেই আমরা বক্তব্য দেব।’ এমপিওভুক্তিতে ঘুষ-দুর্নীতি হয় কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দু-একটি ক্ষেত্রে হতে পারে সেটি ব্যতিক্রম। সেই ধরনের অভিযোগ পেলে আমরা ব্যবস্থাও নিচ্ছি। কিন্তু এমপিওভুক্তির পুরো কাজই এখন অনলাইনে হচ্ছে। কাজেই টিআইবি ঢালাওভাবে যে দুর্নীতির কথা বলছে এখন সেই সুযোগ নেই। তাছাড়া সংস্থাটি এর আগেও দুর্নীতি নিয়ে বিতর্কিত প্রতিবেদন দিয়েছে।’ এসব গৎবাঁধা কথা আমরা জানি, দুর্নীতি যে শিক্ষার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে আছে সেটি কীভাবে দূর করা যাবে সেটিই এখন মূল কথা। ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি হলেও এখনো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাস্তবায়ন হয়নি। দীর্ঘদিন অতিবাহিত হলেও নীতিগতভাবে প্রাধান্য না পাওয়ায় শিক্ষা আইনটি এখন পর্যন্ত পাস হয়নি। জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতের বরাদ্দ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী নয় এবং জাতীয় বাজেটে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষায় বরাদ্দ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী নয় এবং জাতীয় বাজেটে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় বরাদ্দ টাকার অঙ্কে ক্রমান্বয়ে বাড়লেও শতাংশের ক্ষেত্রে এটি গড়ে ৫-৬ শতাংশের মধ্যে রয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার মাঠপর্যায়ের প্রশাসনিক কার্যক্রম বাস্তবায়নে সমন্বিত জনবল কাঠামোর অনুপস্থিতি এবং জনবল সক্ষমতার ঘাটতিতে সুষ্ঠু তত্ত্বাবধান ও পরিদর্শনের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পদক্ষেপের ঘাটতিতে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিস্তার ঘটছে এবং শিক্ষা কার্যক্রম প্রক্রিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক প্রভাব, অনিয়ম ও আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ অব্যাহত রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়েছে। আইন হয়নি, তাই নির্বাহী আদেশে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নে আইনের ঘাটতি, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিতে বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ বেগবানে প্রত্যেক বিভাগে একটি করে আঞ্চলিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকদের দক্ষতা মূল্যায়নে নিবিড় পরিবীক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং কোনো দুর্বলতা পরিলক্ষিত হলে বিশেষ ব্যবস্থায় তা দূর করা হবে বলা হলেও রাষ্ট্রকে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। শিক্ষা খাতে একটি দেশের মোট জিডিপির ৬ শতাংশ অথবা মোট বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দ রাখা উচিত বলে পরামর্শ দিয়েছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনিসেফ। কিন্তু বাংলাদেশের গত ১০ বছরের জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতের বরাদ্দ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় শতকরা হিসেবে এটি ১০-১২ শতাংশের মধ্যে রয়েছে। অথচ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো শিক্ষা খাতে জিডিপির প্রায় ৩-৬ শতাংশ পর্যন্ত বরাদ্দ দিয়ে থাকে। তাই টিআইবি সুপারিশ করেছে এমপিওভুক্ত শিক্ষক ও কর্মচারীদের আর্থিক সুবিধা সামাজিক বাস্তবতার নিরিখে বৃদ্ধি করা, দ্রুত অবসর ভাতা প্রদানে বাজেটে বরাদ্দ রাখা এবং নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষকদের অধিকতর দক্ষ করে তুলতে এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতে বৈষম্য দূরীকরণে প্রয়োজনীয় অর্থ ও অন্যান্য বিষয়ে রক্ষণাবেক্ষণে প্রতিষ্ঠানগুলোর অনুকূলে আর্থিক বরাদ্দ প্রদান করার। বেসরকারি সব নিয়োগ এনটিআরসিএ বা বেসরকারি শিক্ষক নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে সম্পন্ন করা। শিক্ষকদের পদোন্নতির সুযোগ বৃদ্ধিতে পদক্রম বৃদ্ধি করা। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণকালে প্রশিক্ষণের ওপর কার্যকর মূল্যায়নে নিবিড় পরিবীক্ষণের ব্যবস্থা করা। প্রশিক্ষণের ওপর পরিপূর্ণ দক্ষতা ও জ্ঞান অর্জনে প্রদেয় প্রশিক্ষণের মেয়াদ বৃদ্ধি করা। সব ধরনের ক্রয় ই-জিপির মাধ্যমে সম্পন্ন করা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরবরাহকৃত আইসিটি উপকরণের হালনাগাদ তথ্য সংরক্ষণে একটি কেন্দ্রীয় তথ্যভাণ্ডার তৈরি করা। সরকারিভাবে বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিজস্ব উদ্যোগে প্রতিটি শ্রেণিকক্ষ পর্যায়ক্রমে স্থায়ী মাল্টিমিডিয়ার আওতায় আনা। দরপত্র, কার্যাদেশ, প্রকল্পের ক্রয় ও নিরীক্ষা-সংক্রান্ত সব হালনাগাদ তথ্য সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা। মনিটরিং এন্ড ইভ্যালুয়েন উইংয়ের প্রকাশিত বার্ষিক পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনে বিভিন্ন প্রকল্পের অনিয়ম-দুর্নীতি এবং দুর্বলতার কারণগুলো সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরা। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বার্ষিক মূল্যায়নের ব্যবস্থা রাখা। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানে এমপি বা প্রভাবশালী রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে সভাপতি মনোনীত করা হয়, ফলে অনেকাংশে যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় সম্পৃক্ত হতে পারেন না, যা শিক্ষার মানোন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। কমিটির সভাপতি কিংবা সদস্য হওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতার বাধ্যবাধকতা না থাকায় অনেক ক্ষেত্রে অশিক্ষিত লোক কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হয়, যা শিক্ষকদের সঙ্গে সমস্যা ও দ্ব›েদ্বর সৃষ্টি করে। অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যায়ক্রমে জাতীয়করণ করা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনায় কমিটির সভাপতি ও সদস্যদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণের সুপারিশ করেছে টিআইবি। দুর্নীতির দুষ্টচক্র থেকে পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে মুক্ত করতে হবে দেশের স্বার্থে, শিক্ষার স্বার্থে এবং সর্বোপরি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা স্মরণে রেখে।

মাছুম বিল্লাহ : শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App