×

মুক্তচিন্তা

জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ প্রেক্ষিত : সংকট ও বৈষম্য নিরসনে নতুন ছয় দফা

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০২ অক্টোবর ২০২১, ১২:৪৭ এএম

জাতিসংঘের ৭৬তম অধিবেশনে যোগ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বিশ্ব নেতৃবৃন্দের মাঝে এক ঐতিহাসিক ও তাৎপর্যপূর্ণ ভাষণ প্রদান করেন। যার মমার্থ ও সারাংশ নিম্নে তুলে ধরা হলো : গত এক দশকে আর্থ-সামাজিক খাত ও নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। শিশুমৃত্যু হার প্রতি হাজারে ২৩ দশমিক ৬৭-এ কমে এসেছে। প্রতি লাখ জীবিত জন্মে মাতৃমৃত্যুর হার ১৭৩-এ হ্রাস পেয়েছে। মানুষের গড় আয়ু বেড়ে হয়েছে ৭৩ বছর। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের তথ্য মতে, নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। ২০১৪ সাল থেকে এ সূচকে বাংলাদেশ আঞ্চলিক প্রতিবেশি দেশগুলোর চেয়ে এগিয়ে আছে। আমাদের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ উদ্যোগ আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, শিক্ষা, দুর্যোগ ঝুঁকিহ্রাস, নারীর ক্ষমতায়নসহ অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাড়া জাগিয়েছে। আমরা ব্যাপকভাবে ‘সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী’ কর্মসূচির সম্প্রসারণ করেছি। ‘টেকসই উন্নয়ন প্রতিবেদন ২০২১’ অনুযায়ী ২০১৫ সাল থেকে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রার সূচকে বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রেই এগিয়ে আছে। এ সাফল্যের মূলে রয়েছে নারীর উন্নতি ও ক্ষমতায়নে বিপুল বিনিয়োগ। এ বিনিয়োগ আমাদের রূপান্তর সক্ষম উন্নয়নে বিপুল অবদান রেখেছে। এ বছর আমরা স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে পদার্পণ করেছি। এখন আমাদের স্বপ্ন বাংলাদেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে একটি জ্ঞানভিত্তিক উন্নত দেশ ও ২১০০ সালের মধ্যে সমৃৃদ্ধ ও টেকসই বদ্বীপে রূপান্তর করা। বাংলাদেশে কোভিড-১৯ মহামারির প্রকোপ আশঙ্কার চেয়ে অনেক কম হয়েছে। তৃণমূল পর্যায় থেকে আমাদের শক্তিশালী স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কারণে এটা সম্ভব হয়েছে। এছাড়া এ মহামারি মোকাবিলায় আমাদের সময়োচিত, সমন্বিত ও বহুমুখী উদ্যোগ কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। জীবন ও জীবিকার ভারসাম্য রক্ষা করতে শুরুতে আমাদের বেশ কিছু কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। অর্থনীতিকে সচল রাখতে বিভিন্ন সময়ে আমরা ২৮টি প্রণোদনা প্যাকেজের মাধ্যমে প্রায় ১ হাজার ৪৬০ কোটি মার্কিন ডলার বরাদ্দ দিয়েছি, যা মোট দেশজ উৎপাদনের ৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ। করোনা ভাইরাসের টিকা সংগ্রহের জন্য চলতি অর্থবছরে বাজেটে ১৬১ কোটি মার্কিন ডলারের সংস্থান রাখা হয়েছে। তার ভাষণের উল্লেখযোগ্য অন্যান্য বিষয় নিম্নরূপ- যাকে আমরা প্রধানমন্ত্রীর নতুন ছয় দফা হিসেবে অভিহিত করতে পারি। প্রথমত, কোভিডমুক্ত একটি বিশ্ব গড়ে তোলার লক্ষ্যে টিকার সর্বজনীন ও সাশ্রয়ী মূল্যে প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। জরুরিভিত্তিতে টিকা বৈষম্য দূর করতে হবে। লাখ লাখ মানুষকে টিকা থেকে দূরে রেখে কখনোই টেকসই পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়। আমরা পুরোপুরি নিরাপদও থাকতে পারব না। সবার জন্য ন্যায়সঙ্গত ও সাশ্রয়ী মূল্যে টিকার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। অবিলম্বে টিকা প্রযুক্তি হস্তান্তর টিকার সমতা নিশ্চিত করার একটি উপায় হতে পারে। প্রযুক্তি সহায়তা ও মেধাস্বত্বের ছাড় পেলে বাংলাদেশও ব্যাপক পরিমাণে টিকা তৈরি করতে সক্ষম। দ্বিতীয়ত, এ মহামারি জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোকে অধিকমাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম এবং ভালনারেবল-২০ গ্রুপ অব মিনিস্টারস অব ফাইন্যান্সের সভাপতি হিসেবে আমরা ‘মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা- দশক ২০৩০’-এর কার্যক্রম শুরু করেছি। এ পরিকল্পনায় বাংলাদেশের জন্য জলবায়ুকে ঝুঁকির কারণ নয়, বরং সমৃদ্ধির নিয়ামক হিসেবে পরিণত করার কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে। তৃতীয়ত, মহামারির প্রকোপে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা চরমভাবে বিপর্যস্ত। জাতিসংঘ শিশু তহবিলের তথ্য অনুযায়ী, করোনাকালে আংশিক বা পুরোপুরি বিদ্যালয় বন্ধের কারণে বিশ্বের প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নিম্ন আয়ের দেশগুলোর লাখ লাখ ছাত্রছাত্রীর দূরশিক্ষণে অংশগ্রহণের সক্ষমতা ও প্রযুক্তি না থাকায় ভর্তি, সাক্ষরতার হার ইত্যাদি অর্জন হুমকির মুখে পড়েছে। ডিজিটাল সরঞ্জামাদি ও সেবা, ইন্টারনেটের সুযোগ-সুবিধার সহজলভ্যতা ও শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ করতে হবে। চতুর্থত, কোভিড-১৯ অতিমারির নজিরবিহীন প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে আমরা স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের পথে রয়েছি। তবে এ মহামারি অনেক দেশের উত্তরণের