×

শিক্ষা

বিদ্যালয়েও করোনার হানা ৫ জেলায় শ্রেণিকক্ষে তালা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৮:৩৬ এএম

বিদ্যালয়েও করোনার হানা ৫ জেলায় শ্রেণিকক্ষে তালা

ফাইল ছবি

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হানা দিতে শুরু করেছে করোনা ভাইরাস। শ্রীমঙ্গলে শিক্ষকের পর গোপালগঞ্জে দুই শিক্ষার্থী আক্রান্ত হয়েছেন। ঠাকুরগাঁও এবং চাঁদপুরে ১৬ জন শিক্ষার্থী করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। নীলফামারীতে ৩ শিক্ষক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এরপরই ৫টি জেলার আক্রান্ত শিক্ষক-শিক্ষার্থীর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শ্রেণিকক্ষ বন্ধ করে দেয় স্থানীয় প্রশাসন।

তবে স্কুলে গিয়ে শিক্ষার্থীদের কোভিডে সংক্রমিত হওয়ার খবরের ‘কোনো সত্যতা নেই’ বলে দাবি করেছেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। মহামারিতে দেড় বছর বন্ধ থাকার পর গত ১২ সেপ্টেম্বর দেশের স্কুল-কলেজ খুলে দেয়া হয়েছে। এরপর গত দুই সপ্তাহে শ্রীমঙ্গল, চাঁদপুর, নীলফামারি, গোপালগঞ্জ ও ঠাকুরগাঁওয়ে কয়েকটি স্কুলের শিক্ষার্থীদের সংক্রমিত হওয়ার খবর আসে সংবাদমাধ্যমে।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে গতকাল শুক্রবার চট্টগ্রামে এক অনুষ্ঠানে নওফেল বলেন, করোনার সংক্রমণ এখন কমেছে অনেক। আমরা একটা গাইডলাইন দিয়ে দিয়েছি, একদিনের বেশি যাতে কেউ না আসে। করোনা সংক্রমণ তারা ঘরে থাকলে হতো না বা স্কুলে যাওয়ার কারণে হয়েছে- এটার কোনো সত্যতা এখন পর্যন্ত নেই। তারা স্কুলে না গেলেও অন্যান্য জায়গায়, আত্মীয় স্বজনের বাসায়, বিনোদনের জায়গায় সবখানে যাচ্ছিলেন। সুনির্দিষ্ট কিছু জায়গায় আমরা দেখেছি এটা হয়েছে। আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শিক্ষার্থীরা করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর প্রাথমিকভাবে নির্দিষ্ট শ্রেণিতে পাঠদান বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। আক্রান্ত শিশুর সহপাঠীদের রাখা হচ্ছে পর্যবেক্ষণে। নজরদারিতে থাকছে তাদের পরিবারের সদস্যরাও। দেড় বছর বন্ধ থাকার পর দেশের প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে সরাসরি ক্লাস শুরু হয়েছে ১২ সেপ্টেম্বর। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর বিভিন্ন স্থান থেকে আসছে শিক্ষার্থীদের করোনা আক্রান্ত হওয়ার খবর। সবমিলিয়ে মন্ত্রীর কথার সঙ্গে মাঠের চিত্রের বিস্তর ফারাক রয়েছে।

সবশেষ নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার চিড়াভিজা গোলনা দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের সুশান্ত কুমার রায়, রমিজুল ইসলাম ও আব্দুল জলিল তিনজন শিক্ষক করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এ ঘটনায় দুই দিন বিদ্যালয় বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। গত বৃহস্পতিবার রাতে ওই তিন শিক্ষকের শরীরে করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়। তারা নিজ নিজ বাড়িতে আইসোলেশনে আছেন। বিষয়টি নিশ্চিত করে

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আল হাসান জায়েদ বলেন, করোনা ভাইরাসের প্রাথমিক উপসর্গ দেখা দেয়ায় প্রথমে একজন শিক্ষক তার নমুনা পরীক্ষা করান। এতে তার করোনা পজিটিভ রিপোর্ট আসে। পরে আরো দুই শিক্ষকের করোনা শনাক্তের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর আজ শনিবার ও রবিবার এই দুই দিন স্কুল বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছি।

