×

অপরাধ

বেপরোয়া চোরাচালান চক্র

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৯:১২ এএম

বেপরোয়া চোরাচালান চক্র

আটককৃত বিভিন্ন চোরাচালান পণ্যে। ছবি: সংগৃহীত

অবৈধভাবে সীমান্ত পেরিয়ে আসা চোরাচালান পণ্যে এখন দেশের বাজার সয়লাব। হাত বাড়ালেই মিলছে চোরাচালানে আসা পণ্য। রাজধানীসহ দেশের সর্বত্রই মিলছে চোরাইসামগ্রী। স্থল, নৌ ও আকাশপথেও আসছে চোরাচালানের পণ্য। বিজিবি, কাস্টমস, কোস্ট গার্ডসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে চোরাই মালের চালান আটক হলেও থামছে না এর দৌরাত্ম্য। এর সঙ্গে সবমিলিয়ে কয়েকশ বড়মাপের কারবারি জড়িত থাকলেও অভিযানে ধরা পড়ছে চুনোপুটিরা। নাটেরগুরুরা বরাবরই থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। তবে শুধু যে চোরাচালানের মাধ্যমে দেশে বিভিন্ন পণ্য ঢুকছে তাই নয়, রুট হিসেবে ব্যবহার হয়ে এদেশ থেকেও অনেক পণ্য যাচ্ছে ভিন্ন দেশে।

এ প্রসঙ্গে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. আব্দুর রউফ ভোরের কাগজকে বলেন, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান অব্যাহতভাবে চলছে। চোরাচালানের পণ্য প্রায়ই আটক হচ্ছে। তিনি বলেন, কোনো সমাজে শতভাগ অপরাধ নির্মূল করা সম্ভব হয়নি। এ দেশে সমাজ, অর্থনীতি এবং ভৌগোলিক অবস্থা চোরাচালানের জন্য দায়ী উল্লেখ করে তিনি বলেন, স্বল্প সামর্থ্যরে মধ্যে এসব নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে।

কোস্ট গার্ডের পরিচালক (গোয়েন্দা) ক্যাপ্টেন মো. হাসান বলেন, দেশে চাহিদা থাকায় পণ্য ও মাদক চোরাচালান হয়ে আসছে। টাকার লোভে পড়ে কিছু লোক এসব করছে দাবি করে তিনি বলেন, পৃথিবীর কোনো দেশেই পুরোপুরিভাবে চোরাচালান নির্মূল করা সম্ভব হয়নি। তবে টহল, নজরদারি ও অভিযানের কারণে চোরাচালান নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।

বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. সাফিনুল ইসলাম ও পরিচালক (অপারেশন) লে. কর্নেল ফয়জুর রহমানের বক্তব্য জানতে একাধিকবার যোগাযোগ করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।

জানা গেছে, যশোর, সিলেট, কুমিল্লা, সিলেট, সাতক্ষীরা, বগুড়া, দিনাজপুরসহ ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষা পয়েন্টগুলো দিয়ে নির্বিঘ্নে ঢুকছে চোরাচালান পণ্য। মিয়ানমারের টেকনাফ সীমান্ত দিয়েও ঢুকছে চোরাই পণ্য। দেশে গাঁজা থেকে শুরু করে আইস, এলএসডি, হেরোইন, ইয়াবাসহ সব ধরনের মাদকের সহজলভ্যতার অন্যতম কারণ হচ্ছে চোরাচালান। চোরাইভাবে আসছে অস্ত্র, স্বর্ণ, শাড়ি, কাপড়, থ্রি-পিছ, গরু, মোবাইল, মোবাইল ফোন এক্সেসরিজ, গরম মসলা, পিয়াজ, সিগারেট, ভিওআইপি সরঞ্জাম, রুপা, ইমিটেশনের গহনা, বিভিন্ন কসমেটিক্সসামগ্রী, শার্টপিস, তৈরি পোশাক, থান কাপড়, চন্দন কাঠ, চা পাতা, কয়লা, জুতা, স্যান্ডেল, সিএনজি চালিত অটোরিকশা, মোটরসাইকেলসহ হরেক রকম পণ্য।

