×

মুক্তচিন্তা

জলবায়ুর পরিবর্তন ও স্বাস্থ্য সমস্যা

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৯ অক্টোবর ২০২১, ১২:২৪ এএম

কবি জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত উক্তিটিই আজকে আমার লেখার শিরোনাম। পরের লাইনে আবার তিনিই লিখেছিলেন, ‘মানুষ তবুও ঋণী পৃথিবীরই কাছে’। জাতিসংঘের সংস্থা ‘আইপিসিসি’র অতি সাম্প্রতিক রিপোর্টটি বড়ই উদ্বেগজনক। তবে এমন গভীর অসুখটি কিন্তু আজ পৃথিবীর নয়, পৃথিবীর মানুষের। পৃথিবীতে ইতোপূর্বে বহুবার জলবায়ু পরিবর্তন হয়েছে, প্রাণের মহাবিলুপ্তিও ঘটেছে। কিন্তু পৃথিবী সামলে নিয়েছে। প্রাণ টিকে গিয়েছে শেষ পর্যন্ত। কিন্তু এবারের অসুখটি শুধু মানুষের। মানুষ যে পৃথিবীর কাছে ঋণী- তা ভুলে গিয়ে মানুষ শুধু নিজের ক্ষমতা, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য আর মুনাফা অনির্দিষ্টভাবে বাড়িয়ে চলছিল। অক্সিজেন ছাড়া মানুষ বাঁচে না। কিন্তু সেই অক্সিজেন জোগানদাতা পৃথিবী নামের গ্রহটি যে নানা প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত, এ কথাটা যেন দিব্যি ভুলে গেছে মানুষ! সেই ভুলে যাওয়াটা প্রথম শুরু হয় ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী দিনগুলোতে, ধনতান্ত্রিক দুনিয়ার সূচনায়। ধীরে ধীরে সেই পশ্চিম-প্রদর্শিত পথেই হেঁটেছে অন্যান্য দেশ। ‘সব আমাদের জন্য, শুধু আমাদেরই জন্য’- গানের এ বাণীর মতো মানুষ নিজের অবস্থানের লাগামছাড়া উন্নতির সাধনায় ডেকে এনেছে নিজেরই সর্বনাশ। কৃষিজমি, বাসস্থান, ফসলজাত জ্বালানি, খনিজ পদার্থ ইত্যাদির খোঁজে ক্রমাগত ধ্বংস হয়েছে জঙ্গল আর খালি জায়গা। গত ১৫০ বছরে মানুষের জীবনযাত্রার মান ও মানুষের সংসারের যে অভাবনীয় বৃদ্ধি হয়েছে তা অনস্বীকার্য। প্রথমত, মানুষের সংখ্যা। আমাদের এই হোমো সেপিয়েন্স প্রজাতির বয়স যদি ৩ লাখ বছর হয়, তাহলে বলা যায়- সংখ্যায় ১০০ কোটিতে পৌঁছাতে প্রায় পুরো সময়টাই লেগে গিয়েছিল। ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে মানুষের সংখ্যা ছিল ১৫০ কোটির মতো। ২০০০ সালে তা দাঁড়িয়েছিল ৬০০ কোটিতে। একশ বছরে প্রায় ৪ গুণ বৃদ্ধি। এই বৃদ্ধির বেশিরভাগটাই আবার ১৯৫০ সালের পরে হয়েছিল। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এই ১০০ বছরে শহরের মানুষ বাড়ল ১৩ গুণ; যন্ত্রশিল্পের উৎপাদন বাড়ল ৩৫ গুণ, রাসায়নিক সারের ব্যবহার ৩৫০ গুণ, মৎস্য শিকার ৬৫ গুণ, রাসায়নিক দ্রব্যের উৎপাদন ১ হাজার গুণ, আর মোটরগাড়ির উৎপাদন বৃদ্ধি হলো ৭ হাজার ৭৫০ গুণ। ফ্রিজ-গাড়ি কিনতে পারেন এমন মানুষের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শিল্পবিপ্লবের পর এরকম মানুষের সংখ্যা ১০০ কোটি হতে সময় লেগেছিল ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত। আর সেই সংখ্যা ২০০ কোটিতে