×

জাতীয়

উজানে পানি নেই, দখল-দূষণ চলছেই

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১২:০১ এএম

উজানে পানি নেই, দখল-দূষণ চলছেই

উজানে নেই পানি। ফাইল ছবি

ঘটা করে উচ্ছেদ অভিযান আর বড় বড় প্রকল্প নেয়া হলেও দেশের নদনদী রক্ষায় কাজের কাজ খুব একটা হয়নি। উজানে পানি কমে যাওয়া এবং ভাটিতে পলি ভরাট, দখল ও দূষণের কারণে গত ৪ দশকে বিলুপ্ত হয়েছে দেশের ১৭৫টি নদনদী। বাকি ২৩০টিও রয়েছে ঝুঁকির মুখে। নদী রক্ষায় দেশে একক ক্ষমতাসম্পন্ন কোনো কর্তৃপক্ষ তৈরি হয়নি আজো। সমন্বয় করা যায়নি সংশ্লিষ্ট ২১ মন্ত্রণালয়, সংস্থা ও কর্তৃপক্ষের মধ্যেও। নদী রক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছে বটে, কিন্তু আদালতের নির্দেশের পরও একে স্বাধীন করা হয়নি। কমিশনের ক্ষমতায়নের জন্য যুগোপযোগী আইন করার বিষয়টিও ঝুলে আছে। এ অবস্থার মধ্যেই আজ দেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব নদী দিবস।

১৯৮০ সালে কানাডার খ্যাতনামা নদীবিষয়ক আইনজীবী মার্ক অ্যাঞ্জেলো ‘নদী দিবস’ পালনের উদ্যোগ নেন। ২০০৫ সালে জাতিসংঘ নদী রক্ষায় জনসচেতনতা তৈরি করতে ‘জীবনের জন্য জল দশক’ ঘোষণা করে দিবসটি অনুসমর্থন করে। এরপর প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসের শেষ রবিবার জাতিসংঘের বিভিন্ন সহযোগী সংস্থা দিবসটি পালন করছে। ২০১০ সাল থেকে বাংলাদেশেও সরকারি-বেসরকারি নানা আয়োজনে এ দিবসটি পালিত হচ্ছে।

নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদনদী রক্ষাই অনেক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, এক্ষেত্রে সরকারের শুধু সমন্বয়হীনতা রয়েছে- তা নয়। নদী রক্ষায় সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতা ও সততারও যথেষ্ট অভাব রয়েছে। এ কারণে নদী রক্ষার অনেক প্রকল্পের সুফলই শেষ পর্যন্ত নদীর কাজে আসতে দেখা যায়নি। এমনকি অনেক সময় দখলদারদেরও আইনগতভাবে প্রতিষ্ঠিত করার ঘটনাও ঘটেছে।

নদী রক্ষার দায়িত্ব কার : নদীর সঙ্গে খাল, বিল, জলাশয়ের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে। পানি বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী তোফায়েল আহমদ বলেন, বিষয়টি প্রাকৃতিক ভারসাম্যের অংশ। আমাদের জীবন-জীবিকা, জীববৈচিত্র্য, কৃষি, পরিবেশ- সব কিছুকে ধারণ করে নদী ও এর জল প্রবাহ। কিন্তু দেখা গেছে, দেশে নদী ও খাল-বিলের একেকটি অংশ একেক মন্ত্রণালয়, কর্তৃপক্ষ বা সংস্থার নিয়ন্ত্রণাধীন। এ রকম তিনটি মন্ত্রণালয়সহ ২১টি কর্তৃপক্ষ নদীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জানিয়ে তিনি বলেন, বর্তমানে নদীর তীর রক্ষা ও বন্যা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পানি উন্নয়ন বোর্ডের, আর বন্দর এলাকায় তীরভূমি ও নৌপথের দেখভালকারী প্রতিষ্ঠান হচ্ছে বিআইডব্লিউটিএ।