জলঢাকা উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকতা চঞ্চল কুমার ভৌমিক জানান, যেহেতু বিদ্যালয়টির তিনজন শিক্ষক করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত তাই বিদ্যালয়ের সব শিক্ষক-কর্মচারীর নমুনা পরীক্ষার জন্য সংরক্ষিত ছুটি থেকে দুই দিন স্কুল বন্ধ রাখা হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে আগামী সোমবার থেকে ক্লাস শুরু হবে। যদি আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যায় তাহলে উপজেলা করোনা প্রতিরোধ কমিটির সঙ্গে আলেচনা সাপেক্ষে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। এর আগে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঁচ শিশু শিক্ষার্থীর করোনা শনাক্ত হয়েছে। বুধবার করোনার আক্রান্তের বিষয়টি জানার পর বিদ্যালয়টির দুই শ্রেণিতে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। এছাড়া গোপালগঞ্জে ২১ সেপ্টেম্বর পঞ্চম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর করোনা শনাক্ত হওয়ার পর ওই শ্রেণিতে পাঠদান বন্ধ করে দেয়া হয়। ১৭ সেপ্টেম্বর একই জেলায় তৃতীয় শ্রেণির আরেক শিক্ষার্থীর করোনা শনাক্ত হয়। আর মানিকগঞ্জে করোনা উপসর্গে বুধবার মৃত্যু হয়েছে অষ্টম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর।

ঠাকুরগাঁওয়ে বুধবার করোনা শনাক্ত হওয়া পাঁচ শিশু উপজেলার জগন্নাথপুর ইউনিয়নের কলোনি এলাকার বাহাদুরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক ফারহানা পারভীন জানান, আক্রান্তদের মধ্যে দুজন চতুর্থ ও তিনজন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। তাদের বয়স ১০ থেকে ১২ বছরের মধ্যে। তারা সবাই ঠাকুরগাঁও সরকারি শিশু পরিবার সদস্য। তিনি আরো জানান, বিদ্যালয়টিতে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ৪২৬ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। তাদের মধ্যে চতুর্থ শ্রেণিতে ৮৪ ও পঞ্চম শ্রেণিতে রয়েছে ৭৬ জন। বুধবার তারা জানার পর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে ওই দুই শ্রেণিতে পাঠদান বন্ধ করা হয়েছে।

আক্রান্ত পাঁচ ছাত্রী গত ১৬ সেপ্টেম্বর ক্লাসে উপস্থিত ছিল। মঙ্গলবার সরকারি শিশু পরিবার বালিকা কর্তৃপক্ষ জানায়, তাদের স্কুলপড়ুয়া চতুর্থ শ্রেণির দুজন ও পঞ্চম শ্রেণির তিনজন ছাত্রী জ্বর-সর্দিতে আক্রান্ত হয়েছে। ওই দিনই পাঁচ শিশুর করোনা পরীক্ষার নমুনা দেয়া হয়। বুধবার আমরা জানতে পারি তারা করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানোর পর চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির পাঠদান বন্ধ করা হয়েছে। তবে প্রথম শ্রেণি থেকে তৃতীয় শ্রেণির পাঠদান চলছে বলে জানান তিনি।

ঠাকুরগাঁও সরকারি শিশু পরিবার বালিকার উপতত্ত্বাবধায়ক রিক্তা বানু জানান, তাদের প্রতিষ্ঠানের থাকা শহরের হাজীপাড়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের এক ছাত্রী ১৬ সেপ্টেম্বর জ্বর-সর্দিতে আক্রান্ত হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে অন্যদের পাশাপাশি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ওই ৫ ছাত্রী আক্রান্ত হয়।

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা শিক্ষা অফিসের সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা মমতাজ ফেরদৌস বলেন, বাহাদুরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫ ছাত্রী করোনায় আক্রান্ত হয়েছে বলে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। এরপর বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়। আগামী এক সপ্তাহের জন্য ওই বিদ্যালয়ের চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস বন্ধ করে রাখা হয়েছে। ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার রকিবুল আলম চয়ন বলেন, সরকারি শিশু পরিবারের শিশুদের আক্রান্তের দিন থেকেই শারীরিক অবস্থা পর্যক্ষেণ করা হচ্ছে। তারা বর্তমানে সুস্থ আছে।

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, উপজেলার প্রত্যেকটি বিদ্যালয়ে স্বাস্থ্য সুরক্ষা বজায় রেখে ক্লাস নেয়া হচ্ছে। আমরা সব বিদ্যালয় সার্বক্ষণিক তদারকি করছি। যদি কোনো শিক্ষার্থীর করোনার লক্ষণ দেখা যায়, তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে তার নমুনা পরীক্ষা করছি। যেসব শ্রেণির শিক্ষার্থীরা করোনায় আক্রান্ত হয়েছে তাৎক্ষণিক সেই শ্রেণির ক্লাস বন্ধ রাখা হয়েছে। আক্রান্তদের চিকিৎসাসেবাও দেয়া হচ্ছে।