পৌঁছাতে সময় লেগেছে মাত্র ২১ বছর (২০০৬ সাল), ৩০০ কোটি হতে সময় লেগেছে ৯ বছর। সংখ্যাটি ৪০০ কোটিতে দাঁড়াতে সময় লেগেছে ৭ বছর। এত রমরমা অবস্থার পেছনে বাড়ছে ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের ব্যবহার ও চাহিদা। পৃথিবীর ইতিহাসে এর আগে কোনো প্রজাতি কোনোদিন এত আরামে থাকেনি, যা আজ মানুষ করতে পারছে। বলাবাহুল্য, প্রচুর জ্বালানি ব্যবহার না করলে মানুষের জীবনযাত্রার মান এত উন্নত হতো না। মানুষ বুঝি ধরেই নিয়েছিল পৃথিবী সর্বসহা। কিন্তু আজ আমরা জেনেছি, পৃথিবী সর্বসহা নয়। ফসিল-জ্বালানি ব্যবহার করলেই গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত হয়ে বাতাসে মিশে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ায়। পৃথিবীতে গ্রিনহাউস গ্যাসের প্রয়োজন ঠিকই, কিন্তু তার মাত্রা বেড়ে গেলে আবার মানুষেরই সমস্যা। বাড়তি গ্যাস পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়াতে থাকে। তখন জঙ্গলে আগুন লাগে, কৃষি খাতে খরা নেমে আসে, বর্ষাকালে অতিবৃষ্টিতে বন্যা-ধস বেড়ে যায়। শহরে ঘনবসতি ও ঘর-বাড়ির ঘনত্বের কারণে গরম আরো বেশি মাত্রায় বাড়ে। মানুষ এয়ার কন্ডিশনার লাগিয়ে গাড়ি-বাড়ি ঠাণ্ডা করতে গিয়ে গ্রিনহাউস গ্যাস ছড়িয়ে তাপমাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয়। সমুদ্রের পানি গরম হলে সামুদ্রিক বরফ গলে ফুলে-ফেঁপে ওঠে, উপকূল ভাসিয়ে দেয়, মিষ্টি পানিকে নোনা পানিতে পরিণত করে, সাইক্লোন আর সুনামি বাড়ে। মানুষের তথাকথিত সভ্যতাই জলবায়ু ও অতিমারির সংকট তৈরি করে মানুষের বিপদ ডেকে আনছে। তাইতো মানুষের গভীর এবং গভীরতর অসুখ এখন। লাগামহীন ধনতান্ত্রিক উন্নতির পথ মানুষকে সহজেই জলবায়ুর সমস্যা উপহার দিয়েছে। কোভিডের ছোবল আমাদের শুধু আর্থ-সামাজিক জীবনই বিষে নীল করে দেয়নি, এর গভীর প্রভাব দেখা দেবে পরিবেশেও। বাড়বে উষ্ণতা এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়। কোভিডের জন্য বাড়তি ব্যয় পৃথিবীর দেশগুলোকে পৃথিবীর উষ্ণতা ঠেকানোর টাকা জোগানে বাধা দেবে। সামনের দিনগুলো আমাদের জন্য সুখকর সংবাদ বয়ে আনতে পারছে না। বিশেষ করে ভারত, বাংলাদেশের তো নয়ই। বাংলাদেশ বিপদের একেবারে মাঝখানে অবস্থান করছে। কিন্তু আমরা নির্বিকার। ঘূর্ণিঝড়ের ঝাপটা সামলাতে না সামলাতেই আমাদের দেখতে হয় ভারি বৃষ্টি। ভেসে যায় নতুন করে চারদিক। নোনা জল ওঠার কারণে সেচ পাম্পের গভীরতা ক্রমেই বেড়েই চলেছে। আবার অতিবৃষ্টির মহার্ঘ মিঠে জলও অভিশাপের মতো নেমে এসে বোনা বীজ তলিয়ে দিচ্ছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, এ বছর আমরা ভয়ানক বন্যার ছবি দেখেছি জার্মানি, চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্রসহ নানা দেশে। গত বছর পূর্ব আফ্রিকায় দেখেছিলাম ভয়ংকর বন্যা। সন্দেহ নেই, মানুষের কার্যকলাপের জন্যই উষ্ণায়ন হচ্ছে। এত বেশি পরিমাণে কার্বন ও অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত হচ্ছে যে, তা তাপমাত্রা বাড়াচ্ছে। ফলে সহজেই জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে। বর্তমানে ভূপৃষ্ঠের যা উষ্ণতা, তা শিল্পবিপ্লবের পূর্বে বিশ্বের ভূপৃষ্ঠের উষ্ণতার চেয়ে ১.