×

জাতীয়

জাতীয় কন্যাশিশু দিবস আজ: করোনাকালে দেশজুড়ে বাল্যবিয়ের ‘মহামারি’

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১০:১৩ এএম

জাতীয় কন্যাশিশু দিবস আজ: করোনাকালে দেশজুড়ে বাল্যবিয়ের ‘মহামারি’

ছবি: সংগৃহীত

পরিসংখ্যান বলছে, দেশের মোট জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশ ১৮ বছরের কম বয়সি শিশু। এদের মধ্যেও ৪৮ শতাংশই কন্যাশিশু। কন্যাশিশুদের সুরক্ষায় দেশে নানা উদ্যোগ, আইন, নীতিমালা রয়েছে। কিন্তু এত কিছুর পরেও কন্যাশিশুদের সুরক্ষা কতটা নিশ্চিত হয়েছে? করোনা মোকাবিলায় সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হচ্ছে। কিন্তু এসবের মধ্যেও নানা সংকট ডানা মেলেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেখানে পরিবারেই কন্যাশিশুরা নিরাপদ নয় সেখানে সমাজ ও রাষ্ট্র কতটা সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারবে তা সহজেই অনুমান করা যায়।

বাল্যবিয়ের রাহু কন্যাশিশুদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতকেও গ্রাস করছে। বাড়ছে অপরিকল্পিত গর্ভধারণ, মাতৃমৃত্যু, অপুষ্টি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে তাদের ঝরে পড়ার হারও অনেক বেশি। শুধু যেন আলোচনা আর প্রতিবাদেই সীমাবদ্ধ হয়ে আছে এসব ইস্যু। এই প্রেক্ষাপটে ‘আমরা কন্যাশিশু-প্রযুক্তিতে হব সমৃদ্ধ; ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ব’ প্রতিপাদ্য দিয়ে পালিত হচ্ছে জাতীয় কন্যাশিশু দিবস। কন্যা শিশুর প্রতি জেন্ডারভিত্তিক বৈষম্য রোধে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সুষ্ঠু বিকাশের বিষয়টিকে বৃহত্তর সামাজিক আন্দোলনে রূপ দিতে ২০০০ সালে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় একটি সরকারি আদেশের মাধ্যমে শিশু অধিকার সপ্তাহের দ্বিতীয় দিনকে কন্যাশিশু দিবস হিসেব পালনের লক্ষ্যে ৩০ সেপ্টেম্বরকে ‘জাতীয় কন্যাশিশু দিবস’ হিসেবে পালনের ঘোষণা দেয়। তখন থেকেই প্রতি বছর দিবসটি পালিত হচ্ছে।

বাল্যবিয়ে : বাল্যবিয়ে বাংলাদেশের বৈশ্বিক অবস্থান চতুর্থ। দেশের প্রায় ৫১ শতাংশ কন্যাশিশু

বাল্যবিয়ের শিকার। গত দুই বছরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় উঠে এসেছে, বাংলাদেশে ৫৯ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয় ১৮ বছরের আগে এবং ২২ শতাংশ মেয়ের ১৫ বছরের আগে। কিন্তু করোনাকালে ১৩ শতাংশ বাল্যবিয়ে বেড়েছে, যা ২৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। গত ৩ বছর ধরে দেশে বাল্যবিয়ের হার বেড়েছে। সেভ দ্য চিলড্রেনের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী ৫ লাখ মেয়ে বাল্যবিয়ের ঝুঁঁকিতে, যার ২ লাখ দক্ষিণ এশিয়ায়। প্রায় ১০ লাখ বাল্যবিয়ের শিকার হওয়া অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের সন্তানসম্ভবা হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে। ২০২৫ সাল নাগাদ বাল্যবিয়ে বেড়ে ২ কোটিতে উঠবে বলে আশঙ্কা। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের গবেষণায়, ৮৫ শতাংশ অভিভাবক প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই কন্যাসন্তানকে বিয়ে দিতে আগ্রহী। ৭১ শতাংশ বলছে, স্কুল খোলায় অনিশ্চয়তা এবং মহামারি দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার আশঙ্কায় বাল্যবিয়ের প্রতি ঝুঁকছে তারা; ৬২ শতাংশ জানায়, প্রবাসী ছেলে সহজেই পেয়ে যাওয়ায় তারা মেয়ের বিয়ে দিচ্ছে। প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের জরিপ বলছে, দেশের সবচেয়ে বেশি বাল্যবিয়ে কুড়িগ্রামে হলেও করোনাকালে দেশের প্রতিটি জেলায় এর হার বেড়েছে।

