×

মুক্তচিন্তা

তালেবানি শাসনের স্পর্শে ব্রিটেন ও করোনা-উত্তর গণতন্ত্র

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০১:১৫ এএম

তালেবানদের মাধ্যমে কাবুল পতন হওয়ার মধ্য দিয়ে আফগানিস্তানের আর্থ-সামাজিক এবং ধর্ম-রাজনীতিতে কী পরিবর্তন আসছে, তা এখনো বলতে গেলে ধোঁয়াশাচ্ছন্ন। কিন্তু তবুও আপাতত সে দেশের মানুষগুলোকে মানিয়ে নিতে হবে, ধারণ করতে হবে তালেবানি ‘জামানা’কে। এবং এভাবেই ক্রমে মেনে নিচ্ছে হয়তো আফগানিস্তানের মানুষ। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ, অন্যদিকে সারা পৃথিবীর সঙ্গে তুলনা করলে এক ধরনের অন্ধকারে ডুব দেয়া নতুন তালেবানি সাম্রাজ্যে মানুষের মানিয়ে নেয়া ছাড়া এ মুহূর্তে কোনো উপায়ও নেই। তাইতো তালেবানদের পুরনো শত্রæদেরও ক্ষমা করার ঘোষণা এসেছে। ভয়ে-শঙ্কায় অনেকেই যোগ দিচ্ছেন তাদের সঙ্গে নতুন এই অন্ধকারের যাত্রায়। যুদ্ধজয় করে তালেবানদের আফগানিস্তানের দখল নেয়ার পর যেমন পশ্চিমারা পাততাড়ি গোটাল দেশটি থেকে, ঠিক তেমনি পশ্চিমা দেশগুলোতে এ নিয়ে রাজনীতিরও কিছুটা যে মেরুকরণ হয়নি, তা নয়। ব্রিটেনের বর্তমান মন্ত্রিপরিষদের সংস্কারে তার রেশও পরিলক্ষিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন গত সপ্তাহে তার মন্ত্রিপরিষদে নতুন মুখ নিয়ে আসায় আফগানিস্তান প্রসঙ্গটিও উঠে এসেছে। বিশেষত তার সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সামলানো মানুষটাকে মন্ত্রিপরিষদের বিচার বিভাগে প্রতিস্থাপন করায় উঠে এসেছে আফগানিস্তান প্রসঙ্গ। গত সময়ে অর্থাৎ সরকার পরিচালনাকালীন বিদেশমন্ত্রী ডমিনিক রেবের ব্যর্থতা খুব একটা ছিল না। কিন্তু কাবুল যেদিন তালবানদের দ্বারা পতন হয়, অর্থাৎ যেদিন আফগানিস্তান আবার কালো বোরকায় ঢাকা পড়ে, সেদিন ডমিনিক রেবেরও যেন কপাল পুড়ল। ডমিনিক রেব তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন বলেই এর আগে খবর বেরিয়েছিল। আফগানিস্তানের এ পতন দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির জন্য সংকটকাল বলাই যায়। আফগানিস্তানে তালেবানদের দমিয়ে রাখতে বিশ্বের মোড়ল রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ব্রিটেনও সরাসরি জড়িত ছিল। আর তাই তালেবানদের ক্ষমতা দখলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ব্রিটেনও খুইয়েছে অনেক কিছু। কিন্তু ডমিনিক রেব এ ব্যাপারটাকে খুব একটা গুরুত্ব দেননি বলেই মনে করছে দেশটির জনগণ। আফগানিস্তানের দখল নিল যেদিন তালেবান, সে সময় ডমিনিক হলিডে কাটাচ্ছিলেন। সাধারণত জাতীয় কোনো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হলে কিংবা আন্তর্জাতিকভাবে দেশটির স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট কিছু হলে এমনকি প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত ফিরে আসেন দেশে। কিন্তু তিনি হলিডে থেকে ফিরে আসেননি। বরং হলিডে থেকেই তিনি ফোন সংযোগ করেছেন, যা কোনোভাবেই একটা দেশের পররাষ্ট্রনীতির মাঝে পড়ে না। গণমাধ্যম