৯ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বেশি। এর মধ্যে সরাসরি মানুষের অবদানে বৃদ্ধি পেয়েছে ১.৭ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড; বাকিটা হয়েছে প্রাকৃতিক কারণে। মহাসাগরের চেয়ে মহাদেশগুলোর স্থলভাগে তাপমাত্রা বেশি বাড়ছে। যত উত্তাপ বাড়ছে, সমস্যা ততটাই প্রকট হচ্ছে। অন্যদিকে উষ্ণতার সঙ্গে বাড়ছে আর্দ্রতাও। তাপমাত্রা এক ডিগ্রি বাড়ার সঙ্গে বাতাসে জলীয় বা®েপর পরিমাণ বাড়বে ১-৩ শতাংশ। এর ফলে বৃষ্টির পরিমাণ বাড়ে, ঘন ঘন বৃষ্টি হয়। বারবার অতিমাত্রায় বৃষ্টি হওয়ার জন্য বন্যাও হচ্ছে বেশি। বন্যা হচ্ছে- কারণ নদী, মানুষের তৈরি খাল-নালা প্রভৃতির ধারণ ক্ষমতাকে ছাপিয়ে যায় বৃষ্টির পানি। আবার অন্যদিকে আর্দ্রতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খরার প্রকোপও বাড়ছে। উষ্ণতার জন্য পানি আরো বেশি করে বাষ্প হচ্ছে, তাই মাটিতে পানির অংশ কমছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং খরা পরিস্থিতির সঙ্গে দাবানলের আশঙ্কাও বাড়ছে। ইদানীং আমরা যত চরম দুর্যোগ দেখছি, তার প্রায় সব ক’টির সম্ভাবনা অনেকাংশে বাড়িয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন। প্রায় সব নদীরই উৎপত্তি হিমবাহ থেকে। কিন্তু বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে হিমবাহ গলছে সর্বত্র। ২০১০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে হিমবাহগুলো যত বরফ হারিয়েছে, তার নজির অতীতে খুঁজে পাওয়া যায় না। উষ্ণতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আরো দ্রুত বরফ গলবে, যার ফলে নদীর প্রবাহে পরিবর্তন আসবে- জীবিকা নষ্ট হবে, শক্তির উৎপাদন ব্যাহত হবে। আমাদের কৃষিজমি, জমির ব্যবহার, খাদ্য উৎপাদন ইত্যাদি অনেক কিছুই ব্যাহত হবে। অন্যদিকে অরণ্য ধ্বংসের কারণে মাটির পানি ধরে রাখার ক্ষমতা কমবে, পানি গড়িয়ে গিয়ে নষ্ট করবে নগরায়ণ। তাইতো বলছি- পৃথিবীর মানুষের গভীরতর অসুখ এখন। আর এ অসুখের জন্য তারাই দায়ী। যা আগে কখনো হয়নি, তা-ই হচ্ছে এখন। কানাডাতে প্রবল গরম, জার্মানিতে বিধ্বংসী বন্যা, চীনে লাগামছাড়া বৃষ্টি, আফ্রিকা ও মধ্য এশিয়ায় ভয়াবহ খরা- ঘুরেফিরে গিলে খাচ্ছে আমাদের চরম আবহাওয়া। মানব জাতির লাগামহীন আত্মকেন্দ্রিকতায় আজ পৃথিবী নামের গ্রহটি বিপন্ন।

মেজর (অব.) সুধীর সাহা : কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App