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) বছরের প্রথম ৫ মাসে যশোরের সীমান্ত এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১১ হাজার বোতল ফেনসিডিল, ৭ দশমিক ৩০৩ কেজি সোনাসহ প্রায় ১০ কোটি টাকার চোরাচালান পণ্য ও মাদকদ্রব্য জব্দ করেছে।

যশোর-৪৯ বিজিবি ব্যাটালিয়ন জানিয়েছে, প্রথম ৫ মাসে সীমান্তে বিজিবির অভিযানে ইয়াবাসহ মাদক পাচার ও অন্যান্য চোরাচালানে জড়িত থাকার অভিযোগে ৭৩ জন চোরাচালানিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত ২৫ মে বিকালে বেনাপোল চেকপোস্টের একটি দোকানে অভিযান চালিয়ে সাদিপুর গ্রামের সামসুল হকের ছেলে আমিনুল ইসলামকে ৪ কোটি টাকা মূল্যমানের ১০ ইউএস ডলার মূল্যের ৩০ হাজার ৫৪০ পিস, ৫ ইউএস ডলার মূল্যের ৩ হাজার পিস, ২৫ ইউএস ডলার মূল্যের ৪ হাজর ৭০০ পিস ও ১০ সৌদি রিয়ালের ৪ হাজার ৯০০ পিস আন্তর্জাতিক ক্র্যাচকার্ড বা কলিং কার্ডসহ আটক করা হয়। জুন মাসে ৬২ কোটি ১১ লক্ষাধিক টাকার চোরাচালান ও মাদকদ্রব্য জব্দ করা হয়েছে।

এদিকে সাতক্ষীরার কলারোয়ার ভাদিয়ালী, কেড়াগাছি, চন্দনপুর ও কায়বা সীমান্তের জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত পাকা সড়ক নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার করছে চোরাচালানিরা। যশোরের শার্শা উপজেলার বাগআঁচড়া, কলারোয়ার কাজিরহাট এবং সাতক্ষীরা সদরের ঝাউডাঙ্গা থেকে মাত্র ১৫ থেকে ২০ মিনিটের মধ্যেই এই সীমান্তের সোনাই নদীর পাড়ে পৌঁছানো যায়। ভাদিয়ালী ও কেড়াগাছির ভারত-বাংলাদেশ বিভক্তকারী সোনাই নদীর ওপারে নোম্যানস ল্যান্ডে ভারতের হাকিমপুরে গড়ে উঠেছে চোরাচালানের বিশাল বাজার। হাকিমপুর থেকে মাত্র ৩৪ কিলোমিটার দূরে পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতার সঙ্গে সরাসরি বাস যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে কলারোয়ায় গড়ে উঠেছে ৫০-৬০টি চোরাচালান সিন্ডিকেট।

এই পথে সুতি শাড়ি, কাতান, বেনারসি, সাউথ ইন্ডিয়ান সিল্ক, প্যান্ট পিস, শার্ট পিস, ওড়না, থ্রি-পিস, টুপিস, গেঞ্জি, জাঙ্গিয়া, পাজ্ঞাবী, শিশু পোশাক, বেডশিট, তোয়ালে আসছে। কলারোয়ার ইলিশপুর, সরসকাটি, যুগীখালী, কামারালী, সিংগা মোড়, নকাটির বিল, সোনাবাড়িয়া মঠ, বড়ালী, লাঙ্গলঝাড়া থেকে কখনো ট্রাক, কখনো পিকআপ বোঝাই হয়ে কাপড়ের গাঁট দেশে ঢুকছে। এছাড়া কলারোয়া সীমান্ত পথে ময়দা, সুজি, ছোলা, বুট, দারুচিনি, লবঙ্গ, এলাচ, জিরা, মরিচ, গুঁড়া মসলা, আতর, পারফিউম, সেভিং ক্রিম, সেভিং লোশন, বডি লোশন, হাড়ি, কড়াই, রেডিও টেলিভিশনের যন্ত্রাংশ, সাইকেল, মোটরসাইকেল ও তার যন্ত্রাংশ, বাস ট্রাকের ইঞ্জিন ও যন্ত্রাংশ, ঘর ওয়ারিংসহ বৈদ্যুতিক ও স্যানিটারি সামগ্রী, সপিং ও পলিথিন ব্যাগ, ফেনসিডিলসহ নানা প্রকার মাদকদ্রব্য আসছে।

