×

মুক্তচিন্তা

প্রতারক রকমারি

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১২:১৮ এএম

প্রতারক রকমারি

পাশ্চাত্য দেশগুলোকে চিরায়ত আর পল্লীগীতির (কান্ট্রি মিউজিক) রমরমা ভুবন থেকে আচানক রক আর পপ (পপুলার) গানের মহাপ্লাবনে ভাসিয়ে তাতিয়ে মাতিয়ে দিল বিশেষত বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে। আমাদের দেশে চিরায়ত আর পল্লীগীতির বাইরে যন্ত্রসংগীতের প্রাধান্য এবং শরীরী দোলনে যে গান তরুণ সমাজে জনপ্রিয় হয়ে উঠল তার নাম এক কথায় ব্যান্ড সংগীত। বয়সিরা এদেশে পছন্দ করে মেলোডি আর ট্র্যাজেডির সমাহার। আবার লালন, হাসন রাজা, শাহ করিমের গানে কিঞ্চিৎ যন্ত্রের বাহার বাড়িয়ে দিলেও দু-প্রজন্মের মেলবন্ধন মন্দ হয় না। এদিকে রুদ্রের গান ‘ভালো আছি, ভালো থেকো/আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো’ বিশ্ববাঙালি, পূর্ব-পশ্চিম উভয় বাংলা বাসিন্দাদের কাছে বড় বড় নামজাদা শিল্পীদের কণ্ঠে কণ্ঠে ফেরে। এমন মৃদুমন্দ জনপ্রিয় গান দরদি মরমিয়া রসায়নে সিক্ত করে বেশ কিছুকাল ধরে আমাদের মন ভরিয়ে দিচ্ছে। কানের ভেতর দিয়ে সরাসরি মরমে। বন্ধুরা উপরের বাক্যগুলোর সঙ্গে আজকের লেখার মূল প্রতিপাদ্যের কোনো সম্পর্ক নেই। শুধু একটি শব্দ ছাড়া। শব্দটি হলো ‘রক’। এই ‘রক’ দিয়ে হয় রকমারি। সঙ্গে ঝকমারি। রকম সকম বাক বাকুম। রকমফের। নাহ! তবু নাগাল মেলেনি। তাহলে উল্টো দিকে যাওয়ার অনুমতি দিন। ‘রক’ শব্দটির আগে শব্দ-প্রত্যয়-ইত্যাদি যুক্ত করতে চাই। ধরুন স্মৃতিময় স্মারক গ্রন্থ। স্মারক পদক। স্মারক লিপি। না, তা-ও আজকের বিষয়ে প্রবেশাধিকার পেলাম না। তাহলে ‘মুবারক’। হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয় নাটকের অতি জনপ্রিয় চরিত্রের একজন। কিংবা ঈদ মুবারক। তাতেও কাজ হলো না। মিলাদের ‘তবারক’। হলো না হলো না। ‘হন্তারক’? ভয়ংকর শব্দ। রক্ত আর রক্ত। ওটা তো ঝরছেই ঝরছেই। ১৯৭১ সালে আমাদের নদীমাতৃক দেশ ওই হানাদাররা কেমন ‘রক্তমাতৃক’ বানিয়ে দিল। আজকের প্রতিপাদ্যে ‘হন্তারক’ বিষয়টিও নেই। তাহলে? তাহলে এবার আসুন সেই মহাপরিচিত শব্দে। যেটি হলো ‘প্রতারক’। মানে ঠকবাজ। মানে ধোঁকাবাজ। মিষ্টি হেসে ছুরি বসিয়ে দেয় যারা। ঠক বা ঠগদের পরিচয় পেয়েছি বংকিমী উপন্যাসে। কেমন করে পথিককে ঠকিয়ে অরণ্যে ঢুকিয়ে সব কেড়েকুড়ে নেয়, তারপর ওই প্রতারকরা হন্তারকে পরিণত হয়। ঠকবাজ, ধোঁকাবাজ, প্রতারকদের