×

মুক্তচিন্তা

জন্মদিনে একটি বিশেষ অনুরোধ

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০১:৪৪ এএম

নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বেই একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে আমি সজীব ওয়াজেদ জয়কে নমিনেশন দেয়ার অনুরোধ করেছিলাম। জয়ের সঙ্গে আমার কোনো পরিচয় আছে বা কোনো দিন কথা হয়েছে বলে মনে পড়ছে না। কিন্তু তার শিক্ষা, নিষ্ঠা, প্রজ্ঞা ও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ও বাচন ভঙ্গিতে আমি আকৃষ্ট হয়েছিলাম। আমি ভেবেছিলাম শেখ হাসিনা ও ড. ওয়াজেদ মিয়ার সুযোগ্য সন্তান হিসেবে নয়; বরং তার আপন বৈশিষ্ট্যে বা স্বকীয়তায় তাকে রাজনীতিতে আনা উচিত। আমি জানতাম রাজনীতিতে জয় আসলে তিনি নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, তবে প্রথমত আওয়ামী লীগ ও দ্বিতীয়ত দেশটা বিশেষভাবে উপকৃত হবে। আমি বলেছিলাম যে আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতানেত্রীর সুযোগ্য সন্তানদেরও আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে টেনে আনা উচিত। আমি এটা স্বজনপ্রীতি বা পরিবারতন্ত্র কায়েমের কৌশল না বলে বরং মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে বাঁচিয়ে রাখার উপায় হিসেবে দেখেছিলাম। আমার এসব কথা সাপ্তাহিকটিতে পড়ে অনেকেই বলতে শুরু করল যে আমি নাকি আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসার গন্ধ পেয়েছি এবং আগের বারে কোনো কিছু না পাওয়াজনিত বঞ্চনা পুষিয়ে নিতে অগ্রিম মাঠে নেমেছি। আমার প্রস্তাবনাটা ছিল আমার অভিজ্ঞতার ফসল। আমার অভিজ্ঞতা বলছে বঙ্গবন্ধুর শাহাদতের পরে আওয়ামী লীগ যে পথে চলছিল তা চলতে দিলে আজ কোথায় অবস্থান হতো বঙ্গবন্ধুর, কোথায় থাকত আওয়ামী লীগ, আর কোথায় থাকত মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ! সেই ১৯৮২ সালে শেখ হাসিনা যদি দেশে না আসতেন, যদি আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব না নিতেন তাহলে এদেশে বারো ভূঁইয়ার রাজত্বের ন্যায় বহু আওয়ামী লীগের জন্ম হতো; ক্রমেই এসব কুচক্রীরা ভিন্ন দলে মিশে যেত। শেখ হাসিনা দেশে প্রত্যাবর্তনের পরও আওয়ামী লীগকে মেরে কেটে খাবার প্রবণতা ছিল। এমনকি ১৯৯১ সালে নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের বহু বড় নেতা বিএনপি কিংবা ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে মিশে যেতে চেয়েছিল। শেখ হাসিনা শীর্ষে ছিলেন বলে তাদের সে প্রচেষ্টা সফল হয়নি। এই ঘটনা বহু আগের একটি ঘটনাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ১৯৬৬ সালের পরের ঘটনা। বঙ্গবন্ধু তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় মৃত্যু পথযাত্রী; তখন দলের সংহতি অপরিহার্য ছিল, তখনই তার মামা এবং দলের সহসভাপতি আবদুস সালাম ও অন্যদের প্ররোচনায় দল বিভক্তির জন্য ৬ দফার বিপরীতে ৮ দফার আওয়ামী লীগ সৃষ্টি