×

জাতীয়

বিশ্ব শিশু দিবস আজ: করোনা মহামারির বিরূপ প্রভাবে বিপর্যস্ত শিশুরা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০২১, ০৮:৩৬ এএম

করোনা ভাইরাসে শিশুরা অপেক্ষাকৃত কম আক্রান্ত হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে বিষয়টি স্বস্তিদায়ক মনে হলেও করোনাভাইরাসের বিরূপ প্রভাব অনেকটা নীরবেই পড়েছে শিশুদের ওপর।

পরিসংখ্যান বলছে, দেশের মোট জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশ ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু। করোনা মহামারির বিরূপ প্রভাব শিশুদের ওপর ভালোভাবে পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্ষুধা, অপুষ্টি, বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া, একাকিত্ব, শিশুশ্রম, বাল্যবিয়ে, নির্যাতনের ও পাচারের শিকার হওয়াসহ মহামারির ধাক্কা নানাভাবে পড়েছে শিশুর জীবনে। অনেক শিশু অনাথ হয়েছে এই করোনাকালে। করোনা মহামারি শিশুদের স্বাভাবিক জীবনে প্রভাব তো ফেলেছেই, বাধাগ্রস্ত করেছে তাদের সুষ্ঠু বিকাশেও।

২০২০ সালে আন্তর্জাতিক সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন প্রকাশিত এক জরিপ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ৬৪ শতাংশ শিশু ও তাদের পরিবার কঠিন খাদ্য সংকটে রয়েছে। জাতিসংঘের শিশু সংস্থা ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনাকালে যাবতীয় উদ্যোগ ও লক্ষ্য মহামারি মোকাবিলায় কেন্দ্রীভূত হওয়ায় প্রকট হয়ে ওঠে শিশুদের পুষ্টিহীনতাজনিত নানা সমস্যা। বিশেষ করে শিশুদের ওজনস্বল্পতার সমস্যা এ সময় আগের চেয়ে বেড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মাল্টিপল ক্লাস্টার ইন্ডিকেটর সার্ভে-২০২০ (এমসিআইএস) ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইভ ডাটার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৯ সালে দেশের ৫ বছর পর্যন্ত বয়সি শিশুদের ২২ দশমিক ৬ শতাংশের ওজন ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে কম। ২০২০ সালে তা ৬ দশমিক ৪ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৯ শতাংশে।

করোনাকালে বাল্যবিয়ে বেড়েছে। গত দুই বছরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় উঠে এসেছে, বাংলাদেশে ৫৯ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয় ১৮ বছরের আগে এবং ২২ শতাংশ মেয়ের ১৫ বছরের আগে। কিন্তু করোনাকালে ১৩ শতাংশ বাল্যবিয়ে বেড়েছে- যা ২৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। কোভিড-১৯ ও বাল্যবিয়ের সম্পর্ক নিয়ে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের এক জরিপ বলছে, দেশের সবচেয়ে বেশি বাল্যবিয়ে কুড়িগ্রামে হলেও করোনাকালে দেশের প্রতিটি জেলায় এর হার বেড়েছে। করোনাকালে নিবন্ধিত বিয়ে কমছে; বাড়ছে অনিবন্ধিত বিয়ের সংখ্যা, যার মূলত পুরোটাই বাল্যবিবাহ।

বাল্যবিয়ে বেড়ে যাওয়ায় পরিণত বয়সের আগেই গর্ভধারণ করছে অনেকে। ওই অপ্রাপ্তবয়স্ক নারীর গর্ভের শিশুও জন্ম নিচ্ছে অপুষ্টি ও ওজনহীনতাকে সঙ্গে করে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন স্বাস্থ্যবিষয়ক গবেষণা সাময়িকী দ্য ল্যানসেটের মতে, উচ্চতায় যে দেশের মানুষরা এগিয়ে তাদের তুলনায় যে চারটি দেশের ছেলেমেয়েরা নিম্নমানের পুষ্টির কারণে সাত ইঞ্চির বেশি উচ্চতা হারাচ্ছে তার মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। শুধু তাই নয়, ঘরবন্দী হয়ে থাকায় শিশুদের মধ্যে মুটিয়ে যাওয়ার প্রবণতাও বেড়েছে। দীর্ঘদিনের আবদ্ধ অবস্থা শিশুর সব ধরনের বিকাশ বাধাগ্রস্ত করেছে। মোবাইল, কম্পিউটারসহ ইলেক্ট্রনিক্স ডিভাইসের ওপর শিশুদের আসক্তি বেড়েছে। কোভিড-১৯ এর কারণে দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় পড়াশোনার সাথে সম্পর্ক ছিলো না বেশিরভাগ শিশুর। বেসরকারি সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) বলছে, বাংলাদেশে সাধারণভাবে প্রাথমিক পর্যায়ে ড্রপআউট (ঝরে পড়া) শতকরা ১৭ ভাগ। মাধ্যমিক পর্যায়ে ৩৭ ভাগ। করোনায় যা বেড়েছে।

