×

মুক্তচিন্তা

স্মৃতিময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৯ অক্টোবর ২০২১, ১২:২৫ এএম

রাজনীতিবিদ, কূটনীতিক এবং লেখক কামরুদ্দীন আহমদ (১৯১২-১৯৮২) ল্যাংলি সাহেবের আমলের (জর্জ হ্যারি ল্যাংলি ১৯২৬ থেকে ১৯৩৪ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন) শেষাংশের ছাত্র। তিনি যখন এমএ ক্লাসে পড়ছেন তখন তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন স্যার এ এফ রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় ভাইস চ্যান্সেলর। বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এলেন- বিখ্যাত সব শিক্ষকের কারণে নতুন হলেও বিশ্ববিদ্যালয়টির খুব নাম-ডাক। ডক্টর মাহমুদ হাসান, এস এন রায়, স্যার এ এফ রহমান, ডক্টর সিনহা, ডক্টর হিরেন দে, ডক্টর জে সি ঘোষ, প্রফেসর সত্যেন বসু, ডক্টর সুশীল দে, মোহিতলাল মজুমদার, চারু বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ ব্যক্তিত্ব তখন ছাত্রদের পড়াচ্ছেন। ‘আমাদের যুগে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে এখনকার মতো এত ডক্টর ছিলেন না, আর গাড়িরও এত সমারোহ ছিল না। তারা বেশিরভাগ পায়ে হেঁটে আসতেন।’ কামরুদ্দীন আহমদ পিএইচডি স্বল্পতার একটি যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। বস্তুত হিন্দুরাই ছিলেন শিক্ষাদীক্ষায় এগিয়ে, আবার বিলেত গেলে ধর্মনাশ হয়ে যাওয়ার কুসংস্কারও তাদের মধ্যে ছিল বেশি। আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের মতো লোকের মা-ই তার ছেলেকে কালাপানি পেরিয়ে বিলেত যেতে দিতে সম্মত হননি। মুসলমান অধ্যাপকের সংখ্যা ১০ শতাংশের বেশি ছিল না- তাও আবার অধিকাংশ আরবি, ফার্সি এবং ইসলামিক স্টাডিজে। তবে আরবি বিভাগীয় প্রধান ছিলেন একজন জার্মান ডক্টর ফুইক। কলকাতার পত্রিকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে খাটো করে দেখাতে মক্কা ইউনিভার্সিটি বলত। কামরুদ্দীন আহমদ লিখেছেন অস্পৃশ্যতার বিষয়টি বেশ প্রকট ছিল- ‘অনেক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিক্ষক ও মুসলমান ছেলেরা খুব কাছাকাছি দাঁড়ালে ঘরে প্রবেশ করার পূর্বে কাপড় ছেড়ে স্নান করে ঘরের ভেতর ঢুকতেন। এর ফলে হিন্দু শিক্ষক ও মুসলমান ছাত্রদের মধ্যে দূরত্ব অনুভূত হতো।’ ইতিহাসের ছাত্র স্যার এ এফ রহমান সম্পর্কে লিখেছেন, ‘ইংরেজি বলতেন অক্সফোর্ড একসেন্টে, ঘুম থেকে উঠেই বাথরুমে ঢুকতেন এবং স্নান করে সাহেবি সুট পরে ব্রেকফাস্ট করতেন। … ছাত্রদের ভালোবাসতেন পুত্রের মতো, তাছাড়া ছাত্রদের আর্থিক সাহায্যও করতেন নানাভাবে। আমরা অন্যায় করলে অনেক সময় জরিমানা করতেন আমাদের প্রভোস্ট- বেশিরভাগ জরিমানা তিনিই দিয়ে দিতেন।’ ১৯৩৩ সালে নোবেল সাহিত্য পুরস্কার বিজয়ী জন গলসওয়ার্দির মৃত্যু হলে কার্জন হলে তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘ফরসাইট সাগা’ নিয়ে একটি প্রবন্ধ পাঠ করেছিলেন ডক্টর মাহমুদ হাসান, কিন্তু তার পঠিত প্রবন্ধের চেয়ে বেশি সুপাঠ্য হয়েছিল অনুষ্ঠানের সভাপতি এ এফ রহমানের বক্তৃতা, ‘যেমন সারগর্ভ, তেমনি সাবলীল।’ কিছু কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়ের অবতারণা করেছেন তিনি। মার্টিন এন্ড কোম্পানি স্যার আর এন মুখার্জির তত্ত্বাবধানে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের স্থাপত্য পরিকল্পনা ও নির্মাণের দায়িত্ব পালন করে। সেকালে লোকে বলত তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার খান বাহাদুর নাজিরুদ্দীন সাহেবের দেওয়ান বাজারের বাড়িটি নাকি মার্টিন কোম্পানিই নির্মাণ করে দিয়েছে। খান বাহাদুর সাহেব ইংরেজিতে এমএ পাস করে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হয়েছিলেন, ‘কিন্তু ঘোড়া থেকে পড়ে পা ভেঙে খোঁড়া হয়ে’ তিনি আগের চাকরি ছেড়ে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টারের পদ গ্রহণ করেন। বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী সত্যেন বসু ১৯২১ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন, তিনি এখানে তার অবস্থান অব্যাহত রাখতে চেয়েছেন কিন্তু প্রভাবশালী সিনেট সদস্য ফজলুর রহমান (স্বাধীনতা পরবর্তী পাকিস্তানের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী, যিনি আরবি হরফে বাংলা ভাষা প্রচলনের প্রবক্তা হিসেবে অধিক পরিচিত) বিরোধিতা করায় তাকে ঢাকায় রাখা যায়নি। ‘অঙ্কের প্রফেসর এস এম বোস তার ছাত্রী ফজিলাতুননেছার প্রতি একটু অতিমাত্রায় আকর্ষণ দেখাবার ফলে ফার্সির প্রফেসর ফিদা আলী খান তাকে অপমানের চূড়ান্ত করেছিলেন। ভাগ্য ভালো এর কিছুদিন পরেই ডক্টরেটের জন্য ফজিলাতুননেছা বিলেত চলে যান, বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে যায়।’ তিনি ডক্টর ই সি গুপ্তের কন্যা, সাধারণ পোশাক ও ক্যাম্বিসের জুতা পরা ইতিহাসের মেধাবী ছাত্রী করুণাকনা গুপ্তার ঢের প্রশংসা করেছেন। কেবল তার ব্যক্তিত্বের কারণে একগাদা বই বুকে চেপে করিডোর ধরে হেঁটে যাওয়া এই মেয়েটিকে নিয়ে কেউ কখনো কুৎসা রটনা কিংবা অনাকাক্সিক্ষত আলোচনায় মেতে উঠতে পারেনি। করুণাকনার পরের বছর নতুন যুগের ছাপ নিয়ে আসা একদল ছাত্র- সরোজ, রেণু, পুতুল, মীনা, শান্তি থিয়েটার করত। জোট পাকিয়ে ছেলেদের উত্ত্যক্ত করত। ‘শেষদিকে শান্তি ইংরেজির অধ্যাপক মন্মথ বাবুকে বিয়ে করলেন আর অপূর্ব কাণ্ড করে বসলেন বাংলার হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্ট সুশীল দে- মীনা দে চৌধুরানীর প্রতি বৃদ্ধ বয়সে অনেকটা আকৃষ্ট হয়ে পড়লেন, ফলে মীনাকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়তে হলো।’ তিনি মাদ্রাজি প্রফেসর আয়ারের কথা লিখেছেন। জটিল ও জোড়া লাগানো বাক্যে তিনি ইংরেজিতে বক্তৃতা করতেন যেন সোজা ইংরেজি তিনি জানতেন না।

নাট্যকার মন্মথ রায়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মন্মথ রায় (১৮৯৯-১৯৮৮) নাট্যকার, আইনজীবী, বামপন্থি রাজনীতিবিদ এবং পৌরসভা মেয়র। জন্ম বাংলাদেশের টাঙ্গাইলে, গালা গ্রামে ১৩৪৬ বঙ্গাব্দে আষাঢ়ের প্রথম দিন। তখনকার দিনাজপুরের বালুরঘাট উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন, রাজশাহী কলেজ থেকে আইএ এবং কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে বিএ পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বছর ১৯২২ সালে অর্থনীতিতে এমএ ক্লাসে ভর্তি হলেন। জগন্নাথ হলের আবাসিক ছাত্র হলেন। শুরু থেকেই এ হলের প্রভোস্ট বিখ্যাত ঔপন্যাসিক ও আইনজ্ঞ নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত। তিনি সেকালের ডক্টর অব ল। সেকালে মন্মথ রায়ের কাছে নাট্যচর্চার চেয়ে ক্রীড়াচর্চাই নেশায় পরিণত হয়েছিল। তিনি ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যাথলেটিক ক্লাবের সম্পাদক নির্বাচিত হন, ঢাকা ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টস ইউনিয়নেরও প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক, সেই সঙ্গে ১৯২২ সালেই ঢাকা ইউনিভার্সিটি জার্নালের দুজন সহকারী সম্পাদকের একজন, অন্যজন পরবর্তীকালে পাকিস্তানের ইংরেজি দৈনিক ‘ডন’-এর খ্যাতিমান সম্পাদক আলতাফ হোসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। হলের প্রভোস্ট নরেশ সেনগুপ্ত ঘোষণা করলেন- ছাত্রদের কাউকেই নাটক লিখতে হবে, সে নাটকই মঞ্চস্থ হবে। অ্যাথলেটিক সেক্রেটারি মন্মথ রায় যখন নাটক জমা দিলেন প্রভোস্ট হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ফুটবলের নাটক নাকি? এই নাটক সাহিত্যিক ও প্রভোস্ট নরেশ সেনগুপ্তকে মুগ্ধ করল, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এতে চরিত্র কম- বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তত কুড়ি-পঁচিশজন তো অভিনয় করতে চাইবে- কাজেই চরিত্রসংখ্যা বাড়াতে হবে। তিনি ১৯২৩-এর ৬ থেকে ১৯ নভেম্বরের মধ্যে নাটক দেবদাসী লিখে ফেললেন। ২১ ডিসেম্বর ১৯২৩ জগন্নাথ হল ড্রামাটিক এসোসিয়েশন নাটক মঞ্চে তুলল, মন্মথ রায় নিজেও অভিনয় করলেন। সাড়া পড়ে গেল। প্রভোস্ট নিজে তার লেখা নাটক নিয়ে গেলেন কলকাতায়, স্টার থিয়েটারকে দিয়ে তার নাটক কলকাতার মঞ্চে তোলার অঙ্গীকার নিয়ে ফিরে এলেন। বড়দিনে মঞ্চে উঠল নটসূর্য অহীন্দ্র চৌধুরী পরিচালিত মন্মথ রায়ের মুক্তির ডাক। ২৩ বছর বয়সি অর্থনীতিতে এমএ প্রথম বর্ষের ছাত্র মন্মথকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি, যদিও রাজরোষে নিষিদ্ধ হয়েছে তার নাটক। তিনি কৃতিত্ব দিচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে- ইট-পাথরে গড়া প্রাসাদোপম নতুন ভবনগুলোকে নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ সঞ্চার করা মানুষগুলোকে। ‘কার কথা ছেড়ে কার কথা বলব? হার্টগ সাহেবের মহানুভবতা, ডক্টর নরেশচন্দ্র সেনগুপ্তের সাহিত্যদীপ্ত প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য, দার্শনিক প্রতিভা হরিদাস ভট্টাচার্যের অপূর্ব জীবন দর্শন, ডক্টর রমেশচন্দ্র মজুমদারের ঐতিহাসিক দীপ্তি ও উজ্জ্বল কর্মকুশলতা, রহমান (স্যার এ এফ রহমান) সাহেবের মাধুর্যমণ্ডিত অপূর্ব সৌজন্য। আমাদের জগন্নাথ হলের আবাসিক কর্মকর্তা অধ্যাপক ইউ সি নাগ এবং অধ্যাপক পি কে গুহর শান্ত স্নিগ্ধ প্রীতি ও শুভেচ্ছামণ্ডিত ছাত্র-বাৎসল্য।’ বিশ্বখ্যাত সত্যেন বোস ও চারু বন্দোপাধ্যায় সম্পর্কে তিনি উচ্ছ¡সিত; দুজন বন্ধু ড. পরিমল রায় ও ক্ষিতিশ চৌধুরী তার জীবনের ‘অচ্ছেদ্য স্মৃতি’ হয়ে আছেন। ১৯২৪-এ এমএ এবং ১৯২৫-এ বিএল ডিগ্রি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিদায় গ্রহণ করেন। জগন্নাথ হলের তৃতীয় বর্ষের বাসন্তিকায় ১ ফেব্রুয়ারি ১৯২৬ শেষ কথায় তিনি লিখেছেন : ‘জগন্নাথ হলের খাতা হইতে আমার নাম উঠিয়া যাইবার দিন আসিয়াছে কিন্তু আমার জীবনের খাতায় জগন্নাথ হলের নাম রক্তরাঙা অক্ষরে লেখা রহিয়াছে। আমার প্রথম পাঁচখানি নাটক এই হলের বন্ধুগণের উৎসাহের উৎস হইতেই উৎসারিত হইয়াছে।’ ঢাকা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার শেষ প্রধান স্মৃতি ৭ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঢাকা সফরকালে তার স্নেহময় সান্নিধ্য লাভ। কবি যে মেঘদূতের অনুবাদক গণেশচরণ বসু (জগন্নাথ হলের ছাত্র) এবং মন্মথ রায়ের প্রশংসা করেছিলেন তা বাসন্তিকার ঘরের খবর পাতায় মুদ্রিত হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের ‘আদি পর্যায়ে একদা আমিও তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত ছিলাম, এই আনন্দোজ্জ্বল সত্যটি আমার অস্তায়মান জীবনের পরম পাথেয়। (উৎস : ধাত্রীমাতা- মন্মথ রায়, আমাদের সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭৪ সংকলনে প্রকাশিত)

শফিক রেহমানের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মতাদর্শগত কারণে এস এম হলের শফিক রেহমান কারো পছন্দের মানুষ নাও হতে পারেন, একই কারণে আবার হতেও পারেন। পঞ্চাশের দশকের প্রথমার্ধের শিক্ষার্থীদের কারো কারো কাছে হিরো হয়ে উঠেছিলেন শফিক রেহমান। ১৯৫২ থেকে ১৯৫৬ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির ছাত্র, ‘প্রশ্নবিদ্ধ অক্সফোর্ড : বর্তমান ও অতীত’ রচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মানের ক্রমাবনতি নিয়ে আফসোস করছেন। শফিক রেহমান লেখালেখি ও সম্পাদনার জন্য খ্যাত। তিনি তার সময়ের স্মরণীয় ক’জন ছাত্র-শিক্ষক ও কিছু ঘটনা সুন্দরভাবে তুলে এনেছেন। সেই সময়ের (১৯৫২-১৯৫৬) আকর্ষণীয় বক্তা ছয় ফিট লম্বা টকটকে ফর্সা সুপুরুষ, ইংরেজি, বাংলা দুই ভাষাতেই পারদর্শী অর্থনীতির ছাত্র সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ। পরে ব্যারিস্টার। দক্ষিণপন্থি ছাত্রের পরিচিতি বহন করলেও প্রগতিপন্থিরাও তার বক্তৃতা শুনতে জড়ো হতেন। ভোজনপ্রিয় ছিলেন ইংরেজির ফারুক আহমদ চৌধুরী। ফারুক চৌধুরীর প্রোগ্রাসে খাওয়া দেখতে অন্য ছাত্ররা তাকে দাওয়াত করে খাওয়াতেন। তিনি কর্মজীবনে পররাষ্ট্র সচিব ও রাষ্ট্রদূত ছিলেন, যথেষ্ট লেখালেখিও করেছেন। অর্থনীতির ছাত্র মোজাফফর আহমদ ছিলেন লাইব্রেরি-আসক্ত মানুষ। সাইকেল চালিয়ে ইউনিভার্সিটিতে এসে একবার যে লাইব্রেরি ঢুকতেন, ঠেলে বের না করা পর্যন্ত লাইব্রেরিতে থাকতেন, কিন্তু পরীক্ষার ফল আশাপ্রদ হয়নি। বাকপ্রিয় ইংরেজির আবুল মাল আবদুল মুহিত, বরাবর হাসিমুখেই থাকতেন; সিএসপি, পরবর্তীকালে অর্থ উপদেষ্টা ও অর্থমন্ত্রী। ইংরেজির এ জে এম ওবায়দুল্লাহ খান ছিলেন ক্যারিশম্যাটিক ব্যক্তিত্ব, তার নামের সঙ্গে যুক্ত হয় ব্রিলিয়েন্ট টাইটেল। সেরা আমলা, রাষ্ট্রদূত, মন্ত্রী এবং সবকিছু ছাপিয়ে কবি, আমি কিংবদন্তির কথা বলছি, আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি- তারই কবিতা। শফিক রেহমানের বর্ণনার ইংরেজির আবিদ হুসেন ফ্যাসিনেটিং এবং