এদেশে এখন রমরমা গমগমা বাজার। আদম পাচারের নামে প্রতারণার কাহিনী বয়ান করলে তো মহা-উপন্যাস তৈরি হবে নিমেষে। এদেশে কত তরুণ যে জমাজমি বিক্রি করে আদম-পাচারি প্রতারকের শিকার হয়ে দম যায় যায় নিঃস্বে পরিণত হচ্ছে প্রতিদিন। তবু প্রতারিত হতে ইচ্ছুক মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলছে। প্রতারকদের শিল্পকলা দারুণ। কেমন করে শিকারকে প্রভাবিত-প্রলুব্ধ করতে হয়, সে বিদ্যায় তারা স্বয়ংক্রিয় ওস্তাদ। একেবারে ‘ঘাসের গোড়া’ থেকে ‘ক্ষমতার মগডাল’ পর্যন্ত এদের ঘোরাফেরা। এরা বড় বড় মহাজন-মহাজনীদের কাছাকাছি ভেড়ে, একসঙ্গে ‘পটু’ তোলে। সাধারণরা ওইসব ভেটকি মার্কা পটু দেখে টাস্কা খেয়ে প্রতারণার ফাঁদে পা দেয় অবিরল। নিয়োগ বাণিজ্যের প্রতারণা? একেবারে গিজগিজ সারাদেশে। সেজন্য ক্ষমতা পার্টির একটি গলি শাখার সাধারণ সদস্য হওয়ার জন্য কী যে অসাধারণ আকুলি-বিকুলি। ১০ লাখ টংকের অঙ্ক মিলিয়ে যদি নিরাপত্তা বাহিনীতে কেউ ঢুকে তাহলে সেই টাকা তুলতে ‘শ্যালক পাবলিকের’ পশ্চাদ্দেশ ‘লাল’ করে ভয় দেখাবার মেলাতো জমবেই সারাদেশে। এই পন্থায় কেউ যদি শিক্ষক পদে সমাসীন হন, তিনি শ্রেণিকক্ষে ছাত্রদের ‘সততা’ শিক্ষাদানে যদি বারবার হিক্কা তোলেন, তাতে অবাক হবেন ভ্রাতা এবং ভগিনীবৃন্দ! তবে পাবলিক প্রবরেরা অর্থ দিয়ে চাকরি গ্রহণকে এখন আর ‘দুর্নীতি’ও মনে করেন না। যদি মাল দিয়ে কেউ কাম না করেন তাহলে সেটাকে যুগপৎ ‘দুর্নীতি ও প্রতারণা’ মনে করে সবাই। সমাজের মূল্য এবং বোধ কার্যত নির্বোধ হয়ে যাচ্ছে। অতএব বিশেষত বাংলাদেশের প্রবাসী মেধাপুষ্ট বাহিনী দেশের এসব হতদ্দশায় এতই হতাশ যে ‘বদন পুস্তক’ অর্থাৎ ফেসবুক হায় আফসোস এবং নিন্দা-ঘৃণায় ভরপুর করে দিচ্ছেন। তা ভালো। তবে ১৮ কোটি লোকের এদেশে যদি নিয়মিত যথাসংখ্যক কর্মসংস্থানের সোজা পথ না থাকে, তাহলে বাঁকা পথের অবারিত সুযোগ তো গড়ে উঠবেই। এদিকে ভারতের তর্কাতীত সৎ ব্যক্তি মনমোহন সিং তো একবার এহেন কথা বলেই ফেলেছেন, উন্নয়ন এবং দুর্নীতি সমান্তরালেই চলবে। তা বাংলাদেশ, ভারতের দুর্নীতির কথা জানি। বেগমপাড়া-সেকেন্ড হোমের কথা জানি। সিঙ্গাপুরে নব্য ধনিক দুর্নীতি তারকাদের সেকেন্ড হোমের খবর কি রাখেন? পৃথিবীতে এখন নাকি এক নম্বর ঘুষদাতা দেশ প্রতিবেশী ভারত। আর স্বপ্নের দেশ সুইজারল্যান্ড! পৃথিবীর অন্যান্য দেশের দুর্নীতির মাল মজুদের অন্যতম নিরাপদ কেন্দ্র ‘সুইস ব্যাংক’। সে