করা হলো। সেদিন এই প্রয়াসকে প্রতিহত করেছিলেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা। তার মতো দৃঢ়চিত্তের ও সাহসী গৃহবধূ না থাকলে এবং তিনি বেসরকারিভাবে দলের নেতৃত্ব না নিলে সে যাত্রায় শেখ মুজিবের ভবিষ্যৎ তলিয়ে যেত। শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতা বা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হতেন না। সম্ভবত তারপরের ইতিহাস সবার জানা। আঘাত আওয়ামী লীগের চলার সাথী। আওয়ামী লীগের ওপর বড় এক আঘাত এসেছে ২০০৪ সালে গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে। তারপরও ছোট-বড় আঘাত এসেছে; দুই বছর মেয়াদি সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। নেত্রী শেখ হাসিনা সাব জেলে নীত হলে ষড়যন্ত্র এমনভাবে জমেছিল যে, আওয়ামী লীগ বলতে গেলে এক মহাসংকটে পড়ে গিয়েছিল। এমন দুর্দিনে শেখ হাসিনা যদি আওয়ামী লীগের প্রধান না থাকতেন এবং তার নেতৃত্বের প্রতি অনুগত এবং বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ প্রেমিক এক ঝাঁক তরুণ না থাকত, তাহলে আওয়ামী লীগ বহু শাখায় বিভক্ত হয়ে যেত। তার পরিণতি কী হতো তা চিন্তা করলে গা শিউরে ওঠে। শেখ হাসিনা না থাকলে তারাই বঙ্গবন্ধুকে ভাঙিয়ে খেতে খেতে দেশটাকে নিঃশেষ করে দিত। তাই শেখ হাসিনা বা পরিবারের স্বার্থে নয়, বরং বাঙালির স্বার্থে, বাংলার স্বার্থে, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের স্বার্থে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে শেখ হাসিনা বা তার পরিবারের কাউকে না কাউকে থাকতে হবে বলে আমি বলেছিলাম। উত্তরাধিকারের প্রশ্নটা আমার কাছে মুখ্য বিষয় ছিল, কেননা শেখ হাসিনা চিরঞ্জীব হবেন না; হলে বরং খুশি হতাম। এমনকি সুস্থ-সবল থেকে কয়েকবার প্রধানমন্ত্রিত্বের পর হয়তো তিনি আর রাজনীতিতেও থাকবেন না। তিনি অবসরে যাওয়ার চিন্তাও করেছিলেন। স্বভাবত প্রশ্ন জাগে- শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগকে কে বা কারা লালন-পালন করবে? পরিবারের যোগ্য সদস্যরা যদি পারিবারিক ঐতিহ্যের ধারক-বাহক হন, তাহলে সে ঐতিহ্যকালে সমৃদ্ধ ঐতিহ্যে পরিণত হয়। সে দৃষ্টিকোণ থেকে যোগ্য ব্যক্তি যদি ঐতিহ্যের ধারায় আসে, তাহলে তাকে পরিবারতন্ত্র বলা যাবে না। বলা যাবে স্থলাভিষিক্ততা। স্থলাভিষিক্ততার খাতিরে আমার প্রস্তাবটি ছিল সজীব ওয়াজেদ জয়কে অবিলম্বে রাজনীতিতে নিয়ে আসা হোক। ২০০৯ সালের নির্বাচনে জননেত্রী তিনটি আসনে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাই আমার প্রস্তাব ছিল জননেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার রংপুরের আসনটি ছেড়ে দিলে যে উপনির্বাচন হবে তাতে সহজেই জয়কে প্রার্থী করে সংসদে নিয়ে আসা যাবে। আমার ধারণা এ নিয়ে বহু বছর আগেই তার রাজনীতিতে প্রবেশটি নিশ্চিত হয়ে যাবে এবং মায়ের সংস্পর্শে থেকে পরিপক্বতা অর্জন করবে, যেমনটি ঘটেছিল নেহরু কন্যা ইন্দিরার