×

মুক্তচিন্তা

করোনার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এখনই নীতি কৌশল গ্রহণ জরুরি

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০২১, ০১:২৪ এএম

দেড় বছরেরও অধিক সময় ধরে করোনার দুই ঢেউ দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষাসহ সব ক্ষেত্রেই মারাত্মক অভিঘাতের সৃষ্টি করেছে। ক্ষতি হয়নি রাষ্ট্রের এমন কোনো খাত নেই। সাধারণ মানুষও কমবেশি বিপর্যয়ের শিকার হয়েছে। এখন করোনা সংক্রমণের গতি অনেকটাই কমে এসেছে। সব কিছু খুলে দেয়া হয়েছে। তবে নতুন করে করোনার কোনো ঢেউ আবার ফণা তুলবে না এর নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারছে না। তারপরও সবকিছু খুলে দিতে হয়েছে। কারণ আর যেন কিছুতেই চলছিল না। সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা বড় ধরনের হুমকির মধ্যে পড়েছে। করোনার সঙ্গে বসবাসের ঝুঁকি মাথায় নিয়েই সবকিছু খুলে দিতে হয়েছে। একটি ভরসার জায়গা এরই মধ্যে তৈরি হয়েছে- ব্যাপক হারে টিকাকরণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, মানুষও টিকা নেয়ার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছে। বিশেষত ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট আসার আগে যারা অ্যাস্ট্রাজেনেকার দুই ডোজ টিকা নিয়েছেন তাদের সংক্রমণের হার কম এবং যারা কোনো টিকা নেয়নি তাদের মধ্যে সংক্রমণ ও মৃত্যুর ঝুঁকি দেখার পর সাধারণ মানুষ বুঝতে পেরেছেন যে টিকা অনেকটাই সুরক্ষা দেয়ার জন্য প্রয়োজন, বাকিটা মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করার ওপর নির্ভর করবে। এমন বাস্তবতায় এখন টিকার চাহিদা গ্রাম পর্যন্ত ব্যাপকভাবে লক্ষ করা যাচ্ছে। তবে যথারীতি স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণে বেশিরভাগ মানুষই ভীষণভাবে উদাসীন। এ কারণেই টিকা দেয়ার পরও নতুন করে সংক্রমণ ফিরে আসবে না এমন শতভাগ নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারছে না। আমরা আশা করব আবার যেন করোনার নতুন কোনো ঢেউ আমাদের ওপর আছড়ে না পড়ে। গত দেড় বছরের অধিক সময় ধরে সারা পৃথিবী করোনার সঙ্গে যুদ্ধ করছে, আমরাও করে যাচ্ছি। আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, জীবন-জীবিকার নানা ক্ষেত্র একাবারেই এলোমেলো হয়ে গেছে, অনেক মানুষ কর্মহারা হয়েছেন, অনেকের পুঁজি তলানিতে ঠেকেছে। বেকারত্ব তাই শহর, গ্রামসহ সর্বত্র বেড়ে গেছে। কেউ বলছেন প্রায় দুই কোটির মতো মানুষ এখন অনেকটাই কাজের সন্ধানে নেমেছে। করোনার আগে আমাদের অর্থনীতির যে গতি ছিল তাতে শ্রমজীবী মানুষের হাতে কমবেশি ভালোই কাজকর্ম ছিল, আয়-উপার্জনও মন্দ ছিল না। হতদরিদ্র পরিবার বলতে তেমন বেশি খুঁজে পাওয়া যেত না। কিন্তু করোনা প্রান্তিক মানুষের জীবনের আগের অবস্থাটি কেড়ে নিয়ে গেছে। সে কারণেই দ্রুত এই বিপুলসংখ্যক মানুষকে তাদের সংস্থান করার নানা উদ্যোগ, যারা ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তা তারা যেন নিতে পারে সেই ব্যবস্থা করে দেয়া একান্ত জরুরি। এছাড়া অসংখ্য শিশু, কিশোর ও তরুণ শিক্ষাজীবন থেকে ছিটকে পড়েছে। তাদের শিক্ষায় ফিরিয়ে নেয়া আবার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পরিবারের হাল ধরতে এখনই কাজের সন্ধানে আছে। তবে স্বীকার করতেই হবে টানা দেড় বছর করোনার সঙ্গে যুদ্ধ অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে প্রান্তিক মানুষজনও না খেয়ে মরার পর্যায়ে পড়েনি। আমাদের রাষ্ট্রের যেমন খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে একইভাবে হতদরিদ্রদের সরকারসহ ব্যক্তি ও সংগঠনগতভাবে অনেকেই সহযোগিতা করেছে। সুতরাং এই মানুষগুলো এখন নতুন উদ্যমে বেঁচে থাকার জন্য কাজের সন্ধান করছে, ধীরে ধীরে অনেকেই এখানে সেখানে যুক্ত হচ্ছে। এর স্থায়িত্ব নির্ভর করবে আগামী দিনগুলো করোনা মুক্তভাবে কতটা থাকবে তার ওপর। সব বিশেষজ্ঞই মনে করেন যে বাংলাদেশের ছোট-মাঝারি ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প এবং উৎপাদন ব্যবস্থা ঘুরে দাঁড়াতে খুব বেশি সময় নেবে না। অন্তত ৬ মাস নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজকর্ম স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারলে অনেক কিছুই পুষিয়ে নেয়া সম্ভব হতে পারে। বাংলাদেশের এখন সেই সক্ষমতা রয়েছে। এর জন্য প্রয়োজন সরকারের দৃঢ় নীতি ও কৌশল প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা, সরকারের মধ্যে নতুনভাবে দেখা প্রয়োজন কোন কোন মন্ত্রণালয় বেশ বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে আছে। বিশেষত সাধারণ মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী এখন বাজারে অপ্রত্যাশিতভাবে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা ধরে রেখেছে। গোটা ব্যবসা-বাণিজ্যের মধ্যে এখন আর আগের মতো সরকারি তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ কার্যকর নেই, বাজারে সিন্ডিকেট নামক একটি কৃত্রিম ব্যবস্থা হরহামেশাই ভোক্তাকে নাজেহাল করে ছাড়ছে। দেশে এত খাদ্য উৎপাদন হওয়ার পরও বাজারে চালের দাম কমছে না। করোনার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বড়, মাঝারি ও ছোট ব্যবসায়ীরা যে যার মতো করে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে, ভোক্তাদের পকেট খালি করছে। নানা অজুহাত দেখালেও এসব অজুহাতের বাস্তব কোনো ভিত্তি নেই। ফলে বেশিরভাগ সাধারণ মানুষের হাতে যখন আগের মতো অর্থ নেই তখন মুক্ত বাজার অর্থনীতির নামে বাজারে যা চলছে তা সাধারণ মানুষের জীবনকে আরো বেশি কষ্টের মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। এ কথা স্বীকার করতে হবে যে করোনার এই দেড় বছর দেশে মানুষের আয়-উপার্জন কমেছে, দারিদ্র্যের হারও বেড়েছে, অন্যদিকে কৃত্রিম সংকট বৃদ্ধি করে অনেকেই প্রচুর অর্থ কামিয়ে নিয়েছে সে কারণে কোনো কোনো পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে যে ব্যবসা-বাণিজ্যে ও সাধারণ ও ই-কমার্সের নামে কিছু কিছু খাতে এই সময়ে ধনী লোকের সংখ্যাও বেড়েছে। এছাড়া ঘুষ, দুর্নীতি, অবৈধ উপার্জন ইত্যাদির মাধ্যমে যারা অর্থবিত্ত হাতিয়ে নেয় তাদের সংখ্যাও এই সময়ে কমেনি। দেশে প্রতারক, দালাল, লুটপাটকারী ও প্রভাবশালীর সংখ্যা করোনার এই অতিমারির সময়ে কমেনি। বরং গণমাধ্যমের কল্যাণে বাড়তে দেখা যাচ্ছে। করোনার চিকিৎসার নামে অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আয়-উপার্জন বাড়াতে পেরেছে, সাধারণ রোগীদের নানাভাবে বাড়তি অর্থ খরচে পড়তে হয়েছে। এমনিতেই গত দেড় বছর কোভিড চিকিৎসার সম্প্রসারণের কারণে অন্যান্য চিকিৎসার সুযোগ অনেক ক্ষেত্রেই কমেছে, আবার নেয়াও সম্ভব হয়নি। ফলে চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর যে চাপটি পড়েছে সেটি নতুনভাবে ঢেলে না সাজালে এখনই জরুরি ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা লাভে অনেকেই নানা সমস্যায় পড়তে যাচ্ছেন। যাদের অর্থবিত্ত বেশি তারা আবার আগের মতো বিদেশে চিকিৎসা নেয়ার জন্য চলে যাচ্ছেন। কিন্তু গত দেড় বছরে দেশে থেকে অনেকেই চিকিৎসা