আবার বাংলাদেশ থেকে প্রতিদিন লুঙ্গি, গামছা, তিল, সুপারি, চুল, ইলিশ মাছ ছাড়াও কোটি কোটি টাকা মূল্যের চামড়া পাচার হয়ে যাচ্ছে ভারতে। চোরাচালানের কাজে কলারোয়া সীমান্তের কেড়াগাছির চারাবাড়ী ঘাট, কুটিবাড়ী ঘাট, গাড়াখালী ঘাট, দক্ষিণ ভাদিয়ালী ঘাট, ভাদিয়ালী তেঁতুলতলা ঘাট, উত্তর ভাদিয়ালী কামারবাড়ী ঘাট, রাজপুর খা বাগান ঘাট, রাজপুর ঘাট, চান্দা ঘাট, চান্দা স্লুইচগেট ঘাট, দক্ষিণ বড়ালী ঘাট, উত্তর বড়ালী ঘাট, হিজলদী ভদ্রশাল ঘাট, হিজলদী শিশুতলা ঘাট, সুলতানপুর ঘাট, গোয়ালপাড়া ঘাট, চান্দুরিয়া ঘাট মাসিক চুক্তিতে ডাক দেয়া হয়েছে চোরাকারবারিদের কাছে। প্রতি সন্ধ্যায় শুরু করে রাতভর ল্যান্ড বর্ডার বা ডাঙ্গা সীমান্তে বিএসএফ সাপ্তাহিক চুক্তিতে ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে তারকাটার বেড়ার গেট খুলে এবং নদী সীমান্তে নৌকাযোগে এসব নিম্নমানের পণ্য পাচারে সহায়তা করছে।

সিলেটের সীমান্তগুলো দিয়ে ভারত থেকে আসে চোরাই গরু। জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট, জকিগঞ্জ ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা দিয়ে ভারত থেকে অবৈধভাবে পণ্য আনা হয় বাংলাদেশে। অবৈধভাবে আনা পণ্যের মধ্যে আছে কাপড়, কসমেটিকস, বিড়ি, সিগারেট, ইয়াবাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক, চা পাতা প্রভৃতি। এছাড়া গরু, মহিষ এবং মোবাইল ফোনের চালানও সীমান্ত এলাকা দিয়ে অবৈধভাবে বাংলাদেশে আনা হয়। ক্ষুদ্রাস্ত্রের একাধিক চালান সিলেটের গোয়াইনঘাটের পূর্ব বিছনাকান্দি সীমান্ত দিয়ে দেশে আনার ঘটনাও ঘটেছে। আটক হয়েছে একাধিক ব্যক্তি ও চালান।

অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সোনা চোরাচালানকারীদের জন্য অত্যন্ত লাভজনক ও অপেক্ষাকৃত নিরাপদ রুটে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। কিছুদিন পরপর দু-একটি করে চালান ধরা পড়ছে বটে, কিন্তু বড় অংশই ধরা পড়ছে না। ঢাকা ও চট্টগ্রামের দুই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসা সোনার একটি অংশ প্রায়ই বিমানবন্দরে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। এমনকি বিমানের টয়লেটেও মেলে চোরাচালানের সোনা। একটি সূত্রের দাবি, ঢাকার হযরত শাহজালাল ও চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যেসব চোরাচালান ধরা পড়ছে, এর নেপথ্যে রয়েছে স্মাগলারদের অন্তর্দ্বন্দ্ব, নিরাপত্তা সংস্থার সদস্যদের আন্তঃবনিবনা ও তাদের সঙ্গে পাচারকারীদের বনিবনা না হওয়া।

তাছাড়া চোরাচালানের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলাগুলোয় বহনকারীরা অভিযুক্ত হলেও মূলহোতারা বরাবরই থেকে যাচ্ছে আড়ালে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেও আন্তর্জাতিক চোরাচালানকারীরা বাংলাদেশকে চোরাচালানের অন্যতম নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার করছে। সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, দুবাই, কাতারসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে আকাশ পথে সোনার চোরাচালান আসছে বাংলাদেশে। তবে সীমান্ত পথও থেমে নেই। বাংলাদেশ হয়ে এর চালান ঢুকছে ভারতে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App