×

মুক্তচিন্তা

শিক্ষা, শিক্ষক দিবস ও আমাদের ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১০ অক্টোবর ২০২১, ০২:০২ এএম

বিশ্বের অন্তত ১০০টি দেশে শিক্ষকদের অবদান স্মরণের জন্য ১৯৯৫ সাল থেকে প্রতি বছর ৫ অক্টোবর পালিত হয় বিশ্ব শিক্ষক দিবস। শিক্ষা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ইউনেস্কো এই দিবসটি পালন করে। ৫ অক্টোবর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও শিক্ষক দিবস পালিত হয়েছে। ‘পালিত’ শব্দটির সঙ্গে আনুষ্ঠানিকতার সম্পর্ক থাকলেও এবার কোনোরকম অনুষ্ঠান দৃশ্যমান হয়নি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ মূলধারার কিছু মুদ্রণ গণমাধ্যমে বিশেষ প্রতিবেদন বা স্তম্ভ রচনায় দিবসটির অস্তিত্ব অনুভূত হয়েছে। প্রিয় শিক্ষককে নিয়ে অনেকেই তাদের উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করেছেন। সেসব উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতা থেকে বর্তমানকালের ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের বিষয়ে মনের ভেতর কিছু প্রশ্ন জাগ্রত হওয়ায় এই লেখার অবতারণা। এতে পরামর্শমূলক আলোচনা বা দিকনির্দেশনা নেই। বরং সেসব থেকে দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা আছে। কিন্তু সে চেষ্টাও হয়তো বা সফল হয়নি। যা হোক, ছাত্র-শিক্ষকের চিরন্তন সম্পর্ক সম্পর্কে এ এক সরল উপলব্ধি মাত্র। অন্যান্য সব সম্পর্কের মতো ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের অতীত গৌরবের কথাই সবাই বেশি বলেন। আমরাও মনে করি শুধু ছাত্র-শিক্ষকই নয়- মানুষের নানামাত্রিক সম্পর্কগুলো অতীতে যতটা মানবিক গুণসম্পন্ন ছিল এখন তা নেই। আবার সামাজিক আর দশটা সম্পর্কের সঙ্গে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক কোনোভাবেই তুলনীয় নয়। এ সম্পর্কের স্বরূপটি বহুমাত্রিক, বহুব্যঞ্জনাময়, রহস্যাবৃত এবং বলাবাহুল্য লৌকিক জীবনযাপনের মধ্যে বসবাসের পরও এক অলৌকিক দ্যোতনায় মূর্ত! স্থান-কাল-পাত্র-সমাজ-রাষ্ট্র ও আচার ভিন্ন হলেও পৃথিবীব্যাপী ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের শাশ্বত এবং অভিন্ন এক রসায়ন আছে। ছাত্র-শিক্ষকের এ সম্পর্ক সামাজিক জীবনে সরলভাবে ব্যক্ত সম্ভব হলেও কখনো কখনো এক অনির্বচনীয়তায় সে রহস্য আরো গাঢ়তর মনে হয়। শ্রদ্ধা-সম্মান-ভালোবাসায় এ সম্পর্ক জাগতিক অপরাপর সম্পর্ক থেকে একেবারেই স্বতন্ত্র- পবিত্রতায়ও আবৃত। কিন্তু চারপাশে তাকালে ওপরের কথাগুলো যেন একেবারে মিথ্যা হয়ে যায় মুহূর্তেই! ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক সর্বত্র এক ধরনের নয়। সর্বত্র তো দূরের কথা একই প্রতিষ্ঠান কিংবা একই বিভাগেও তা ভিন্ন ভিন্ন! কোনো শিক্ষক মনে করেন ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কে নৈকট্যের চেয়ে দূরত্বই কাম্য, কেউবা মনে করেন নৈকট্যই জ্ঞানদান ও গ্রহণের উত্তম পন্থা। এই নৈকট্য শব্দটিরও আবার ভেদাভেদ আছে। আছে একটি সুনির্দিষ্ট সীমারেখাও। সেটি শিক্ষকরা দায়িত্ব নিয়ে শিক্ষার্থীদের উপলব্ধি করাবেন। এটি শিক্ষকেরই দায়। শিক্ষার্থীর দায় তা মেনে চলা। রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক ঘটনা মুখরোচক হলেও এখানে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের বিকৃতি আমাদের চোখে পড়ে। শিক্ষক কেন কাঁচি হাতে পরীক্ষার হলের প্রবেশমুখে দাঁড়িয়ে থাকবেন, আমরা এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে ফিরছি, এই বিকৃত শাস্তিই বা কেন একজন শিক্ষক তার ছাত্রদের দেবেন খুঁজছি তারও উত্তর। শিক্ষককে অনেক দায় নিতে হয়। বুঝতে হয় ছাত্রদের মধ্যে এক-দুজন বেয়ারা ও বেপরোয়া থাকবেই। শিক্ষককে সেটা মেনে নিতে হবে। একজন শিক্ষকের মধ্যে একই সঙ্গে পিতৃ-মাতৃসুলভ গুণাবলি থাকতে হয়, থাকতে হয় বন্ধুর মতো সহনশীল মনোভাবটিও। এ না থাকলে শিক্ষক হওয়ার দরকার নেই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষকের বয়স ছাত্রের প্রায় কাছাকাছি হলেও শিক্ষককে পিতৃ-মাতৃসুলভ হওয়ার পাশাপাশি দার্শনিক নির্দেশকও হতে হয়। তারুণ্যের উচ্ছ¡লতায় ছাত্রের বিশৃঙ্খল আচরণকেও শিক্ষককে ছাত্রের বয়সের কথা বিবেচনায় নিয়ে ক্ষমার্হ বিবেচনায় উপলব্ধি ও অনেক স্থলে দেখেও না দেখার অভিনয় করতে হয়। ছাত্রের কাছে শিক্ষকের সামাজিক ব্যক্তিত্ববোধ প্রকটের প্রয়োজন নেই। জ্ঞান ও মানবিক ব্যক্তিত্ববোধে উজ্জ্বল হওয়াই যথেষ্ট। শিক্ষককে মনে রাখতে হয় ছাত্রদের অজুহাতের অন্ত থাকে না! সেজন্য সর্বদা খড়গহস্ত হতে হবে এমন নয়। তাহলেই সম্পর্কের তাল কেটে যায়, সুর নষ্ট হয়। সময়ের মিথস্ক্রিয়ায় শিক্ষক ও ছাত্রের মধ্যকার সুর ও তাল একীভূত হতে থাকে। শিক্ষক যখন পুলিশের দায়িত্ব নিতে যান তখনই সংকট তৈরি হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অনেকেই ভুলে যান নিকট-অতীতে তারাও ছাত্র ছিলেন! রাতারাতি এরূপ অবস্থান্তরকারীদের সঙ্গেই সাধারণত ছাত্রদের সংকট তৈরি হয়। অসহনশীলতার জন্য অনেক সময় সে সংকট গণমাধ্যম পর্যন্তও গড়ায়। আবার এর বিপরীত চিত্রও আছে। ছাত্ররাও আজকাল শিক্ষকদের সমান মর্যাদা ও অধিকার চান। শুধু যে চান তাই-ই নয়- অনেক ক্ষেত্রে তাদের এই চাওয়া প্রতিদ্ব›িদ্বতাপূর্ণ, প্রতিযোগিতামূলক এবং প্রতিহিংসাপরায়ণও হয়ে ওঠে! প্রতিষ্ঠানভিত্তিক সামাজিক নানা রকমের সুযোগ-সুবিধা ভোগের প্রতিদ্ব›িদ্বতা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছাত্রদের মধ্যেই প্রকট হলে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ককেই এক ধরনের অপ্রীতিকর ও বিপরীত অবস্থানে ফেলে দেয়। শিক্ষক-বাস থেকে ছাত্রদের নামিয়ে দেয়া এবং ছাত্রদের বাস থেকে