পানির দূষণ নিয়ে কাজ করে পরিবেশ অধিদপ্তর। আবার নদী তীরের হাট-ঘাট, বালু মহল ইত্যাদি ইজারা দেয় জেলা প্রশাসন। কোথাও খালগুলোর দেখভালের দায়িত্ব সিটি করপোরেশন, পৌরসভা বা ওয়াসার। নদীর উপর কোথাও সেতু নির্মাণ করছে সেতু বিভাগ, রেলপথ মন্ত্রণালয়, কোথাও বা এলজিইডি। সব মিলিয়ে দেশের নদনদী ও খাল-বিল রক্ষার বিষয়টি বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার মধ্যে বিভক্ত। ফলে দখল, দূষণ, পলি ভরাট, ভুল স্থাপনা নির্মাণসহ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নদী। নদীর তীর দখল করে শিল্প কারখানা, ভবন, বিদ্যুৎকেন্দ্র সবই গড়ে তুলছে যে যার মতো। কিন্তু দখল ও দূষণ রক্ষায় এককভাবে কারো দায়িত্ব নেই। একে অন্যের ওপর শুধু দায় চাপানোর প্রবণতা। এভাবে নদী রক্ষা সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।

অকার্যকর নদী রক্ষা কমিশন : জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন ২০১৩ অনুযায়ী নৌ মন্ত্রণালয়ের অধীনে গঠন করা হয় এই কমিশন। শুরু থেকেই লোকবল ও ক্ষমতার অভাবে খুঁড়িয়ে চলতে থাকে গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠানটি। গত ৮ বছরে বিভিন্ন নদনদী সরজমিন ঘুরে অসংখ্য সুপারিশ করেছে কমিশন। কিন্তু বাস্তবে তার অধিকাংশই কার্যকর হয়নি। আইন অনুযায়ী কমিশন শুধু সুপারিশ করতে পারে, তা মানতে বাধ্য নন কেউ। নদী রক্ষাসংক্রান্ত একটি রিট মামলার (১৩৯৮৯/২০১৬) রায়ে উচ্চ আদালত দেশের সব নদনদী দূষণ ও দখলমুক্ত করে সুরক্ষা, সংরক্ষণ এবং উন্নয়নের জন্য জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে আইনগত অভিভাবক ঘোষণা করেন। এজন্য কমিশনকে স্বাধীন ও কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশ দেন। তবে রায় ঘোষণার ৩ বছর পরও কমিশনকে স্বাধীন করা হয়নি। বর্তমানে মাত্র ৪৬ জন দিয়ে চলছে গোটা কমিশন। অথচ প্রতিটি জেলা ও বিভাগে কমিশনের অফিস করার কথা রয়েছে। নদী পরিদর্শনের জন্য কোনো নৌযানই নেই তাদের। চেয়ারম্যানের জন্য একটি জিপগাড়িসহ ৩টি যানবাহন দিয়ে খুঁড়িয়ে চলছে এই সংস্থাটি।

ঝুলে আছে আইনের সংস্কার : নদী রক্ষায় ২০১৩ সালের করা আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয় গত বছর। কিন্তু সেটির খসড়া এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এ নিয়ে আইন কমিশন চলতি বছর তাদের ১৫৫তম সুপারিশ ও মতামত দেয়। এতে বলা হয়, ২০১৩ সালে তড়িঘড়ি করে আইনটি তৈরি করায় কমিশনকে শুধু সরকারের কাছে পরামর্শ ও সুপারিশ করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। প্রায়োগিক ক্ষমতা দেয়া হয়নি। তাই নদী দখল ও দূষণকে ফৌজদারি অপরাধ গণ্য করে কঠিন সাজা ও বড় আকারের জরিমানা নির্ধারণ করে কমিশন আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধনের সুপারিশ করে আইন কমিশন। খসড়া জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন ২০২০-এ বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সব নদনদী, জলাধার, খাল-বিল, সমুদ্র উপকূল, হাওর, বাঁওড়, জলাভূমি, জলাশয়, ঝর্ণা, হ্রদ, পানির উৎস সব কিছুই এই আইন ও নদী রক্ষা কমিশনের আওতার মধ্যে থাকবে। এসব রক্ষা করা, অবৈধ দখল মুক্তকরণ, নদীর তীরে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ, বিলুপ্ত বা মৃতপ্রায় নদী খননের বিষয়ে পরিকল্পনাও করবে কমিশন। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবহমান সব নদী আইনি ব্যক্তি ও জীবন্ত সত্তা হিসাবে বিবেচিত হবে। নদ-নদীগুলো পাবলিক ট্রাস্ট ডকট্রিনের আওতায় জনসম্পত্তি বলে বিবেচিত হবে। নদী সংশ্লিষ্ট কোনো পরিকল্পনা করতে হলে পরিকল্পনা কমিশন, এলজিইডি, পানি উন্নয়ন বোর্ড, বিআইডব্লিউটিএ, বিএডিসিসহ সব সংস্থাকে কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করে নিতে হবে এবং অনাপত্তিপত্র নিতে হবে। একই সঙ্গে প্রতিটি বিভাগে নদী রক্ষা আদালত স্থাপন করার কথাও বলা হয়েছে খসড়ায়। শুধু সুপারিশের বদলে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, মামলা করার ক্ষমতা দেয়া হবে নদী রক্ষা কমিশনকে।

