×

জাতীয়

করোনার থাবা অটিস্টিক শিশুর বিকাশেও

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৩ অক্টোবর ২০২১, ০৮:৫৫ এএম

করোনার থাবা অটিস্টিক শিশুর বিকাশেও

অটিস্টিক শিশুদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা- ফাইল ছবি

কুমিল্লার বুড়িচং এলাকার সিরাজউদ্দিন ও রাহেলা বেগমের ছেলে শাহীনূর ইসলাম। ৩ বছরের শাহীনূর সিরাজ ও রাহেলা দম্পতির প্রথম সন্তান। অন্য সাধারণ শিশুদের মতো যে শাহীনূর নয় তা ছোট বেলায়ই ধরা পড়ে। ছেলেকে নিয়ে কুমিল্লা ও ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরেছেন তারা। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শাহীনূরকে নিয়ে নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে আসেন সিরাজ ও রাহেলা। সেখান থেকে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর শাহীনূরকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপতালে যাওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। এরপর দেশে শুরু হলো করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ। লকডাউন। এমন পরিস্থিতিতে ছেলেকে নিয়ে ঢাকায় আসা পিছিয়ে যায়। অবশেষে ২৬ সেপ্টেম্বর ছেলেকে নিয়ে বিএসএমএমইউ হাসপাতালে আসেন সিরাজ ও রাহেলা দম্পতি। ডাক্তার দেখানো শেষে এফ ব্লকের নিচে ছেলেকে কোলে নিয়ে রাহেলা বলেন, আরো আগেই আসতাম। করোনার কারণে ছেলেটার চিকিৎসা পিছিয়ে গেল। আমার ছেলেটা কবে যে ভালো হবে।

চার বছর বয়স থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ‘ইনস্টিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরোডিজঅর্ডার এন্ড অটিজম (ইপনা) স্কুলে পড়ছে সিদরাতুল মুনতাসির শামস (১১)। শামসের মা কাঁঠালবাগানের বাসিন্দা মোরশেদ ফারজানা হায়দার ভোরের কাগজকে বলেন, করোনাকালে শামসের বিকাশটা অনেকটাই বাধাগ্রস্ত হয়েছে। আগে স্পিচ, ওকুপেশনাল থেরাপির পাশাপাশি পায়ের সমস্যার জন্য ওকে ফিজিওথেরাপিও দিতে হতো। থেরাপি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ‘হাইপারনেস’ বেড়ে গেছে। অস্থিরতা, রাগ বেড়ে গেছে। তবে অনলাইন ক্লাসে বসছে। পড়াশোনা থেমে নেই। কিন্তু থেরাপির বিষয়টি ব্যাহত হচ্ছে। বাইরে যেতে পারছে না। ফলে তার সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়াটি ব্যাহত হচ্ছে।

শাহীনূর ও শামসের মতো অসংখ্য বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর ওপর করোনাকালে পড়েছে বিরূপ প্রভাব। স্কুল থেকে ঝরে পড়াসহ সময়মতো বিভিন্ন থেরাপি নিতে না পারায় তাদের বিকাশও বাধাগ্রস্ত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অটিজম পুরোপুরি নিরাময় করা আজ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। কিন্তু সঠিক পরীক্ষা, চিকিৎসা, থেরাপি এবং কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে শিশুদের ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ জীবন আচরণ স্বাভাবিক গণ্ডির মধ্যে নিয়ে আসা সম্ভব।

বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি) প্রয়াস ইনস্টিটিউট অব স্পেশ্যাল এডুকেশন এন্ড রিসার্চের (পাইজার) অডিওলজি এন্ড স্পিচ ল্যাংগুয়েজ প্যাথলজি বিভাগের প্রভাষক ফাতিমা আলম মেঘলা জানান, অটিস্টিক শিশুদের জন্য বিভিন্ন রকম থেরাপি রয়েছে। যেমন-অটিস্টিক শিশুদের যেহেতু ভাষাগত সমস্যা থাকে। তাই তাদের ভাষাগত কাঠামো উন্নয়নের জন্য স্পিচ-ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি দিতে হয়। কারো কারো সেন্সরি সমস্যা প্রবল থাকে। সেজন্য তাদের সেন্সরি ইন্টিগ্রেশন থেরাপি দিতে হয়। ফাইন ও গ্রস মোটর সমস্যার জন্য অকুপেশনাল থেরাপি লাগে কারো। শারীরিক অসামর্থ্য উন্নয়নে ফিজিওথেরাপিও লাগে। অটিস্টিক শিশুদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পুষ্টিবিদের পরামর্শ লাগে।

সংশ্লিষ্টরাও স্বীকার করছেন, করোনার নেতিবাচক প্রভাব সবক্ষেত্রে পড়লেও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের ওপর এর প্রভাব পড়েছে আরো বেশি। অনলাইনে পড়াশোনা চালিয়ে গেলেও তাদের বিকাশে এবং সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে অনেক। আর হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন এসব শিশুর অভিভাবকরা।

করোনার আগে ইপনার স্কুলে ৫০ জন শিক্ষার্থী ছিল। কিন্তু এখন এই সংখ্যা কমে এসে দাঁড়িয়েছে ৪২ জনে। আর অটিজম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনে ১৪৭ জন শিক্ষার্থী ছিল। এর মধ্যে ৫৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে। বাকি ৪৫ শতাংশ শিক্ষার্থী এখনো ভর্তি হয়নি। ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ডা. রওনাক হাফিজ জানান, তার প্রতিষ্ঠানের অনেক শিক্ষার্থীর অভিভাবক জানিয়েছেন তারা আর তাদের সন্তানকে স্কুলে পাঠাবেন না। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে অনেকে ঢাকা ছেড়েছেন। কেউবা খরচটা বহন করতে পারছিলেন না। তাই স্কুল ছেড়ে দিতে হয়েছে।