ক্ষেত্রে। আজ হোক, কাল হোক বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে তাকেই আসতে হবে। দ্বিতীয়ত শেখ হাসিনার গোপালগঞ্জের আসনটি শেখ রেহানাকে দেয়া যেতে পারে। আমি বলব না যে শেখ রেহানা বাংলাদেশের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হবেন। যোগ্যতার ভিত্তিতে হলে আপত্তির কারণ কোথায়? এসব বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে কে কীভাবে কখন থাকবেন তার রূপকল্প তৈরি কি জরুরি নয়? নব প্রজন্মের অনুপ্রেরণার উৎস বা রোল মডেলের কথাটিও এখানে জড়িয়ে আছে। অনুপ্রেরণার কথাটায় আসি। আমাদের কালে দেখেছি বড় বড় রাজনীতিবিদ, সাংসদ, মন্ত্রীদের সন্তানাদি হয় যতনে রাজনীতি পরিহার করত, কিংবা বাবা-কাকার বিপরীতে অবস্থান নিত। আমরা তাদের সমালোচনা করতাম। অথচ দুর্যোগ-দুর্দিনে আমরা শেখ পরিবারের সদস্যদের দেখেছি অনুপ্রেরণার আকর হিসেবে; তারা ছাত্রলীগ বা আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্যদিকে ছোটাছুটি করেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার আগে শেখ হাসিনা গভর্নমেন্ট ইন্টারমিডিয়েট কলেজের সংসদ নির্বাচনে ভিপি ছিলেন, তার আগেও ছাত্রলীগ রাজনীতিতেই ছিলেন। ছাত্র রাজনীতিতে তার প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ আমাদের জন্য অনন্ত প্রেরণার উৎস ছিল। তার বিশ্ববিদ্যালয়ে আগমনের পরই ছাত্রী হলের সংসদে ছাত্রলীগ নির্বাচিত হতে শুরু করে, যা একদিন ছিল ছাত্র ইউনিয়নের সম্পূর্ণ দখলে। ’৬৯-এর গণআন্দোলনের সময়ে তার সরব উপস্থিতি আমাদের সারাক্ষণ স্মরণ করিয়ে দিত যে, শেখ মুজিবের কন্যা যখন রাজপথে নামতে পারে, আমরা বসে থাকব কী কারণে? মুক্তিযুদ্ধের কালে ইলিয়াছ আহম্মদ চৌধুরী (দাদাভাই), শেখ ফজলুল হক মনি, সেলিম, কামাল, মারুফ ও জামালকে কাছে পেয়ে গর্বভরে সবাইকে বলতে পেরেছি যে, বঙ্গবন্ধুর স্বজনরা যখন যুদ্ধে নামতে পারে, তখন কারো কি বসে থাকার কোনো অবকাশ আছে? দেরাদুনে প্রশিক্ষণকালে জামাল ও মারুফ আমার রুমমেট ছিল। শুধু সেদিন নয়, আজো অতিশয় আনন্দ ও বেদনার সঙ্গে সে স্মৃতি স্মরণ করে উদ্বেলিত হই। এসব কারণে শুধু জয় কিংবা শেখ রেহানার রাজনীতির কারণে রাজনীতিতে পদার্পণ নয়, বরং অন্যদের প্রেরণার উৎস হিসেবে এবং দলের রূপকল্প বাস্তবায়নের জন্য একান্ত আবশ্যক। আমি আরো মনে করি, আওয়ামী লীগের সব নেতাকর্মীর সন্তানাদি শুধু উত্তরাধিকার হিসেবে নয় বরং যোগ্যতা দিয়েই একই রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে হবে। জানি রাজনীতিতে আওয়ামী বলয়ের বাইরে তারা বিকশিত হলে সমালোচকরা বলবেন গাদ্দারীপনা, আর আওয়ামী লীগে যোগ দিলে বলবে পরিবারতন্ত্র। ওরা যাবেটা কোথায়? অযোগ্য কেউ উড়ে এসে জুড়ে না বসলে ও যোগ্যতার মাপকাঠিতে দলমুখী হলে তাকে নিঃসন্দেহে বলব- দলপ্রেম বা আওয়ামী লীগের জন্য দেশপ্রেমের নামান্তর। আমার নিজের কথা এসে যায়। আমরা সবাই জানি আমার অবর্তমানে আমার জমি-জিরেত অন্য