আকাক্সক্ষাকে বিপন্ন করেছে। স্বল্পোন্নত দেশের টেকসই উত্তরণ ত্বরান্বিত করার জন্য উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে আমরা প্রণোদনাভিত্তিক উত্তরণ কাঠামো প্রণয়নে আরো সহায়তা আশা করি। পঞ্চমত, মহামারিকালে প্রবাসীরা অপরিহার্য কর্মী হিসেবে স্বাস্থ্য ও অন্যান্য জরুরি সেবা খাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। তারাও সম্মুখসারির যোদ্ধা। তবুও তাদের অনেকে চাকরিচ্যুতি, বেতন কর্তন, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য সামাজিক সেবার সহজলভ্যতার অভাব ও বাধ্যতামূলক প্রত্যাবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই সংকটকালে অভিবাসী গ্রহণকারী দেশগুলোকে অভিবাসীদের সঙ্গে ন্যায়সঙ্গত আচরণ করার এবং তাদের কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য এবং কল্যাণকে নিশ্চিত করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। ষষ্ঠত, রোহিঙ্গা সংকট এবার পঞ্চম বছরে পড়ল। কিন্তু এখন পর্যন্ত বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। মিয়ানমারে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে অনিশ্চয়তা তৈরি হলেও এ সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করতে আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জোরালো ভূমিকা ও অব্যাহত সহযোগিতা আশা করি। মিয়ানমারকে অবশ্যই তার নাগরিকদের প্রত্যাবর্তনের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সহযোগিতা করতে সদা প্রস্তুত। এ জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই গঠনমূলক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের দেশকে নিয়ে গেলেন আরো এক অনন্য উচ্চতায় জাতিসংঘের কাছ থেকে এসডিজি (সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল) অগ্রগতি পুরস্কার লাভের মধ্য দিয়ে। এই পুরস্কার প্রধানমন্ত্রীর সফল নেতৃত্বে দেশের উন্নয়নের এক অনন্য স্বীকৃতি। কিন্তু তার চেয়েও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হলো জাতিসংঘের এসডিজি সংক্রান্ত সভায় এই পুরস্কারের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রীকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে উপস্থাপন করার বিষয়। অনুষ্ঠানের সঞ্চালক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘জুয়েল ইন দ্য ক্রাউন অব দ্য ডে’ বলে উল্লেখ করেছেন। বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারির মধ্যেও এসডিজি কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করে সেই সঞ্চালক আরো উল্লেখ করেন যে, এই পুরস্কার হচ্ছে এসডিজি লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে জোরালো দায়িত্ব পালনের একটি প্রমাণপত্র। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বার্ষিক সভার একটি অনুষ্ঠানে যখন দেশের প্রধানমন্ত্রীকে পুরস্কৃত করে এভাবে উচ্চৈঃস্বরে প্রশংসা করা হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই আমাদের দেশের ভাবমূর্তি চলে যায় অনন্য এক উচ্চতায় এবং আমাদের মনটাও গর্বে ভরে যায়। এ কথা আজ সর্বজনবিদিত যে, টানা এক যুগেরও বেশি সময় দেশ শাসনের সুযোগ পেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের ধারায় যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন তারই স্বীকৃতি জাতিসংঘের এসডিজি অগ্রগতি পুরস্কার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমসাময়িক অন্য যে কোনো বিশ্বনেতার চেয়ে অনন্য এবং স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। তিনি এরই মধ্যে সেই যোগ্যতার স্বাক্ষরও রেখেছেন। কারণ বিশ্বের অন্য কোনো দেশ পরিচালনার চেয়ে বাংলাদেশ পরিচালনা করা অনেক কষ্টসাধ্য এবং বলা যায় এক ধরনের অসম্ভবকে সম্ভব করার মতো কাজ। বিশেষ করে উন্নত দেশের সঙ্গে তো কোনো তুলনাই চলে না। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ ও প্রযুক্তি- সব সূচকেই বাংলাদেশ এখন এগিয়ে আছে। এ অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে সংগ্রামী জননেত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে। বাংলাদেশকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। এ দেশকে এখন সুযোগ্য নেতৃত্ব দিয়ে সাজিয়ে তুলেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার দৃষ্টি এখন উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণ করা। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তার অঙ্গীকার এবং তার জন্য অবিরাম আন্দোলনের ফসল। আজকের গণতান্ত্রিক পরিবেশ। একই সঙ্গে মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় তিনি অবিচল। তার দূরদর্শী ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব তাকে পরিণত করেছে গণতন্ত্রের মানসকন্যারূপে। তিনি আজ গণতন্ত্রের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাই এ উজ্জ্বল নক্ষত্রের ছোঁয়া পেয়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও আজ উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হচ্ছে।

ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ : কলাম লেখক ও গবেষক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App