মানব পাচার রোধে উদ্যোগ নিন
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০২১, ০১:২২ এএম
মানব পাচার কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না। দেশের ভাবমূর্তির ওপর তা আঘাত হানছে। দেশে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র সীমিত হয়ে পড়ায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইউরোপমুখী হওয়ার প্রবণতা বরং মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। বাংলাদেশ থেকে লিবিয়া এবং সেখান থেকে দুস্তর মরুপথ পাড়ি দিয়ে ভূমধ্যসাগর তীর থেকে নৌকাজাতীয় জলযানে ঝুঁকিপূর্ণ পথে ইউরোপে পাড়ি জমানো নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এভাবে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে ইতোমধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন শত শত যুবক। হতভাগ্য যুবকদের একাংশকে জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনাও ঘটেছে। লিবিয়া থেকে ইতালির উদ্দেশে শনিবার ৯২ বাংলাদেশিসহ ১৬০ জনের দল নিয়ে যাত্রা করে একটি নৌকা। প্রায় ১৮ ঘণ্টা নৌকাটি চলার পর হঠাৎ ইঞ্জিনে সমস্যা দেখা দেয়। এ অবস্থাতেই নৌকাটি চার দিন তিউনিসিয়া উপকূলে ভাসতে থাকে। পরে তিউনিসিয়ার কোস্টগার্ড তাদের উদ্ধার করে। লিবিয়ার প্রশাসন মাঝেমধ্যেই অভিযান চালিয়ে মানব পাচারে জড়িতদের ধরলেও বন্ধ হচ্ছে না পাচার। এসব অভিযানে বাংলাদেশিসহ অন্য দেশের যেসব নাগরিক মরণযাত্রায় মেতেছেন তাদের ধরে কারাগারে নিয়ে রাখা হচ্ছে মাসের পর মাস। টাকার বিনিময়ে তাদের অনেকে ছাড়া পাচ্ছেন। এতে দালালদের ব্যবসা জমছে। তিউনিসিয়ার ডিটেনশন সেন্টারগুলোরও একই অবস্থা। অর্থনৈতিকভাবে যেসব দেশ দ্রুত অগ্রগতি লাভ করছে তাদেরই দলে বাংলাদেশ। কিন্তু এ দেশ থেকে মানব পাচারের ঘটনা শ্রীবৃদ্ধির সুনাম প্রকারান্তরে কলুষিত হচ্ছে। ভুল বার্তা যাচ্ছে বিশ্বসমাজে। দেশের সুনামের স্বার্থে মানব পাচার সম্পর্কে সরকারকে কড়া হতে হবে। এর পাশাপাশি কেন মানুষ ঝুঁকিপূর্ণ পথে অবৈধভাবে বিদেশে পাড়ি জমাতে চাচ্ছে সে কারণও উদ্ঘাটন করতে হবে। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে যে সংকট চলছে তার গ্রন্থিমোচনের উদ্যোগ নিতে হবে দ্রুত। মানব পাচার একটি বৈশ্বিক সমস্যার নাম। বিশ্বের গরিব দেশগুলো এ সমস্যার নিত্যকার শিকার। বাংলাদেশের মানুষও এর ব্যতিক্রম নয়। মানব পাচারকারীদের পাল্লায় পড়ে এ দেশের শত শত শিশু একসময় মধ্যপ্রাচ্যে উটের দৌড় প্রতিযোগিতায় জকি হতে বাধ্য হয়েছে। এদের কেউ কেউ দৌড় প্রতিযোগিতার সময় আতঙ্কে প্রাণ হারিয়েছে। ইউরোপে কর্মসংস্থানের আশায় ঝুঁকিপূর্ণ পথে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেয়ার সময় অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন জাহাজ বা নৌকাডুবিতে। এ পর্যন্ত ইউরোপে মানব পাচারের সময় নৌকা বা জাহাজডুবিতে যারা মারা গেছেন তার সিংহভাগ বাংলাদেশি। টাকা দিয়ে তারা নিজেদের অজান্তে কিনেছেন মৃত্যুর টিকেট। ইউরোপ যাওয়ার নামে সাহারা মরুভূমি পাড়ি দিতে গিয়ে বেঘোরে প্রাণ হারিয়েছেন অনেক যুবক। মালয়েশিয়ায় চাকরির আশায় অবৈধ পথে সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে ট্রলারডুবিতে কত মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে তার হিসাব নেই। পাচারকারীদের পাল্লায় পড়ে থাইল্যান্ডের গহিন জঙ্গলে পণবন্দি হয়ে জীবনদান কিংবা ক্রীতদাসের জীবন বরণ করার ঘটনাও কম নয়। বাংলাদেশের প্রতি ১৭ জনের একজন এখন বিদেশে কর্মরত। বিদেশে প্রায় ১ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেছে। এ ব্যাপারে জনশক্তি রপ্তানির সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর অবদান যেমন অনস্বীকার্য তেমন আদম বেপারি নামের প্রতারকদের প্রতারণাও অনেক বিয়োগান্ত ঘটনার জন্ম দিয়েছে। বিদেশে চাকরি দেয়ার নাম করে লাখ লাখ টাকা নিয়ে উধাও, চাকরি না দিয়ে প্রতারণা শুধু নয়, জীবন কেড়ে নেয়ার ঘটনাও অনেক ঘটেছে। সাম্প্রতিক সময়ে জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে দুর্নীতি তুলনামূলকভাবে হ্রাস পেলেও থেমে নেই মানব পাচারের ঘটনা। লিবিয়া থেকে নৌকায় ইউরোপে সাগর পাড়ি দেয়ার ঘটনা বেড়েছে ব্যাপক হারে। মানব পাচার একটি জঘন্য অপরাধ। এ ঘৃণ্য অপরাধে যারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করে বিচারের মাধ্যমে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে- এমনটিই কাম্য। এটা মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশে যদি পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা থাকত, তাহলে এভাবে মানুষকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিদেশে যাওয়া লাগত না। আমরা চাই সরকার এ ব্যাপারে দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করুক। সরকার যদি ব্যাপকভাবে শিল্পায়নের দিকে বিশেষ নজর দেয়; তাহলে অবৈধ পথে বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা অনেকটাই কমে আসবে। পাশাপাশি যেসব দালাল ও অপরাধী এর সঙ্গে যুক্ত তাদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। কিছুদিন আগের ঘটনায় ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে যারা মারা গেছে তারা প্রত্যেকে ৭-৮ লাখ টাকা দালালদের দিয়েছে। এই বিপুল অঙ্কের টাকা হয় ফসলি জমি ভিটাবাড়ি বিক্রি করে, না হয় ঋণ করে জোগাড় করেছিল। ওই পরিবার এখন নিঃস্ব সর্বস্বান্ত শোকগ্রস্ত। একটি ভুল সিদ্ধান্তের কারণে পুরো পরিবার পথে বসে গেল। ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবির শিকার হয়ে একটি স্বপ্নের সম্ভাবনার অকালমৃত্যু হলো। এর দায় কে নেবে?
আর কে চৌধুরী : লেখক,মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ। [email protected]