মাতৃমৃত্যু : বাল্যবিয়ে বেড়ে যাওয়ায় পরিণত বয়সের আগেই গর্ভধারণ করছে অনেকে। ফলে সন্তান জন্মদিতে গিয়েই অনেকেই পড়ছেন নানা জটিলতায়। অনেকেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করছে। করোনাকালে প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব ৯ শতাংশ কমেছে। ফলে প্রসূতি মায়ের মৃত্যুর হার বাড়ছে। সরকারের হিসাব মতে, দেশে ৫০ শতাংশ মানুষ প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের আওতায় ছিল। কিন্তু করোনার প্রভাবে তা কমে আসে। সর্বশেষ ‘ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম’ (এমআইএস) রিপোর্ট মতে, এই হার বর্তমানে ৪১ শতাংশ। করোনাকালে মাতৃমৃত্যু বেড়েছে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাল্যবিয়ের কারণে নারীদের অপ্রাপ্ত বয়সে গর্ভধারণ, গর্ভপাত ও অনিরাপদ সন্তান প্রসবের ঘটনা বাড়ছে, সন্তান ও মায়ের অপুষ্টিজনিত রোগ বাড়ছে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ঝরে পড়া : কোভিড-১৯ এর কারণে দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় পড়াশোনার সঙ্গে সম্পর্ক নেই বেশির ভাগ শিশুর। বেসরকারি সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) বলছে, করোনায় বাংলাদেশ দারিদ্র্যের হার বেড়ে ৪২ শতাংশ হয়েছে। আগে এটা ছিল ২০ দশমিক ৫ শতাংশ। চরম দরিদ্র অবস্থার মধ্যে আছেন ২৮ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ। বাংলাদেশে প্রাথমিক পর্যায়ে ড্রপআউট (ঝরে পড়া) শতকরা ১৭ ভাগ; মাধ্যমিক পর্যায়ে ৩৭ ভাগ। ছেলে শিক্ষার্থীদের তুলনায় মেয়ে শিক্ষার্থীরাই বেশি ঝরে পড়েছে।

অপুষ্টি : ইউনিসেফের প্রতিবেদনে বলা হয়, অপুষ্টিতে ভুগছে বিশ্বের ৯১ দেশের শিশু। বাংলাদেশসহ ১০টি দেশ খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ২০৩০ সালের লক্ষ্য সামনে রেখে গত দশকে কিছুটা উন্নতি করেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইভ ডাটার পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৪ সালেও দেশের ৫ বছর পর্যন্ত বয়সি শিশুদের ৩৩ শতাংশের ওজন ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে কম। ২০১৯ সালের মধ্যে তা নেমে আসে ২২ দশমিক ৬ শতাংশে। অন্যদিকে গত বছর করোনাকালে স্বল্প ওজনের শিশুর হার ৬ দশমিক ৪ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৯ শতাংশে। অপুষ্টির শিকার শিশুদের মধ্যে বড় একটি অংশই হচ্ছে কন্যাশিশু।

যৌন নির্যাতন : করোনাকালে শিশুরা বিশেষ করে কন্যাশিশুরা বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ব্র্যাকের জরিপে বলা হয়, বাল্যবিয়ে বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে বেড়েছে নারী নির্যাতনের হারও। গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের ৫ থেকে ১২ বছরের শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের ৭০ শতাংশই যৌন নির্যাতনের শিকার। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত সাত মাসে ৪৬২ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App