×

জাতীয়

চেক প্রত্যাখ্যান মামলায় আটকে ৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৮ অক্টোবর ২০২১, ০৯:১৯ এএম

আদালতে এখন ব্যাংক ও আর্থিক খাতের ২ লাখ ১ হাজার ৫৮৬টি মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। এসব মামলার বিপরীতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ১ লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকা আটকে আছে। এর মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশই রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর। এছাড়া জাল টাকার (দেশি জাল নোট) ৫ হাজারেরও বেশি মামলা ঝুলে আছে। অন্যদিকে চেক প্রত্যাখ্যানের মামলায় আটকে আছে ৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে বড় অঙ্কের ঋণ জালিয়াতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ধীরে তদন্ত চলছে। মামলা নিষ্পত্তির কার্যক্রমেও গতি নেই। ফলে জড়িতদের কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থার আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না। জালিয়াতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় নতুন করে ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটছে।

ঋণখেলাপিদের জন্য গত এক দশকে একাধিক সুবিধা দেয়ার পরও খেলাপি ঋণ ক্রমাগত বেড়েছে। অন্যদিকে দু-একটি ঘটনা ছাড়া ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার উদাহরণও নেই। এই ধারা অব্যাহত থাকলে কিছুদিনের মধ্যেই খেলাপি ঋণ ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে মত সংশ্লিষ্টদের।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, অর্থঋণ আদালতে দায়েরকৃত মোট মামলার সংখ্যা ২ লাখ এক হাজার ৫৮৬টি। এর বিপরীতে দাবির পরিমাণ ১ লাখ ৯৫ হাজার ৭৯১ কোটি টাকা। তবে জুন পর্যন্ত নিষ্পত্তিকৃত মামলার সংখ্যা ১ লাখ ৩৬ হাজার। এর বিপরীতে প্রকৃত আদায় মোট ১৯ হাজার ৭৩ কোটি টাকা। সে অনুযায়ী অর্থঋণ আদালতে আটকে থাকা মোট অর্থের পরিমাণ ১ লাখ ৭৬ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ব্যাংকগুলো ঋণ আদায়ের জন্য সাধারণত চার ধরনের আদালতে গ্রাহকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। আদালতগুলো হলো- অর্থঋণ আদালত, দেউলিয়া আদালত, সার্টিফিকেট আদালত ও দেওয়ানি আদালত। এর মধ্যে অর্থঋণ আদালতেই বেশির ভাগ মামলা দায়ের করা হয় এবং এ আদালতেই ব্যাংকের বেশির ভাগ অর্থ আটকে আছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সাধারণত প্রতি ছয় মাস পর হালনাগাদ তথ্য দিয়ে মামলার বিবরণী তৈরি করে। সর্বশেষ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে গত ৩০ জুনভিত্তিক তথ্য দিয়ে। মামলার সংখ্যা ও আদায়ের চিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০২০ সালের জানুয়ারি-জুন সময় পর্বের তুলনায় ২০২১ সালের একই সময়ে মামলা নিষ্পত্তি এবং আদায় হয়েছে অনেক কম। যেমন জানুয়ারি-জুন সময়কালে বিচারাধীন মামলার বিপরীতে আটকে থাকা খেলাপি থেকে আদায় হয়েছে ৪ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা। কিন্তু ২০২০ সালের একই সময়ে আদায় হয়েছিল ১৮ হাজার ২৫৬ কোটি।

আদালতভিত্তিক মামলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ আটকে আছে অর্থঋণ আদালতে। যেমন- গত জুনভিত্তিক তথ্য অনুযায়ী অর্থঋণ আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা এখন ৬৫ হাজার ৪৩৭টি। এর বিপরীতে ব্যাংকগুলোর দাবিকৃত টাকার পরিমাণ ১ লাখ ৩৫ হাজার ৮৫১ কোটি টাকা।

বেসরকারি ব্যাংকগুলোর চেয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর বেশি অর্থ আদালতে আটকে যাওয়ার কারণ হিসেবে ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর বেশির ভাগই ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করে। গ্রাহকের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা যাচাই-বাছাই করে ঋণ প্রদান করায় বেশি হারে ঋণ আদায় হয় এসব ব্যাংকে। কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর এ সুযোগ খুব কম। কারণ সরকারি ব্যাংকগুলো পরিচালিত হয় অনেকটা রাষ্ট্রযন্ত্র দ্বারা। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন থাকায় রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপও অনেক সময়ে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর চেয়ে বেশি।