গোপালগঞ্জ পৌরসভার ১০২ নম্বর বীণাপাণি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী মোনালিসা ইসলামের করোনা শনাক্ত হয় ২১ মঙ্গলবার। এরপর ওই শ্রেণির পাঠদান বন্ধ করে দেয়া হয়। তবে অন্য শ্রেণিতে পাঠদান চলছে। মোনালিসার মা মিতু খানম বলেন, এতদিন আমার মেয়ে সুস্থ ছিল। ১২ সেপ্টেম্বর থেকে সে স্কুলে যাওয়া শুরু করে। এরপর ১৪ সেপ্টেম্বর থেকে তার হালকা জ্বর, মাথাব্যথা। সে জন্য পরদিন তার স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিই। এক সপ্তাহেও মেয়ের জ্বর না কমায় ২১ সেপ্টেম্বর তার করোনা পরীক্ষা করাই। ওই দিনই পজিটিভ রেজাল্ট আসে। এর আগে ১৭ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার ৪ নম্বর ফেরধারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির এক ছাত্রীর করোনা শনাক্ত হওয়ায় ওই শ্রেণির পাঠদান ১৪ দিনের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়। ওই শিক্ষার্থী ও তার মা দুজনেরই করোনা শনাক্ত হওয়ার পর থেকে তাদের বাড়িতে রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।

মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ আব্দুল লতিফ জানান, মৃত্যু হওয়া শিক্ষার্থী রোদেলা করোনায় আক্রান্ত ছিল কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে এর আগে ওই বিদ্যালয়ের ১০ শ্রেণির এক শিক্ষার্থী করোনা পজিটিভ হওয়ায় ওই শ্রেণির পাঠদান বন্ধ রাখা হয়। এরপর ওই শ্রেণির ৫৮ শিক্ষার্থীর করোনা পরীক্ষায় সবার নেগেটিভ আসে।

চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার ড. মনসুরউদ্দীন মহিলা কলেজের তিন ছাত্রী করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। এ ঘটনার পর ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেন স্থানীয় শিক্ষা কর্মকর্তা। একইসঙ্গে কলেজের ছাত্রীনিবাস বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বর্তমানে আক্রান্তরা নিজ নিজ বাড়িতে কোয়ারেন্টাইনে আছেন।

এদিকে, করোনা মহামারির কারণে দীর্ঘ দেড় বছর বন্ধ থাকার পর গত ১২ সেপ্টেম্বর প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হয়েছে। স্কুলগুলো খুলে দেয়ার পর ঢাকাসহ দেশের বিভাগীয় শহরগুলোতে শ্রেণি কার্যক্রমে বেশ ভালো সংখ্যক শিক্ষার্থী উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তবে মফস্বল বা গ্রামে শিক্ষার্থী উপস্থিতি অপেক্ষাকৃত কম।

শহর লাগোয়া বেশ কয়েকটি গ্রাম ও মফস্বলের বিদ্যালয়গুলো ঘুরে দেখা গেছে, সেখানে শহরের তুলনায় অনেক কম শিক্ষার্থীর ক্লাসে ফিরেছে। আর বড় শহরের বড় প্রতিষ্ঠানগুলোতে উপস্থিতি নিয়ে কড়াকড়ির জন্যই উপস্থিতি বেশি বলে জানিয়েছেন তারা। তবে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা বলছেন ভিন্ন কথা। সারাবাংলার এই প্রতিবেদকের যেসব অভিভাবকের কথা হয়েছে তাদের প্রায় সবাই বলেছেন, মাহামারির সময়ে দীর্ঘ বন্ধ ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে গ্রামাঞ্চলের অনেক শিক্ষার্থীই ঝরে পড়ার দিকে। অনেকে আবার পড়াশোনা বাদ না দিলেও, কাজে যুক্ত হয়ে পড়েছে। তাই ক্লাসে ফিরতে পারছেন না।

তবে গ্রামে শিক্ষার্থী উপস্থিতি নিয়ে বোর্ডপ্রধানরা বেশ চিন্তিত। সিলেট বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. রমা বিজয় সরকার বলেন, গ্রামে বা মফস্বলে শিক্ষার্থী উপস্থিতি কমে গেছে সেই অভিযোগ আমরা পেয়েছি। এদের ফের শ্রেণি কার্যক্রমে ফেরাতে হবে। সুন্দর পরিকল্পনার মাধ্যমে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App