করোনাকালে শিশুর উপর সহিংসতাও বেড়েছে। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের এক জরিপে বলা হয়, বাল্যবিয়ে বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে বেড়েছে নারী নির্যাতনের হারও। বেসরকারি এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের ৫ থেকে ১২ বছরের শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের ৭০ শতাংশই যৌন নির্যাতনের শিকার। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত সাত মাসে ৪৬২ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এ সময় প্রায় ৮০০ শিশু শারীরিক ও যৌন নির্যাতনসহ নানা সহিংসতার শিকার হয়েছে। বেড়েছে শিশুশ্রমও। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০০০ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী শিশুশ্রমের হার কমেছিল ৯৪ শতাংশ কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারির কারণে এর প্রবণতা উল্টো পথে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

এই প্রেক্ষাপটে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব শিশু দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য হলো ‘শিশুর জন্য বিনিয়োগ করি, সমৃদ্ধ বিশ্ব গড়ি’। প্রতিবছর অক্টোবর মাসের প্রথম সোমবার বিশ্ব শিশু দিবস পালন করে থাকে। একই সঙ্গে আজ থেকে ১০ অক্টোবর পর্যন্ত সারাদেশে পালিত হবে শিশু অধিকার সপ্তাহ।

শিশুর অধিকার, সুরক্ষা, শিশুর উন্নয়ন ও বিকাশে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আরো বেশি উদ্যোগী ও সচেতন করার লক্ষ্যেই এই সপ্তাহ ও দিবস পালিত হয়ে থাকে। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতি বছরের মতো এ বছরও দেশব্যাপী এ উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছে। বিশ্ব শিশু দিবস ও শিশু অধিকার সপ্তাহের সঙ্গে আগামীকাল (৫ অক্টোবর) জাতীয় কন্যা শিশু দিবস উদযাপন করা হবে। বাংলাদেশ শিশু একাডেমি, ইউনিসেফ, দেশি ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার আয়োজনে বিশ্ব শিশু দিবস ও শিশু অধিকার সপ্তাহ উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে শিশুদের অংশগ্রহণে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও সচেতনতামূলক সভা, সুবিধাবঞ্চিত ও পথশিশুদের নিয়ে আলোচনা সভা ও চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ‘বিনিয়োগ হোক প্রারম্ভিক শৈশবেই’ শীর্ষক ওয়েবিনার এবং বাংলাদেশে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু প্রতিরোধে মতবিনিময় সভা। আরো আছে শিশুদের উন্নয়ন, বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ, সুরক্ষা ও অধিকার বিষয়ে ক্যাম্পেইন, জাতীয় পর্যায়ে পলিসি ডায়ালগ সেশন, বিতর্ক প্রতিযোগিতা। আলোচনা এবং মতবিনিময় সভায় শিশুসংগঠক, শিশু বিশেষজ্ঞ, শিশু সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত থাকবেন। এসব অনুষ্ঠান সরাসরি ও ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হবে।

বিশ্ব শিশু দিবস ও শিশু অধিকার সপ্তাহ-২০২১ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আলাদা আলাদা বাণী দিয়েছেন। এবং তাতে দেশ ও সারাবিশ্বের শিশুকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। বিশ্ব শিশু দিবসের অনুষ্ঠান ও টকশো বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশে বেতারসহ বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশনে প্রচারিত হবে। বিশেষ ক্রোড়পত্র ও স্মরণিকা প্রকাশ এবং আলোকচিত্র প্রদর্শন করা হবে। এছাড়া পোস্টার, পিভিসি ও ফেস্টুন-ব্যানার স্থাপনের মাধ্যমে বিভিন্ন ভবন ও ঢাকার প্রধান প্রধান সড়কদ্বীপ সাজানো হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App