×

মুক্তচিন্তা

বিশ্ব শিক্ষক দিবস : শিক্ষকদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন করার প্রতিশ্রুতির দিন

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০২১, ০১:২৪ এএম

আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবস। শিক্ষকদের মূল্যায়ন, গুরুত্ব প্রদান এবং তাদের অবদানের কথা স্মরণের দিন। দুনিয়াব্যাপী করোনার হানা গোটা বিশ্বের শিক্ষা খাতকে বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে। মহাচ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করেছে গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকে। এখানে থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে শিক্ষকদেরই মূল ভূমিকা পালন করতে হবে। আর তাই বিশ্ব শিক্ষক দিবসের সেøাগান হচ্ছে- ‘ঞবধপযবৎং ধঃ ঃযব যবধৎঃ ড়ভ বফঁপধঃরড়হ ৎবপড়াবৎু’. শিক্ষার ক্ষতি কাটিয়ে উঠানোর মূলে রয়েছেন শিক্ষকরাই। পৃথিবীর অনেক দেশই জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগিয়েছে অনেক, অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশালীও হয়েছে কিন্তু শিক্ষকদের এবং শিক্ষার বিষয়টিকে সেভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। খুব কমসংখ্যক দেশে শিক্ষককে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা হয়। ওইসব দেশে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়াও ভিন্ন, যে কেউ ইচ্ছা করলেই শিক্ষক হতে পারেন না। অনেক দেশ ওইসব দেশের মতো শিক্ষকের মান-মর্যাদা ও রাষ্ট্রীয় সুবিধা দাবি করে কিন্তু গ্যাপটি পূরণ করার কথা বলেন না। আমাদের দেশের শিক্ষকদের বিরাট অংশ বিশেষ করে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে বেসরকারি ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে শিক্ষাদান করছেন। ফলে প্রতিষ্ঠান কমিটি, সভাপতি শিক্ষদের ওপর, প্রধান শিক্ষক ও অধ্যক্ষদের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করেন। সেই বিচারে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সবাই চাচ্ছেন যে, এসব কমিটির হাতে যাতে শিক্ষার মতো মহান দায়িত্ব অর্পণ করা না হয়। কিন্তু কায়েমি স্বার্থের তাগিদে সেটিই যেন চলছে। এ থেকে শিক্ষকদের মুক্তি কিসে? শিক্ষাকে জাতীয়করণ করা হলেই সব শিক্ষক তাদের সম্মানের জায়গায় অধিষ্ঠিত হতে পারবেন? অর্থনৈতিক মুক্তিও অনেকটাই নিরাপত্তার প্রতীক হিসেবে তারা এটি চাচ্ছেন। কিন্তু শিক্ষকরা সরকারি হোক আর বেসরকারিই হোক তাদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা রাষ্ট্রকেই নিশ্চিত করতে হবে। সেটি রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকেই হোক আর রাষ্ট্র ও কমিউনিটির যৌথ উদ্যোগেই করা হোক না কেন, শিক্ষকদের যাতে অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে না হয়। শিক্ষা জাতীয়করণ করার অর্থ হচ্ছে শিক্ষার সার্বিক দায়িত্ব রাষ্ট্রের- শিক্ষকদের চাকরি, চাকরির শর্তগুলো, সুবিধা-অসুবিধা, শিক্ষার্থীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়ে আসা, অভিভাবকদের উদ্বুদ্ধ করা এসব কিছুই রাষ্ট্রের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এ বিষয়টি কিন্তু হচ্ছে না সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, শিক্ষার