শিক্ষকদের নামিয়ে দেয়ার মতো নানা রকম তুচ্ছ ঘটনার দীর্ঘ পুনরাবৃত্তি ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের গভীর রসায়নকে নষ্ট করেছে- ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ককে কালিমালিপ্ত করেছে। বর্তমানে আমরা এক জটিলতর জীবনযাপনে অভ্যস্ত। কোনো বিষয়ে স্বতঃসিদ্ধ তো দূরে থাক সরল মতামত দিতেও দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ি। জটিলতার জাল চারদিক থেকে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলে আমাদের। তাই কোনো মতামত দেয়া দুরূহই ঠেকে! দিন দিন দুরূহ হয়ে পড়ছে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের মহিমান্বিত রূপটিও। এ সম্পর্ক নিয়েও মন্তব্য করা কঠিন। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের শাশ্বত রূপটি দিন দিন কেমন মলিন হয়ে পড়ছে! তা ভাবতে গেলে নিজেকেও জটিল সেই জালের ঘূর্ণিপাকে জড়ানো মনে হয়। আজকাল ‘ছাত্র’ ও শিক্ষক’ যেন বিপরীত শব্দবন্ধে হয়ে গেছে! প্রতিদ্ব›িদ্বতাপূর্ণ, প্রতিযোগিতামূলক এবং প্রতিহিংসাপরায়ণ এরূপ অবস্থানের কারণে কোনো পক্ষের মধ্যেই কোনো প্রকার ছাড় বা সমঝোতার লক্ষণ দেখা যায় না। শিক্ষকদের ভাবখানা এমন যে, ‘আমি তো শিক্ষক’ সুতরাং সবার আগে সবকিছুই আমার প্রাপ্য! আবার ছাত্রের দাবিও অনুরূপ- ‘ছাত্র না থাকলে কিসের শিক্ষক! শিক্ষকরা কোথাকার ব্রাহ্মণ সব তাদেরই আগে ভোগ করতে হবে!’ প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যকার এমন একটি চাপা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ আছে। শিক্ষকও মানুষ বটেন, তার যে কোনো ত্রæটি ছাত্রসমাজের কাছে ক্ষমার অযোগ্য! প্রতিদ্ব›িদ্বতাপূর্ণ অদৃশ্য এরূপ অবস্থান তৈরি হয়ে গেছে বলেই ছাত্ররাই যেন শিক্ষকের তীব্র এক বিপরীত সত্তায়ও পরিণত! কিন্তু এই ছাত্ররাই যখন শোনেন তাদের প্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষককে (সরাসরি শিক্ষক না হলেও) বাইরের কেউ অপমান-অপদস্ত করেছে তখন তারাই প্রতিবাদে গর্জে উঠেন! সুতরাং শিক্ষক এবং ছাত্র উভয় পক্ষকেই ধরে নিতে হবে এবং মেনে নিতে হবে ছাত্র-শিক্ষক আসলে একটি পরিবার। সুরটি হয়তো কোনো কারণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে, কিন্তু অন্তর্গত আবেগ এখনো বহতা নদীর মতোই প্রবহমান। পরিবারের ভেতরে সমস্যা থাকতেই পারে- তা একান্ত পরিবারেরই। বাইরের কারো নয়। ছাত্ররাই তো সগর্বে স্বীকার করেন, ‘আমার জন্মের জন্য আমি পিতার কাছে ঋণী, আর কীভাবে জন্মকে সার্থক করতে হয় তা শেখার জন্য অ্যারিস্টটলের কাছে ঋণী’- মহান শিক্ষকের প্রতি বিশ্ববিজয়ী আলেকজান্ডারের সুবিখ্যাত উক্তির কথা আমরা জানি। ক্ষমতার মসনদ আগলে রাখার চাতুর্যপূর্ণ কৌশলে পিতা ও ভাইদের প্রতি সম্রাট আওরঙ্গজেবের স্বার্থান্ধ নীতির বিরূপ সমালোচনায় ইতিহাসমুখর