নিতে বাধ্য হয়েছে। এতে অন্তত বিপুলসংখ্যক বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে যেতে পারেনি। সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বোধহয় এ নিয়ে নতুনভাবে চিন্তাভাবনা করা প্রয়োজন রয়েছে। তাহলে দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থা নিজের পায়ে আরো সাফল্য নিয়ে দাঁড়াতে পারবে। সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষার মধ্যে পড়তে যাচ্ছে আমাদের গোটা শিক্ষাব্যবস্থা। একটা বিশালসংখ্যক শিক্ষার্থী আদৌও আর শিক্ষাজীবনে ফিরে আসতে পারবে কিনা তা এখনো বোঝা যাচ্ছে না। তবে বাল্যবিয়ের কবলে পড়ে অসংখ্য ছাত্রীর শিক্ষাজীবন স্কুল শেষ করার আগেই শেষ হয়ে গেছে। এর একটি নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া শিক্ষার ওপর পড়তে যাচ্ছে। সমাজও এর থেকে মুক্ত থাকতে পারবে না। সুতরাং শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সমাজব্যবস্থা নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নতুন করে কর্মপদ্ধতি উদ্ভাবন করতে হবে। নির্বাচনের এখনো দুই বছর বাকি। এরই মধ্যে বিরোধী বড়, ছোট সব পক্ষ নির্বাচন কমিশন, আগামী নির্বাচন ইত্যাদি নানা ইস্যুতে বেশ সরব হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে এসব ইস্যুতে আবার দেশে একটি অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরি করার চেষ্টা করা হতে পারে। সাধারণ মানুষ করোনার ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার জন্য এখন যারপরনাই চেষ্টা করে যাচ্ছে। রাজনীতির প্রতি তাদের আগ্রহ তেমন নেই। কিন্তু তাই বলে সরকারের স্বস্তিতে থাকার সুযোগ আছে বলেও মনে করি না। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে নতুন পরিস্থিতিতে করণীয় নিয়ে কোনো উদ্যোগ আছে কিনা তা স্পষ্ট নয়। সে কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আগামী ২ বছরের জন্য দেশের সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনা করে সরকারব্যবস্থাকে কীভাবে আরো কার্যকর এবং জনবান্ধব হয়ে ওঠার মতো পরিবেশ পরিস্থিতি অক্ষুণ্ন রেখে চলে সেটি বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। প্রয়োজনে এখনই মন্ত্রিপরিষদের কর্মকাণ্ড মূল্যায়ন করে যেখানে অতিরিক্ত উদ্যোগ নেয়া দরকার, সেখানে তাই করা উচিত। যেসব মন্ত্রণালয় নিয়ে মানুষের মধ্যে প্রশ্ন আছে সেগুলোর কর্মকাণ্ডে গতি সৃষ্টির জন্য মন্ত্রিপরিষদে নতুন মুখ এবং দক্ষ ও অভিজ্ঞদের দিয়ে পুনর্গঠনের বিষয়টিও বিবেচনা করা যেতে পারে। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ারভুক্ত, তিনি এর ভালো-মন্দ আমাদের চেয়ে ভালো জানেন। সুতরাং সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টি তিনিই বুঝেশুনে নেবেন। তবে সামনের দুই বছর বেশ কঠিন একটি সময় অতিক্রম করার জন্য তার শুভানুধ্যায়ী এবং রাজনীতি সচেতন মহল সরকারের দৃঢ় কর্মকৌশল বাস্তবে প্রয়োগ ঘটবে বলে আশা করেন। সবকিছুই স্বাভাবিক থাকবে যদি দেশের অর্থনীতি, দ্রব্যমূল্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং ব্যবসা-বাণিজ্য দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাওয়ার অনুকূল পরিবেশ পায়। সেটি অবশ্যই নির্ভর করবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং অংশীজনদের কাজের গতি স্বাভাবিক থাকার ওপর। এই চ্যালেঞ্জগুলো খুব গভীরভাবে পরিস্থিতি ও বাস্তবতা বিচার বিশ্লেষণ করে গ্রহণ করার ওপর।

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App