আবার অনেক ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ দেয়া হয় সরকারি ব্যাংকগুলোয়। ওই সব ঋণই একসময় আদায় না হওয়ায় কুঋণে পরিণত হয়। আর কুঋণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই স্বাভাবিক পর্যায়ে আদায় হয় না। এসব ঋণ আদায়ের জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আদালতে গ্রাহকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। ঋণ আদায় কমে যাওয়ায় ব্যাংকগুলো তাই অর্থঋণ আদালতসহ অন্যান্য আদালতে মামলা দায়ের করে থাকে। কিন্তু আদালত পর্যাপ্ত না থাকায় মামলার নিষ্পত্তি হয় ধীরে ধীরে। এভাবেই খেলাপি ঋণের পাহাড় জমতে থাকে।

তবে সরকারি ব্যাংকগুলোর মতো এখন কিছু কিছু বেসরকারি ব্যাংকেও মামলার সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। এর কারণ হিসেবে দেশের দ্বিতীয় প্রজন্মের একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বারবার ঋণখেলাপিদের সুযোগ দেয়ায় যারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করতেন তারাও এখন নিরুৎসাহিত হয়ে যাচ্ছেন। এর ফলে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতেও কুঋণ বেড়ে যাচ্ছে। আর ঋণ আদায়ের জন্য শেষ পর্যন্ত আদালতে মামলা করতে হচ্ছে। এতে একদিকে ব্যাংকের মামলা পরিচালনার জন্য যেমন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে, তেমনি সময়মতো মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় ব্যাংকের টাকা আটকে যাচ্ছে। এতে ব্যাংকের ঋণ বিতরণের সক্ষমতাও কমে যাচ্ছে।

এদিকে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) থেকে ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা তদন্ত করে দ্রুত মামলা দায়ের ও নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ২০১০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ৯টি গ্রুপ, দুটি ব্যাংক ও এক ব্যক্তির নামে ৩১ হাজার কোটি টাকার জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে রয়েছে হলমার্ক গ্রুপ, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, ক্রিসেন্ট গ্রুপ, অ্যানন টেক্স গ্রুপ, এসএ গ্রুপ, সিটিসেল, সানমুন গ্রুপ, নুরজাহান গ্রুপ, ইমাম গ্রুপ এবং পি কে হালদার। এছাড়া ব্যাংক জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে দুটি। এর মধ্যে রয়েছে বেসিক ব্যাংক ও ফারমার্স ব্যাংক।

সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ) থেকেও বিভিন্ন ঋণ জালিয়াতির ঘটনা তদন্ত করে দুদকে প্রতিবেদন পাঠানো হচ্ছে। দুদক সেগুলোর আলাদা আলাদা ঘটনা পুনরায় অনুসন্ধান করে মামলা করছে। এছাড়া সিআইডিও দুর্নীতির বিভিন্ন ঘটনা তদন্ত করছে।

বিভিন্ন সংস্থার দায়ের করা ঋণ জালিয়াতির মামলায় এখন পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংকের ১২৫ কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নন-ব্যাংকিংসহ অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ২২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদের অনেকে এখন জেলে রয়েছেন। কেউ কেউ জামিনে বের হয়েছেন।

ঋণ জালিয়াতির বিষয়ে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৩৫টি মানিলন্ডারিং মামলার অনুসন্ধান করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এর মধ্যে ৩৫টির কাজ শেষে প্রতিবেদন দাখিল করেছে। নিম্ন আদালত থেকে রায় হয়েছে ৯টি মামলার। বাকিগুলো বিচারাধীন। এসবের মধ্যে বেশ কয়েকটি মামলার সাক্ষীর জেরার কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। করোনার কারণে গত দুই বছর ধরে মামলার শুনানি ও তদন্ত কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। এ কারণে মামলার নিষ্পত্তি কম হচ্ছে। এছাড়া অনেক সময় সাক্ষী আদালতে আসছেন না, বিচারক থাকছেন না। কাজেই মামলার নিষ্পত্তি কম।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App