হলেও শিক্ষক সম্পর্কে আওরঙ্গজেবের অবস্থান অনেক উচ্চে। কবি কাজী কাদের নেওয়াজের ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ কবিতায় শিক্ষকের প্রতি ছাত্রের কর্তব্যের যে চিত্র অঙ্কন করেছেন তাতে আওরঙ্গজেব সম্পর্কেও শিক্ষকদের এক ধরনের মুগ্ধ উপলব্ধি এবং অহংকার আছে। রবীন্দ্রনাথ আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং অনেক স্থলে শিক্ষকদের প্রতি সন্তুষ্ট ছিলেন বলে মনে হয় না। ছাত্রদের সম্পর্কেও তার অভিজ্ঞতা সুখকর ছিল না। তার ‘জীবনস্মৃতি’ পড়লে এ কথা উপলব্ধি সম্ভব। ছাত্র হিসেবে ইংল্যান্ডের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র ও শিক্ষক সম্পর্কে তিনি তার অভিজ্ঞতা যেভাবে বর্ণনা করেছেন তাতে এরূপ উপলব্ধি অমূলক নয়। এদেশের স্কুলজীবনে তিনি সহপাঠী বা জ্যেষ্ঠ শিক্ষার্থীদের কাছে যেরূপ র‌্যাগিংয়ের (পেছন থেকে গাট্টা মেরে উধাও হওয়া ইত্যাদি) অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন তার বিপরীতে ইংল্যান্ডের শিক্ষার্থীরা তাকে যেভাবে গ্রহণ করেছিল তাতে তিনি বিস্মিতই হয়েছিলেন! তাছাড়া এদেশের শিক্ষকদের আচরণের সঙ্গে ইংল্যান্ডের শিক্ষকের আচরণের পার্থক্যও তাকে বেশ কিছুদিন ভাবিয়েছে। ছাত্র ও শিক্ষক সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ‘শিক্ষাসমস্যা’ প্রবন্ধে (১৩১৩) লিখেছেন : ‘আজকাল প্রয়োজনের নিয়মে শিক্ষকের গরজ ছাত্রের কাছে আসা, কিন্তু স্বভাবের নিয়মে শিষ্যের গরজ গুরুকে লাভ করা। শিক্ষক দোকানদার, বিদ্যাদান তার ব্যবসায়। তিনি খরিদ্দারের সন্ধানে ফেরেন। ব্যবসাদারের কাছে লোকে বস্তু কিনতে পারে; কিন্তু তাহার পণ্যতালিকার মধ্যে স্নেহ শ্রদ্ধা নিষ্ঠা প্রভৃতি হৃদয়ের সামগ্রী থাকিবে এমন কেহ প্রত্যাশা করিতে পারে না। এই প্রত্যাশা অনুসারেই শিক্ষক বেতন গ্রহণ করেন ও বিদ্যাবস্তু বিক্রয় করেন- এইখানে ছাত্রের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক শেষ। এইরূপ প্রতিকূল অবস্থাতেও অনেক শিক্ষক দেনাপাওনার সম্বন্ধ ছাড়াইয়া উঠেন- সে তাহাদের বিশেষ মাহাত্ম্যগুণে। এই শিক্ষকই যদি জানেন যে তিনি গুরুর আসনে বসিয়াছেন- যদি তাহার জীবনের দ্বারা ছাত্রের মধ্যে জীবনসঞ্চার করিতে হয়, তাহার জ্ঞানের দ্বারা তাহার জ্ঞানের বাতি জ্বালিতে হয়, তাহার স্নেহের দ্বারা তাহার কল্যাণসাধন করিতে হয়, তবেই তিনি গৌরবলাভ করিতে পারেন- তবে তিনি এমন জিনিস দান করিতে বসেন যাহা পণ্যদ্রব্য নহে, যাহা মূল্যের অতীত; সুতরাং ছাত্রের নিকট হইতে শাসনের দ্বারা নহে, ধর্মের বিধানে, স্বভাবের নিয়মে তিনি ভক্তিগ্রহণের যোগ্য হইতে পারেন।’ পুনশ্চ : আমরা অনেকেই স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করছি ঠিকই কিন্তু কজন প্রকৃত শিক্ষক হতে পেরেছি জানি না। আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App