বিচারে দুনিয়ার বহুকালের এক নম্বর দুর্নীতিবাজ দেশ তো সুইজারল্যান্ডই। টিআইবির মহান নেত্রী সুলতানা কামাল, মহান ডক্টরেট ইফতেখার মহোদয় এ ব্যাপারে কোনো ‘নৈতিক’ ব্যাখ্যা দিতে পারবেন কি? ওসব ভণ্ডামি শিল্পকলার ব্যাখ্যা বয়ান থাক। কোনো প্রকারের দুর্নীতির সপক্ষে কোনো ধরনের সাফাই দিয়ে বিবেক সাফসুতরো করার অবকাশ নেই আপনার, আমার, কারো। তবে দীর্ঘ ছয় বছর বাংলাদেশকে ‘এক নম্বর দুর্নীতিবাজ’ দেশ আখ্যা দিয়ে টিআইবি যে এক-এগারোর পথ সুনামের দায়িত্ব নিয়েছিলেন তার প্রথম পর্বে সফল হলেও দ্বিতীয় পর্বে সফল হননি। মহীয়সী শ্রদ্ধেয়ার সন্তানও যে এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হবেন তা ভাবতেও শিউরে উঠি। সর্বশেষ আসি দুর্যোগ এবং দুর্নীতির কথায়। এদেশে সমাজের নানা অংশে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ে বিশেষত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। সে সময় দুর্ভিক্ষের সুযোগে চাল ব্যবসার চালবাজিতে বিপুল ধনশালী মহান ব্যক্তিদের এখনো দানশীল মহাআইকন হিসেবে সমাজ গণ্য করে। পৃথিবীতে করোনা প্যান্ডামিকেও বিলিয়ন মানুষের আর্থিক অবস্থা সকরুণ হয়ে পড়েছে। আর পৃথিবীজুড়ে বিলিয়ন বিলিয়ন কামানোর নজিরও পাশাপাশি কম দেখি না। আমাদের এক পুঁকা সাহেদ আর পুঁচকি সাবিনা করোনা পরীক্ষার প্রাথমিক সময়ে দানবিক প্রতারণা করে বহু মানুষের জীবন নিয়ে খেলা করেছে। আমাদের করোনা প্রতিরোধ সামগ্রীর কেনাবেচা কেলেঙ্কারির ফলে সরকারি ওষুধ নির্মাণের কারখানার নির্দোষ প্রধান অপমান সহ্য করতে না পেরে হৃদযন্ত্রের বিপাকে প্রাণ দিয়েছেন। তারপর টিকা কেনাকাটা, রোজিনা অধ্যায়, আরো কত কিছু। টিকা চুরি করে বেচার অপরাধীও ধরা পড়েছে। ১৯৭৯ সালে প্রথম কলকাতা যাই উত্তম-সুচিত্রা রোমান্টিক রসায়নের অনবদ্য প্রান্তরে। তখন কলকাতায় এখানে-সেখানে আবর্জনার স্তূপ, কয়লার চুলার গন্ধ বিবমিষা এনে স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছিল। এবার করোনাকালে পৌরসভার বড় কর্তা সেজে ভুয়া টিকাদান কেন্দ্র খুলে সাহেদের বাপের বাপ দুর্বৃত্ত ধরা পড়েছে দেখলাম। ভিআইপি গাড়ির বাতি জ্বালিয়ে কত যে প্রতারক। টিকা চুরিরও নানা আলামত। দুর্যোগে যেমন মানবিক শক্তি জাগে, তেমনি দুর্বৃত্তে প্রতারকও জেগে ওঠে। পৃথিবীজুড়ে।

হিলাল ফয়েজী : মুক্তিযোদ্ধা ও রম্যলেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App