থেকে শুরু করে সব জায়গায়ই এতে সমালোচিত হয়েছে সরকার। রেব ব্রিটেনে ফিরে এলেও আফগানিস্তানের পতনে বিঘœ ঘটত না যদিও; কিন্তু ব্রিটিশ সরকার সমালোচনার সম্মুখীন হতো না। তাই গত বুধবার মন্ত্রিপরিষদের সংস্কারে রেব তার গদি হারালেন। রিপোর্ট বেরিয়েছিল, এ নিয়ে ডমিনিক রেব ক্রুদ্ধ ছিলেন এবং প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাক্য বিনিময়ও হয়েছিল বলে খবর বেরিয়েছিল। কিন্তু ডাউনিং স্ট্রিট তা উড়িয়ে দিয়েছে এবং বলা হয়েছে রেব এখনো সরকারের ‘সিনিয়র রুলেই’ আছেন। তাকে উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদ দেয়া হয়েছে। ডাউনিং স্ট্রিট থেকে যা-ই বলা হোক না কেন, ছোট্ট একটা উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদ এবং পাশাপাশি বিচার বিভাগের দায়িত্ব যে তার পদাবনতি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিয়োগ দিয়েছেন লিজ টুসকে। লিজ টুসের পাশাপাশি তিনি নিয়োগ দিয়েছেন আরো কয়েকজন পেছনের সারির কনজারভেটিভ দলীয় এমপিকে, যাদের মাঝে নারীরা একটা উল্লেখযোগ্য স্থান পেয়েছেন। বরিস অনেক আগ থেকেই নারীদের দিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সমৃদ্ধ করতে চেয়েছিলেন আর এ হিসেবে তিনি গত বছরের জুলাই মাসে লন্ডন ইভনিং স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তার লক্ষ্য হলো, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারীকে তিনি নিয়োগ দিতে চান তার মন্ত্রিপরিষদে। এ ব্যাপারে বর্তমান প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বেন ওয়ালেস এলবিসি রেডিওতে এক সাক্ষাতে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী পেছনের সারির নতুন জেনারেশনকে সামনে আনতে প্রতিশ্রæতিবদ্ধ ছিলেন, আর তিনি সে লক্ষ্যেই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারীকে মন্ত্রিপরিষদে নিয়োগ দিয়েছেন। যদিও বিগত সময়ে সমালোচনায় এগিয়ে ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রীতি প্যাটেল। কিন্তু জায়গামতোই থাকলেন তিনি। অর্থমন্ত্রী রিষি সুনাকেরও কিছু হয়নি। রিষি সুনাক যদিও গত মহামারিকালে সরকারের হয়ে দেশটির সংকটকালে নাগরিকদের বিভিন্ন প্রণোদনা দিয়ে সুনামই কুড়িয়েছেন। তবে ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রীতি প্যাটেল ও রিষি সুনাক কিংবা পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত হেলথ সেক্রেটারি সাজিদ জাবিদের এই পদগুলোতে টিকে থাকা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে প্রভাবিত করতে পারবে বলে ধারণা করা যায়। মহামারিকালে ভ্যাকসিন মিনিস্টার নাদিম জাহাওয়ীর কার্যক্রম সরকারকে গতি দিয়েছে। নাগরিকদের দ্রুত ভ্যাকসিনেশনে ব্রিটেন অত্যন্ত সফল এবং এখন ১২ থেকে ১৭ বছরের স্কুল ছাত্রছাত্রীদের ভ্যাকসিন কার্যক্রম দ্রুততার সঙ্গেই পরিচালিত হচ্ছে। তুর্কি বংশোদ্ভূত এ মিনিস্টার পদোন্নতি পেয়ে এবার দায়িত্ব পেয়েছেন দেশটির শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। ব্রিটেনে ভ্যাকসিন কার্যক্রম দ্রুততার সঙ্গে পরিচালনার পাশাপাশি দেশটিতে গতি এসেছে। স্বাভাবিক হয়ে গেছে ব্রিটেন। ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রাণ এসেছে। চাঞ্চল্য এসেছে তারুণ্যে। রাতের পানশালাগুলোর পাশাপাশি ড্যান্স ক্লাবগুলোতে সেই আগের ভিড়। অর্থনীতিতে যেন পুনরুজ্জীবন হচ্ছে। এমনকি দেশটি ভ্রমণে উৎসাহিত করতে ইদানীং নতুন নতুন পরিকল্পনা ঘোষণা করা হয়েছে। মৃতপ্রায় ভ্রমণ ইন্ডাস্ট্রিকে দ্রুত যাতে আবারো ব্যবসায়ে নিয়ে আসা যায়, সেজন্য অনেক ছাড় দিতে হচ্ছে। ভ্রমণ ট্রাফিকে লাল তালিকায় থাকা ১২ দেশের নাগরিক যাতে ব্রিটেন ভ্রমণ করতে পারেন, সেজন্য শিথিল হয়ে গেছে সব কিছু। এ তালিকায় বাংলাদেশও আছে। যেহেতু বাংলাদেশ এ তালিকায় এসেছে, সেহেতু বাংলাদেশকেও ব্রিটেন প্রবাসী কিংবা ইউরোপিয়ান তথা প্রবাসীদের ব্যাপারে আরো সফট হওয়া প্রয়োজন। ব্রিটেনসহ যেসব দেশ বাংলাদেশকে কোয়ারেন্টাইনমুক্ত ভ্রমণের সুযোগ দিয়েছে, সেসব দেশে বিমানের আগের সিডিউলগুলো যত দ্রুত সম্ভব কার্যকর করা প্রয়োজন। ‘পজিটিভ না নেগেটিভ রিপোর্ট চান’- এ রকম কার্যক্রম যাতে না চলে, সেজন্য নজরদারি প্রয়োজন কোভিড টেস্ট সেন্টারগুলোতে। নতুন আরেক ‘সাহেদ উপাখ্যান’ যেন না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। গত প্যান্ডামিক পৃথিবীর প্রত্যেকটি দেশের সরকার ব্যবস্থাকে কোনো না কোনোভাবে নাড়া দিয়েছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রশ্নবোধক করেছে। মহামারিকালে দেশগুলোর দায়িত্বশীলদের সর্বোচ্চ আন্তরিকতাকে নাগরিক গুরুত্ব দিচ্ছে সব দেশেই। কিছু কিছু দেশের সাধারণ নাগরিক অর্থনৈতিক সুবিধা পেয়েছেন অঢেল। এর মাঝে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, নিউজিল্যান্ড প্রভৃতি দেশ উল্লেখযোগ্য। অনেক দেশই এই মহামারিকালে জনগণের সহায়তা করেছে ঠিকই, তবে দায়িত্ববান মানুষগুলোর অনৈতিক অর্থ উপার্জনেরও সুযোগ করে দিয়েছিল। বাংলাদেশেও এ রকম কথাবার্তা খোদ দু-একজন দায়িত্বশীলদের বিরুদ্ধে উঠেছিল। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর সরকারপ্রধানরা এ ব্যাপারগুলো হয়তো তাদের নজরদারিতে আনবে, যেমন ব্রিটেন নাগরিকদের সুযোগ-সুবিধা দেয়ার পরও খোদ প্রধানমন্ত্রীও সমালোচনার ঊর্ধ্বে উঠতে পারেননি। আর সেজন্যই মন্ত্রিপরিষদের সংস্কারে তা উঠে এসেছে। গণতান্ত্রিক দেশগুলোর রাজনৈতিক দলগুলো গত প্যান্ডামিকের সময়কালীন সরকারের সার্থকতা-ব্যর্থতাকে ইস্যু করে এমনকি ভোটের ফলাফল পর্যন্ত উল্টে দিতে পারে। যার কিছুটা রেষ পড়েছে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত নরওয়ের নির্বাচনে। এমনকি ব্রিটেনের আগামী নির্বাচনেও এর প্রভাব পড়তে পারে, সেজন্যই হয়তো বরিস জনসনের এই সংস্কার। সত্যি বলতে কি, ব্রিটেনের মন্ত্রিপরিষদের এই সংস্কার কনজারভেটিভ পার্টির জন্য একটা পজিটিভ দিকই বলতে হবে।

ফারুক যোশী : কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App