রক্ষা করা যাচ্ছে না ঢাকার নদী-খালও : ১৯৯৮ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) একটি রিটকে কেন্দ্র করে তৎকালীণ আওয়ামী লীগ সরকার প্রথম বুড়িগঙ্গাকে দখলমুক্ত করার পরিকল্পনা হাতে নেয়। তবে উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয় ২০০১ সালে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। এরপর ২০০৯ সালে আইনজীবী মনজিল মোরশেদের করা রিট (৩৫০৩/২০০৯) ও ২০১৬ সালের তুরাগকে নিয়ে করা আরেক রিট (১৩৯৮৯) আবেদনের রায়কে কেন্দ্র করে দফায় দফায় উচ্ছেদ অভিযান হয়। বুড়িগঙ্গা, বালু, তুরাগ ও শীতলক্ষ্যা রক্ষায় ওয়াকওয়ে, সীমানা পিলার নির্মাণসহ বিভিন্ন প্রকল্পও নেয় সরকার। কিন্তু এরপরও নদীগুলো দখল-দূষণমুক্ত করা যায়নি। গত ১২ জানুয়ারি জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেশের নদনদীর ভয়াবহ দখল ও দূষণের চিত্র উঠে আসে। তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের ৬৪ জেলায় ৬৩ হাজার ২৪৯ জন অবৈধ দখলদার চিহ্নিত করা হয়। এর মধ্যে দেখা গেছে, বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেল ও ঢাকার চারপাশের নদনদী দখল-দূষণের করুণ চিত্র। সাভারে ট্যানারি শিল্পের কারণে ধলেশ্বরী, বিভিন্ন শিল্প কারখানার কারণে শীতলক্ষ্যা এমনকি ঢাকা ওয়াসা ও সিটি করপোরেশনের কারণে ঢাকার অনেক খাল দূষণের কথাও উঠে আসে প্রতিবেদনে। এছাড়া আবাসন কোম্পানিগুলোর কারণে অন্তত ৮টি খাল বিলীন হওয়ার কথাও এ সময় জানায় কমিশন।

অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন সমস্যা : অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে এক দীর্ঘমেয়াদি অমীমাংসিত ইস্যু। ১৯৯৬ সালে গঙ্গার পানি বণ্টনের চুক্তি স্বাক্ষর হলেও তিস্তাসহ আলোচনায় থাকা ৮টি নদীর পানি ভাগাভাগির এখনো সমাধান হয়নি। ফলে উজানে পানি কমে যাওয়ায় দেশের অনেক নদী-খালই এখন প্রায় মৃত। বাংলাদেশ ও ভারতের ওপর দিয়ে প্রবাহিত অভিন্ন নদীর সংখ্যা ৫৪টি। যদিও যৌথ নদী কমিশনের গত জানুয়ারির বৈঠকে ৬টি নদীর পানি বণ্টনে একটি কাঠামো চুক্তি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এই নদীগুলো হলো- মনু ও মুহুরী, খোয়াই, গোমতী, ধরলা ও দুধকুমার।

সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল এন্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেসের নির্বাহী পরিচালক মালিক ফিদা এ খান জানান, ২০১১ সালে তিস্তার পানি বণ্টনের একটি চুক্তি নিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের সমঝোতা হয়েছিল। পরে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের আপত্তির কারণে তা আর আগে বাড়েনি। দুই দেশের পানি বণ্টনের মীমাংসা শুধু দ্বিপক্ষীয় বিষয় নয়, এক্ষেত্রে ভারতের রাজ্য সরকারের স্বার্থ এবং সম্মতির বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। এখানে ভারতের কেন্দ্রীয় রাজনীতির প্রভাব রয়েছে। তাই বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে থেকে রাজনৈতিক উচ্চপর্যায়ে আলোচনা ও সবপক্ষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত না হওয়ায় অভিন্ন নদীর পানিসংক্রান্ত ছোটখাটো বিষয়ে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নও দীর্ঘ সময় ঝুলে থাকতে দেখা যায়। তাই এ বিষয়ে সরকারকে আরো কৌশলী হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App