কেউ নয়, আমার সন্তানই পাবে। প্রচলিত প্রবাদ আছে, সে জমি ভালোভাবে চষবে আমার সন্তানরাই, মায়ের চেয়ে মাসির দরদও বেশি তা প্রমাণিত হবে না। তাই আমার দেশের জন্য, আমার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের জন্য আমার সন্তানকেই মুখ্য ভূমিকা নিতে হবে। আমার স্বাধীনতা আমার সম্পদ। এই সম্পদের উত্তরাধিকার আমার সন্তানরাই হবে; বৈমাত্রের ভাইয়ের সন্তানেরা নয়। দেশরতœ শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে কি তা অপ্রযোজ্য? আমার আকাক্সক্ষা তখন আকাক্সক্ষাই রয়ে গেল। সম্প্রতি একই চিন্তার ধারাবাহিকতায় ঢাকা-১০ আসনের উপনির্বাচনে আমি সজীব ওয়াজেদ জয় বা সায়েমা ওয়াজেদ পুতুল কিংবা শেখ রেহানাকে প্রার্থী হিসেবে দেখতে চেয়েছিলাম। তা যখন হলো না তখন আমি বিকল্প চিন্তা লালন করছি। প্রধানমন্ত্রী আমরা আপনার অপরিহার্যতা নিয়ে কথা বলি, লিখি এবং অন্যদের বুঝিয়ে থাকি। এই যে বর্তমান দুর্যোগ তা মোকাবিলার জন্য আপনার বিকল্প আপনি নিজেই। আপনি মৃত্যুকে ভয় করেন না, মানে অবশ্যম্ভাবিতা সম্পর্কে আপনি নিশ্চিত ও দৃঢ়বিশ্বাসী অর্থাৎ এটা আপনার ইমানের অংশ; তবে আজ হোক, কাল হোক কিংবা পরশু হোক আপনাকে এই পৃথিবীর মায়া, এদেশের মায়া, এদেশের মানুুষের মায়া ছেড়ে চলে যেতে হবে। আপনি যদি অমর হতেন কিংবা সুস্বাস্থ্য নিয়ে শতায়ু হতেন তাহলে আমরা আমাদের স্বার্থেই আপনার বিকল্পের কথা কস্মিনকালেও ভাবতাম না। সেটা যখন সম্ভব নয় এবং মৃত্যু যখন আপনাকে একদিন হানা দেবেই, তখন সবাইকে অসহায়, এতিম হিসেবে রেখে যেতে পারবেন না। আপনার অনবদ্য সৃষ্টি রক্ষা ও বঙ্গবন্ধুর অবিনশ্বর আদর্শ চলমান রাখার জন্য আপনার উত্তরাধিকার বা অন্তত উত্তরসূরি নির্বাচন করে দিন। আপনি আপনার চোখের সামনেই আপনার চেয়ে কম বয়সিদের চলে যেতে দেখছেন। কাউকে কাউকে শেষবারের জন্য দেখতেও গিয়েছিলেন। আমরা আঁতকে উঠেছি। এখন ছবিতে আপনাকে ক্ষানিকটা বিমর্ষ বা পরিশ্রান্ত দেখালেও অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। বর্তমান দুঃসময়ে বা দুঃসময় কেটে গেলে আপনার যদি কিছু ঘটে যায় তাহলে দেশ, জাতি ও সাধারণ মানুষ কার আশ্রয়ে নীত হবে? জানি আমার এই লেখা আপনাকে আতঙ্কিত করবে না; আর আমাকে প্রাপ্তি শিকারির তালিকায় কেউ ফেলবে না। কারণ আমি আরো চার বছরের জন্য উপাচার্য নিয়োজিত হয়েছি। এ মেয়াদ শেষ হতে হতে হয়তো ওপারের ডাকও এসে যাবে। তাই আমার ইচ্ছেটা হলো নৈর্ব্যক্তিক। আপনার কাছে অনুরোধ, আজকে আপনার ৭৫তম জন্মদিনে উত্তরসূরি নির্বাচন করে তাকে বা তাদের আত্মস্থ হওয়ার সময় ও সুযোগ দিলে দোষটা কোথায়? আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুক। শুভ শুভ শুভ দিন, শেখ হাসিনার জন্মদিন। আমি আপনার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী : বীর মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষাবিদ ও উপাচার্য ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App