×

মুক্তচিন্তা

ওরা পঞ্চ তারকা

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০২১, ১২:২৭ এএম

ওরা পঞ্চ তারকা
না বন্ধু না। ওরা বলছি, ওরাং-ওটাং হনুমান বলছি না। অনেক কালের কাছের মানুষরাও আজকাল সন্দেহ আর মিছে কথার ভর্তা বানিয়ে সুস্বাদু ভোজন সারে। তাই সত্যি বলছি, ওরাই বলেছি। ওরাং-ওটাং হনুমান নয়। যদিও দেশ-জাতি-জনগণের ঘাড়ে ওরা সেই ১৯৫৮ থেকে ১/১১ পর্যন্ত হঠাৎ-ঝটাং লাফিয়েই পড়েছে মোট পাঁচবার। আমরা পঞ্চ তারকা পেয়েছি সামরিক ইউনিফর্মে নানা সংখ্যার তারকা পরা মানব-দরবেশদের মধ্য থেকেই। ১৯৫৮ সালে সাত বছরের বালক। তেমন কিছু বুঝতাম না। তবু মনে আছে একজন বিরাট সেনাপতি পাকিস্তানের দুই অংশের ওপর দুই ঠ্যাং ছড়িয়ে দিয়েছে। দুই অংশের রাজনীতিবিদদের ঘাড় মটকে দিয়েছে। খুলনার ভয়ংকর মুসলিম লীগ নেতা আগে খান পিছে খান সবুর মিয়া। বেতের বেধড়ক পিটুনিতে কাকুর পিঠের ছাল তুলে ফেলেছে সামরিক শাহী। দেশজুড়ে বড় বড় নেতাদের পাকড়াও করেছে। মাঝারি এবং পাতি রাজনীতিকরা অধিকাংশ পালিয়ে গেছেন। একতা-ইমান-শৃঙ্খলা-ইসলাম-সংহতির বিউগল বেজে উঠেছে। বিশেষত সনাতন ধর্মাবলম্বী ব্যবসায়ীদের গায়ে চোরাচালানির ছাপ্পড় মেরে, ইজ্জতের ওপর থাপ্পড় মেরে এক আতঙ্কের ভূমিকম্পে দেশটাকে থরথর নড়বড়ে করে দিয়েছে। দেশের বাড়ি জন্মভিটি চিরতরে ছাড়তে বাধ্য করেছে কত তথাকথিত সংখ্যালঘুকে। আসলে ১৯০ বছরের শাসক ব্রিটিশরা তখন বুড়ো হয়ে ভেগে গিয়েছে। পারমাণবিক বোমায় হিরোশিমা-নাগাসাকি ধ্বংস করে মার্কিনিরা দুনিয়ার একচ্ছত্র মাতব্বর হিসেবে গজিয়ে উঠেছে। সেই নব-মাতব্বরের পুঁচকে অনুচর হিসেবে আইয়ুব খাঁ জেনারেল পাকি ক্ষমতার চ্যালার পদ পেয়েছে। ১৯৬২ সালে জামালপুরের খ্যাতনামা আবাসিক নান্দিনা ইস্কুলে ১১ বছর বয়সে বড়দের পিছু পিছু মিছিলে যোগ দিলাম। সেই প্রথম। ১৯৬৩ সালে ঢাকায় কলেজিয়েট স্কুলের রাজনীতি-নিষিদ্ধ প্রান্তর থেকে জগন্নাথ কলেজে ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার শপথ নেয়ার পর অতঃপর ‘ছাত্রনং অধ্যয়নং তপঃ’ বাণীকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আইয়ুবী তখ্তকে চুরমার করার তপস্যায় মেতে উঠলাম। ততদিনে বেত খাওয়া সবুর খাঁ আইয়ুবের ডান হাত। পঞ্চ তারকার প্রথমজন আইয়ুব খাঁ মার্কিনি শলাপরামর্শে ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ নামে অসংখ্য লিকে ভরা কলস নিয়ে মাঠে নামলেন ক্ষমতাকে বেসামরিক লেবাস দিতে। আমরা বিশেষত ছাত্রসমাজ লেখাপড়া-ক্যারিয়ার চুরমার করে উথাল-পাথাল তরঙ্গে প্রবাহিত হলাম। আইয়ুবী গুলি-টিয়ার গ্যাস-ডাণ্ডা কোনো কিছুই বাঙালিকে ঠাণ্ডা করতে পারল না। বঙ্গবন্ধু উত্থাপিত স্বায়ত্তশাসনভিত্তিক ৬ দফার জনপ্রিয়তা আইয়ুব শাহীর দফারফা করে দিল। শাসকরা গরম হয়ে উঠল। জনগণ চরম হয়ে উঠল। ৬ দফার পাশাপাশি ১১ দফা। ঊনসত্তরের মহান গণঅভ্যুত্থান। শেখ মুজিব পরিণত হলেন বঙ্গবন্ধুতে। ‘লৌহমানব আইয়ুব তুলার বস্তার মতো ধপাস পড়ে গেল’- অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরীর এমনি বক্তৃতা আমাদের মাতিয়ে তাতিয়ে দিল। এবার মাঠে নামলেন চব্বিশ ঘণ্টা সুধা সেবন-খ্যাত দ্বিতীয় তারকা। জেনারেল ইয়াহিয়া। সাধারণ নির্বাচন দেবেন বলে সাধুবাণী ছড়ালেন। নবতারকার শান্তিবচনে অনেকেই বিস্মিত হলেন। কিন্তু হাঃ! ওনাদের হিসাবে এত বড় ভুল হবে ভাবতেই পারেননি। বর্তমান বাংলাদেশ অঞ্চলে জনগণের প্রায় সবটুকু রায় গেল জনগণ মন অধিনায়ক বঙ্গবন্ধুর সপক্ষে। সমগ্র পাকিস্তানের শাসনভার কার্যত বাঙালিদের হাতে চলে যাবে : পশ্চিম পাকিস্তানের ভুট্টোচক্র তা মানতে পারল না। ওরা পার্লামেন্ট তথা গণরায় কার্যকর হওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করল পর্বতপ্রমাণ। বীর বাঙালি সেই পর্বত ভাঙতে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল, জননায়কের ৭ মার্চের নির্দেশনা মেনে। তারপর মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ আমরা বিজয়ী হলাম মানচিত্র শত্রæমুক্ত করে। পাকিস্তানি কারাগার থেকে বিপ্লবী বীরনায়ক মুক্ত হয়ে শাসনভার হাতে নিলেন। বঙ্গবন্ধু থেকে তিনি উত্তরিত হলেন জাতির পিতার অপরূপ রূপে। এ পরাজয় মানতে পারেনি মার্কিনি ইবলিশ কিসিঞ্জার। তার সাঙাত দেশ-বিদেশের অনেকে। ওরা কৌশলে প্রচণ্ড আঘাত হানল বঙ্গবন্ধু এবং পরিবারের ওপর। সে সময়ের সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় পদাধিকারী ব্যক্তি এই আঘাতের পরিকল্পনা জেনেও না জানার ভান করে থাকলেন। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা মহাবিপন্ন হওয়ার খবর জেনেও নিশ্চুপ থেকে কার্যত জাতির পিতা হত্যা সমর্থন দেয়ার এই মারাত্মক অপরাধের একমাত্র শাস্তি কী হতে পারে বলুন শুদ্ধ বচনের বিবেকবাদক মির্জাবৃন্দ! মিরজাফরীর সপক্ষে মির্জা সাহেবের মতো যারাই এখন কণ্ঠ মেলাচ্ছেন, তাদের বিবেকও নিশ্চয়ই নিহত হয়ে পচে-গলে গেছে পুরোপুরি। ক্ষমতায় এলেন ওই দ্বিতীয় প্রধান অদ্বিতীয় তৃতীয় তারকা। মুক্তিযুদ্ধের ময়দানে শুরুতে দেখা গেল বটে। কিন্তু চট্টগ্রামের রণক্ষেত্র থেকে ২৭ মার্চ অদৃশ্য হওয়ার পর ৪ এপ্রিল ১৯৭১ তিনি কী করে শ্রীমঙ্গলের তেলিয়াপাড়ায় জননেতা ও সমরনেতাদের প্রথম যৌথসভায় মিলিত হলেন? এত বাধা পথে পথে। তবু এত দ্রুত? সে প্রশ্ন একপাশে থাক। এই জাঁদরেল মুক্তিযোদ্ধার ক্ষমতায় আসার শর্তগুলো তিনি পূরণ করতে থাকলেন নিষ্ঠুরভাবে। এক. বাংলাদেশি নামের খোলসের ভেতরে পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক বিভাজনের নির্যাস ঢুকিয়ে দাও। বাংলাদেশ জিন্দাবাদ বলে মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনি জয় বাংলা ভুলিয়ে দাও। বাংলাদেশ বেতার হয়ে যাক রেডিও বাংলাদেশ। স্বাধীনতাবিরোধী বদর-রাজাকারদের রাজনীতি নিষেধমুক্ত করে দিতে ‘বহুদলীয় গণতন্ত্রের’ ছাপ্পা মেরে দাও। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ বন্ধ করে দাও। সেনাবাহিনীর শত শত সদস্যকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দাও। বছরের পর বছর দেশে কারফিউ লাগিয়ে দাও। এবং সেনাদুর্গের ঔরসে একটা ক্ষমতাসীন পাবলিক রাজনৈতিক দল তৈরি করে আওয়ামী লীগকে চিরতরে ডুবিয়ে দাও। আওয়ামীবিরোধী ‘জাতীয় ঐক্য’ গড়ে তুলতে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে মালপানি ঢেলে নিপীড়িত দরিদ্র বাম-মধ্য-ডান রাজনীতিকদের কিনে নাও। হিজবুত তাহির আর সেনাদুর্গের অস্ত্রে অস্ত্রে হিংসা বিষাক্ত করে দাও। ঘোষণা করে দাও, রাজনীতিকে আমি ডিফিকাল্ট করে দেব। সিআইএর ম্যানুয়াল বুদ্ধি করে প্রয়োগ করো। বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের জামাই আদরে পৃথিবীজুড়ে ঠাঁই করে দাও। আমরা তো পাশে আছিই। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত সিআইএর এই হাতা-উর মিয়া অর্পিত টাস্ক পালন করলেন অতীব নিষ্ঠুরতার সঙ্গে। কিন্তু যে পথে তিনি সেনাদুর্গনায়ক হিসেবে ক্ষমতায় এসেছিলেন, সেই পথেই সেনাদুর্গের ভেতর থেকেই প্রাণ হারালেন একদিন তিনি। তৃতীয় তারকার আকস্মিক পতন ঘটল আরেক চতুর চতুর্থ তারকার হাতে। ইনি প্রথমত বাইসাইকেলে চড়ে অফিসে আসতেন। শেষতঃ চড়তেন অতিশয় দামি লেটেস্ট বাহনে। ইনিও পূর্বতনের কায়দাতেই সেনাদুর্গের ঔরসে দ্বিতীয় দলটি গড়লেন। তিনি প্রায়ই বলতেন, আমার হাতে রক্তের দাগ নেই। একেবারে সাফ। অথচ শুরুতেই ১২ সেনা কর্মকর্তাকে কার্যত বিনাবিচারে নিধন করলেন সামরিক আইনি বেড়াজালের ভেতর। হাতের রক্ত সাফ করতেন বিবেকহীনতা এবং ভণ্ডামির বিশেষ কেমিক্যালে। সেই হাতে অতঃপর শুধু মালপানি আর মালপানি। একসময় নব্বইতে ছাত্র গণজাগরণে চতুর্থ তারকার পতন হলো। এবার পঞ্চম তারকার গাথা। কিন্তু তার আগে আছে কিঞ্চিৎ কথা। রাজনীতিকে ‘ডিফিকাল্ট’ করে দেয়ার যে ঘোষণা দিয়েছিলেন তৃতীয় তারকা, তাতে দারুণ-নিদারুণ সফল হলেন তিনি। সেনাদুর্গের প্রথম দলের হাতে বিপুল মালপানি। চতুর চতুর্থ তারকা ক্ষমতা হারিয়ে কারা গরাদে। প্রথম দলটি ১৯৯১ সালে নির্বাচনে জিতে গেল। সিভিলিয়ান রাজনৈতিক প্রথম দলটি মালপানির তোড়ের কাছে প্রমাদ গুণে রাজনীতিকে আরো ডিফিকাল্ট করে দেয়ার ফাঁদে পা দিলেন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে মনোনয়ন দিলেন ত্যাগী, দরিদ্র নেতাদের বদলে ব্যবসায়ী মালপানিওয়ালাদের। এরপর ২০০১ নির্বাচনে সেনাদুর্গের প্রথম দল আন্তর্জাতিক মদদে পুনঃক্ষমতা লাভ করে সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের রেকর্ড গড়ল। এবার সেনাদুর্গ আর দুর্গবহির্ভূত দুটি দলকে দুর্নীতিবাজের তকমা লাগিয়ে পঞ্চম তারকাজন একদল কুশলী ক্ষমতা ক্ষুধার্ত সুশীলদের নিয়ে ১/১১ পরিচিতিতে ওরাং-ওটাং স্টাইলে ক্ষমতা হাতে নিলেন। পঞ্চম তারকা পাম তেলের গাছ লাগিয়ে নিজের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার কোশেশ করেও পিছু হটলেন। দুই নেত্রীকে একযোগে গ্রেপ্তার করে বেকায়দায় পড়ে গেলেন। একসময় পালালেন। আইয়ুব থেকে মইন- এই মহান তারকাবৃন্দ দেশের অনেকের জীবন-ক্যারিয়ার, চরিত্র-নৈতিকতায় যে ধস নামিয়েছেন, আমাদের রাজনীতি এসব বিনষ্টি আর দূষণ থেকে কবে রেহাই পাবে জানি না। তবে ব্রিটিশ শাসক মহাজন-আইয়ুব-এরশাদ একরকম অবকাঠামো উন্নয়নের মধ্য দিয়ে মানুষের মন পেতে কিঞ্চিৎ সফল হয়েছিলেন। বর্তমান ক্ষমতাসীনরা এই সবার মিলিত উন্নয়নকে ১১-৩ গোলে হারিয়ে দেয়ার যে ছক করেছে তা নিছক বৃথা যাবে বলে মনে হয় না। আমরা বলব উন্নয়ন হ্যাঁ। বৈষম্য না। দুর্নীতি তফাত যা। সাম্প্রদায়িক বিভাজনের শক্তি দূর হ! এই বলা এবং হওয়ার মাঝের দূরত্ব ঘুচানোর সময় কমানোর দায়ভার একালের তরুণদেরই! হিলাল ফয়েজী : মুক্তিযোদ্ধা ও রম্যলেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App