ডা. রওনাক হাফিজ ভোরের কাগজকে বলেন, করোনার নেতিবাচক প্রভাব অটিস্টিক শিশুদের ওপর পড়েছে অনেক বেশি। প্রতিটা অটিস্টিক শিশু আলাদা। তাদের সমস্যাগুলোও আলাদা। এই ঘরবন্দি অবস্থা তাদের বিকাশের ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। অটিস্টিক শিশু ও তাদের অভিভাবকদের সহযোগিতায় আমরা অনলাইন কার্যক্রম শুরু করেছি। কিন্তু অনেক শিশু আছে যারা অনলাইনে বসতেই চাইছে না। স্কুলে আসার আগ্রহ আগে যেমন ছিল তা এখন আর তাদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না।

অটিস্টিক শিশুদের বিভিন্ন ধরনের থেরাপি দেয়া হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ঘরবন্দি অবস্থায় থাকতে থাকতে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের আচরণে অনেক পরিবর্তন এসেছে। তারা থেরাপিগুলো নিতে পারেনি। এখানে একটি গ্যাপ তৈরি হয়েছে। অভিভাবকদের অনেকেই হতাশ হয়ে পড়েছেন। অভিভাবকদের কাউন্সিলিংয়েও এখন আমরা জোর দিচ্ছি। এখন আমরা কেউই ভালো নেই। আমাদের ঢাকার অবস্থাই যদি এমন হয় তবে ঢাকার বাইরের অবস্থাটা সহজেই অনুমান করা যায়।

ইপনার অটিজম ইন্সট্রাকটর মমতাজ বেগম ভোরের কাগজকে বলেন, সুস্থ-স্বাভাবিক শিশুদের ওপরই করোনার যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে একই রকম প্রভাব অটিস্টিক শিশুদের ওপরও পড়েছে। ওরা ওদের ভাবটা প্রকাশ করতে পারে না ফলে তাদের কষ্টটা বেশি। করোনাকালে এইসব শিশুর মধ্যে ‘এগ্রেসিভনেসটা’ বেড়ে গেছে। অর্থাৎ তারা হঠাৎ ক্ষেপে যাচ্ছে, কিছু একটা ছুড়ে মারছে, চঞ্চলতা বেড়ে গেছে। সেজন্য বিশাল প্রভাব পড়েছে শিশুদের ওপর। বাচ্চাদের ‘সোশ্যাল ইন্টারএকশন ডেভেলপমেন্ট’ কারার জন্য আমরা ২দিন বাইরে যাই। এই জায়গাটায় আমরা পিছিয়ে পড়েছি। বন্দি হয়ে জীবন কাটাচ্ছে। সপ্তাহের ৫ দিন ওরা যখন স্কুলে আসত, আমরা তাদের বিভিন্ন প্রোগ্রামে রেখে বিভিন্ন বিষয় শেখাতাম, আনন্দ দিতাম, শিক্ষকরা আন্তরিক হয়ে তাদের সঙ্গে মিশত কাজ করত সেই জায়গা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আমাদের সঙ্গে তাদের ইন্টারএকশন বা ‘মিথস্ক্রিয়া’ হতো সেই জায়গা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

করোনাকালে ইপনার আউটডোরে রোগীর ভিড় কম ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, করোনার সংক্রমণ শুরু এবং লকডাউন থাকার ফলে অনেকেই তখন চিকিৎসার জন্য আসতে পারেননি। এ সংখ্যা অনেকটা কমে গেলেও ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে।

ইপনার অটিজম শিক্ষক সোমা রানী নন্দী ও শরীফা খাতুন তাদের অনলাইনভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম সম্পর্কে বলেন, গত বছর এপ্রিলে ইপনার অনলাইনভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে। সপ্তাহে ৫ দিন দেড় ঘণ্টা করে ক্লাস নেয়া হচ্ছে। প্রথমে এই কার্যকমের সঙ্গে অভিভাবকদের সম্পৃক্ত করি। তখন বাচ্চারা এতে আগ্রহী ছিল না। এখন তারা তাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। অভিভাবকরা যেসব ক্ষেত্রে আগে সহযোগিতা কম করত এখন সত্যিকার অর্থে তারা অনেক সহযোগিতা করছেন। অভিভাবকরা এখন একজন প্রশিক্ষিত শিক্ষকর সমতুল্য হয়ে গেছে।

দেশব্যাপী ইপনার পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ১৬ থেকে ৩০ মাস বয়সি শিশুদের মধ্যে প্রতি ১০ হাজারে ১৭ জন অটিস্টিক। অটিজম মস্তিষ্কের স্নায়বিক সমস্যার কারণে হয়ে থাকে। প্রাক শৈশবকাল থেকে এই সমস্যাটি শুরু হয় যা শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে।

সাধারণত শিশুর জন্মের দেড় বছর থেকে ৩ বছরের মধ্যে অটিজমের লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়। সামাজিক সম্পর্ক, যোগাযোগ এবং আচরণের ভিন্নতাই এই সমস্যাটির প্রধান বিষয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App