মানের সঙ্গে এগুলোর সম্পর্ক রয়েছে, তাই মানসম্মত শিক্ষা কিন্তু হচ্ছে না। আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক এবং দেশের প্রায় ৬৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারি, সেখানে কি মানসম্মত শিক্ষাদান হচ্ছে? শিক্ষকদের চাকরির নিরাপত্তা বিধান করা হয়েছে কিন্তু পুরো ব্যবস্থাপনায় তার প্রতিফলন ঘটেনি, আর তাই মানসম্মত শিক্ষাদানও হচ্ছে না। সরকারি করায় অনেক ভালো ভালো শিক্ষক কিন্তু এখানে যোগদান করেছেন, এটি আনন্দের সংবাদ। কিন্তু পুরো ব্যবস্থাপনায় তার ছাপ এখনো পড়েনি। পেশাগত উন্নয়নের বিষয়টি জীবনব্যাপী। ব্যতিক্রম ছাড়া অনেক শিক্ষকের ভেতর এ ধরনের তাড়না দেখা যায় না। নিজের দক্ষতা উন্নয়নের জন্য, শিক্ষার্থীদের আনন্দদায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য দুনিয়ার অন্যান্য দেশে কী হচ্ছে, আধুনিক শিক্ষা মতবাদ কী কী চালু রয়েছে, নতুন কী আবিষ্কৃত হয়েছে- এগুলো জানার জন্য অনন্য ব্যতিক্রমধর্মী দু-চারজন শিক্ষক ছাড়া বাকিদের কাছে এসব বিষয় নিছক তুচ্ছের কিংবা অনাকাক্সিক্ষত বলে মনে হয়। তার মধ্যে কিছু শিক্ষককে দেখেছি অনেক বাধা-বিপত্তি ও প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও উন্নত বিশ্বের অনুকরণে নিজেদের প্রচেষ্টায় এই করোনাকালেও শিক্ষার্থীদের জন্য, নিজেদের পেশাগত উন্নয়নের জন্য, দেশের শিক্ষার জন্য ম্যাটেরিয়ালস তৈরি করে ক্লাস করিয়েছেন, শিক্ষার্থীদের ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করেছেন। তারাই কিন্তু প্রকৃত শিক্ষক। শিক্ষক নেতাদের মধ্যে একাডেমিক কোনো বিষয় খুব একটা গুরুত্ব পায় না। দেশে যে দু-চারটি অনলাইন শিক্ষা পত্রিকা বা পোর্টাল আছে সেগুলো ওপেন করলেই দেখা যায় শিক্ষকদের শুধু আর্থিক লাভের বিষয় ছাড়া শিক্ষক নেতাদের সেখানে আর তেমন কিছু লেখেন না, বলেন না। শিক্ষকদের অর্থনৈতিক ও বৈষয়িক দাবি-দাওয়া আদায়ের কথা ছাড়া শিক্ষক নেতাদের তেমন কোনো কথা দেখা যায় না। দেশের বিভিন্ন স্তরের শিক্ষায় পাঠদানরত শিক্ষকদের মানের বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আছে বহু বছর ধরেই। এ বিষয়টি আজকের দিনে আমাদের মনে রাখতে হবে। আমরা যাদের জন্য, যে প্রজন্মকে শিক্ষিত করব তাদের সন্তুষ্টির বিষয়টি অধিকতর গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে এবং নিজেদের সেভাবে প্রস্তুত করতে হবে। আমাদের শিক্ষকদের মধ্যে বড় একটা অংশ ঘটনাচক্রে শিক্ষক। অন্য কোনো পেশায় অনেকেই যেতে পারেননি, শিক্ষকতা কোনোদিন তারা চাননি। আমাদের প্রশিক্ষিত শিক্ষক প্রয়োজন। যিনি শিক্ষকতা পেশায় আসবেন তার জীবনের লক্ষ্যই হবে শিক্ষকতা পেশা। তিনি সেই লক্ষ্য নির্ধারণ করে আসবেন- এমনটি বলেছেন খোদ শিক্ষামন্ত্রী। ঘটনাচক্রে শিক্ষক অর্থাৎ অধিকাংশ শিক্ষিতই শিক্ষক হতে চান না আবার যারা শিক্ষক হন তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েও মেরুদণ্ডহীন এবং ছাত্রনেতাদের কথায় ওঠেন আর বসেন। এ অবস্থা তো জতির জন্য চরম অবমাননাকর, চরম অবক্ষয়ের কথা। কিন্তু শিক্ষকরা আমাদের সমাজের আলোকবর্তিকা। শিক্ষকদের আলোকবর্তিকার মতো জ¦লতে দিলে সমাজও আলোকিত হবে। রাষ্ট্রকে সেই উদ্যোগ নিতে হবে। শিক্ষকদের পেশাগত ও বিষয়ভিত্তিক