রমণীমোহন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের খুকি মানে ‘মুখ ও মুখোশ’ সিনেমার জহরত আরা পাইওনিয়ার অভিনেত্রী; জহির রায়হান নাম করেছেন হস্তরেখা বিশারদ হিসেবে। সুগায়িকা খালেদা ফ্যান্সি খানম সংগীত ভুবন থেকে মাইনাস হয়ে গেছেন। ধনাঢ্য কবি হাসান হাফিজুর রহমান এবং লাজুক কবি শামসুর রাহমান। ব্রাদার নামে খ্যাত ইংরেজির লতিফুর রহমান পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হয়েছেন। সিগারেট ট্রে গলায় ঝুলিয়ে ইউনিভার্সিটির বিভিন্ন অনুষ্ঠানে খুচরা শলা ও প্যাকেটভর্তি সিগারেট, দেয়াশলাই ইত্যাদি বিক্রি করে নিজের আত্মনির্ভরশীল পরিচিতি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান শেলী, পরে প্রধান বিচারপতি এবং ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। শফিক রেহমানের মতে সেকালের অলরাউন্ডার দুজন : এ ডব্লিউ শামসুল আলম এবং মোহাম্মদ আসফউদ্দৌলা। দুজনই ভালো ছাত্র, প্রথমজন টেনিস ও ব্রিজ চ্যাম্পিয়ন, দ্বিতীয়জন সাঁতারে ও খেলাধুলায় এবং গানবাজনায় তুলনাহীন। বাংলার ছাত্রী সনজীদা খাতুন পরিচিত, একনিষ্ঠ সংস্কৃতিসেবী। সবচেয়ে সহজবোধ্য অর্থনীতির শিক্ষক ড. আবু মাহমুদ, ছাত্রবান্ধব শিক্ষক ড. নুরুল মোমেন, ছাত্রোপকারী শিক্ষক দার্শনিক গোবিন্দচন্দ্র দেব। শফিক রেহমানের সঙ্গে ১৯৫৩-৫৬ ব্যাচের তালেয়া রহমানের প্রেম ছাড়াও তখনকার আরো চারটি স্মরণীয় প্রেমিক-প্রেমিকা জুটির ছিল : ফরিদা বারি মালিক ও আমানুল্লাহ খান, কামেলা শরাফি ও দাউদ খান মজলিশ, অর্থনীতির সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ ও ইতিহাসের সুফিয়া আহমেদ, এ জেড এম ওবায়দুল্লাহ খান ও পুতুল। পুতুল ওবায়দুল্লাহর ছাত্রী, শুরুতে পুতুল তার প্রেমে সাড়া না দেয়ায় নতুন শিক্ষক ওবায়দুল্লাহ খান বেশ করে ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন; অচেতন ওবায়দুল্লাহকে হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়, তখন পুতুলেরও সাড়া মেলে। তাদের বিয়ে হয়। তবে জোড় হিসেবে বৈধতার প্রশ্নে সবচেয়ে এগিয়ে ছিলেন দিলারা ও হাসেম। শফিক রেহমানরা যখন প্রেমে মগ্ন তখন তারা রীতিমতো বিবাহিত। অবশ্য তালেয়া রহমানের এক পাণিপ্রার্থী শফিক-তালেয়ার বিয়ের আগেই বিয়ে হয়েছে বলে ‘দ্য পাকিস্তান অবজারভার’-এ একটি সংবাদ ছাপিয়ে দেন। সেকালে ছাত্রদের লক্ষ্য ছিল নির্ধারিত সময়ে ভালো মানের ডিগ্রি নিয়ে সিএসপি হয়ে কাক্সিক্ষত ছাত্রী বা প্রেমিকাকে বিয়ে করা; যদি তা সম্ভব না হয় ‘তাহলে চাঁদ সওদাগর জাতীয় কোনো প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীর অথবা জাঁদরেল আমলার কন্যাকে বিয়ে করে ক্যারিয়ার মজবুত করা’। টেন্ডারবাজি, ধর্ষণের ভিডিও ধারণ, এমপি হওয়ার নমিনেশন গ্রহণ, রাজনৈতিক ব্যক্তিপূজা এসব ছিল না। ছাত্রীদের ছিল না বোরকা, নেকাব, থ্রিপিস, টপস, জিন্স ও ট্রেইনার শু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তখন অন্তত এখনকার চেয়ে ভালো ছিল; কিন্তু কোনোভাবেই অক্সফোর্ডতুল্য ছিল না।

ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে, নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App