উন্নয়ন, তথ্যপ্রযুক্তির নিবিড় পরিচিতি ও একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য এবং শিক্ষার্থীদের সেভাবে প্রস্তুত করার জন্য নিজেদেরই প্রস্তুত করতে হবে। প্রতিষ্ঠান কখন এটি করে দেবে, রাষ্ট্র কখন করবে সে আশায় বসে থাকলে হবে না। কিছু কিছু শিক্ষকের মধ্যে এ ধরনের আগ্রহ বেশ লক্ষ করা যাচ্ছে। সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের মধ্যে, বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকদের মধ্যে বেশ আগ্রহ লক্ষ করা যাচ্ছে। আবার এটিও লক্ষ করা যাচ্ছে যে, আমি পেশাগত উন্নয়নের জন্য চেষ্টা কেন করব, আমার বেতন কি বাড়বে? এ রকম কথা যখন শিক্ষকদের মুখে শোনা যায়, তখনই পেশার প্রতি তাদের অনুরাগ কতটা আছে তা বোঝা যায়। আবার কিছু কিছু অথরিটি আছে যারা শিক্ষকদের বিভিন্ন পেশাগত উন্নয়নের প্ল্যাটফর্মে যোগ দিতে নিরুৎসাহিত করেন, এমনকি বাধা দেন। এ যুগে এটি ঠিক নয়। একজন শিক্ষক আধুনিকতার সঙ্গে পরিচিত না হলে শ্রেণিকক্ষে তিনি কী পড়াবেন? শুধু বইয়ের পাঠে নিবদ্ধ থাকলে যে একজন শিক্ষকের চলবে না, এ বিষয়টি বুঝতে হবে শিক্ষকদের এবং শিক্ষক প্রশাসকদের। বিশ্বের ধনী দেশের শিক্ষকরা কোভিড-১৯ পরিস্থিতির আগে থেকেই শিক্ষায় প্রযুক্তি ব্যবহারের সঙ্গে পরিচিত এবং সাধারণভাবেই তারা এগুলো ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশের শিক্ষকরা এগুলোর সঙ্গে একেবারেই পরিচিত ছিলেন না। কোভিড-১৯ আসার পর পৃথিবীব্যাপী যখন বিদ্যালয়ের দরজাগুলো বন্ধ হয়ে গেল তখন গুগল মিট, জুম ব্যবহার করে অতি অল্প সময়ের মধ্যে শহর, গ্রাম, উপশহরসহ সব এলাকার শিক্ষক বিষয়টি আয়ত্ত করে ফেলেছেন। তারা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে, অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে এবং ব্যক্তিগতভাবে এগুলো ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের ক্লাস পরিচালনা করেছেন। এটির অর্থ হচ্ছে তারা নতুন ডিভাইস ব্যবহার করার চমৎকার দক্ষতা প্রদর্শন করেছেন, যা এই যুগের শিক্ষকদের একান্তই প্রয়োজন। আমেরিকার এক গবেষণায় দেখা যায়, মানসম্মত শিক্ষার ২০ শতাংশ নির্ভর করে শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ এবং অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার ওপর। কিন্তু মানসম্মত শিক্ষার শতকরা ৮০ ভাগ নির্ভর করে শিক্ষকের ওপর। একজন যোগ্য শিক্ষক গাছতলায় বসেও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারেন। তার মানে হচ্ছে প্রকৃত শিক্ষকরা সমাজকে পরিবর্তন করতে পারেন। আমরা সমাজ, দেশ, বিশ্বের কাক্সিক্ষত ও পজিটিভ পরিবর্তন চাই। আর এ পরিবর্তনের মূল কারিগর হচ্ছেন শিক্ষকরা। তারা যে ধরনের মানবসম্পদ সৃষ্টি করবেন, সমাজে সরবরাহ করবেন, সমাজও সে ধরনের পরিবর্তন দেখতে পাবে। ইউনেস্কো কর্তৃক পরিচালিত জরিপে দেখা যায় আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বাংলাদেশের শিক্ষার মান ২.৮ শতাংশ, ভারত ও শ্রীলঙ্কায় ২০.৮ শতাংশ এবং পাকিস্তানে ১১.৩ শতাংশ। এটিরও মূল কারণ কিন্তু শিক্ষক। অর্থাৎ সমাজকে পরিবর্তন করতে হলে, মানুষের জীবন মান পরিবর্তন করতে হলে শিক্ষকদের উন্নয়ন অপরিহার্য।

মাছুম বিল্লাহ : শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App