×

মুক্তচিন্তা

ছাত্ররাজনীতি গুরুত্বহীন কেন হয়ে গেছে?

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১২:৫৯ এএম

গত ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন কমিটির উদ্যোগে ‘শিক্ষা : ২০৪১ সালের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বাস্তবিক কৌশল’ শীর্ষক সেমিনারে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করেছেন, যা সচেতন সব মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ১৭ সেপ্টেম্বর এমনিতেই ১৯৬২ সালের শরীফ কমিশনবিরোধী শিক্ষা আন্দোলনের একটি রক্তমাখা দিন। ১৯৬২ সালের ওই দিনে শিক্ষা সংকোচন নীতি হিসেবে অভিহিত শরীফ কমিশনের রিপোর্ট কার্যকর করার জন্য সামরিক শাসক আইয়ুব খান বাস্তবায়ন শুরু করার উদ্যোগ নিলে ছাত্রসমাজ এর প্রতিবাদে আন্দোলন শুরু করে। ওইদিন বাবুল, মোস্তফা, ওয়াজিউল্লাহ নামক তিনজন ছাত্র পুলিশের গুলিতে নিহত হন। ছাত্রসমাজ এর প্রতিবাদে যে আন্দোলন শুরু করেছিল সেটি ’৬২-এর ছাত্র আন্দোলন নামে আমাদের জাতির ইতিহাসে পরিচিতি লাভ করেছে। সেই সময়ের ছাত্রলীগ এবং ছাত্র ইউনিয়ন এই আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল। সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা শরীফ কমিশন রিপোর্ট বাতিল এবং ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আন্দোলনের মুখে আইয়ুব সরকার শরীফ কমিশনের প্রতিবেদন বাস্তবায়ন স্থগিত ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। ওবায়দুল কাদের তার বক্তব্যে খেদোক্তি করে বলেছেন, ছাত্রনেতাদের যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, বাষট্টির ছাত্র আন্দোলন কবে হয়েছিল? কয়জন জবাব দিতে পারবে তা তিনি জানেন না। একই সঙ্গে তিনি আরো বলেছেন, ছাত্রনেতারা জাতীয় রাজনীতি নিয়েই বেশি মাথা ঘামান। ছাত্রদের সমস্যা, ক্যাম্পাসের সমস্যা নিয়ে খুব একটা কোনো ছাত্র সংগঠনকে কর্মসূচি দিতে দেখা যায় না। সবাই জাতীয় রাজনীতি নিয়ে কথা বলেন, আন্তর্জাতিক সমস্যা নিয়ে কথা বলেন। কিন্তু যে ক্যাম্পাসে তারা রাজনীতি করেন, সেই ক্যাম্পাসের সমস্যা, শিক্ষার সমস্যা, করণীয় সম্পর্কে কোনো ছাত্র সংগঠন সেমিনারেরও আয়োজন করে না। ঐতিহাসিক দিনগুলো পালন করার তাগিদ তারা মোটেও অনুভব করেন না। ওবায়দুল কাদের তার বক্তব্যে ‘ছাত্রনেতাদের’ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রাবাসে গণরুম বলে খ্যাত বিষয়ের অবতারণা করেছেন। এছাড়া প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টি, তদবির, সভা-মিছিল ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত থাকার ও নিজেদের প্রভাব বিস্তার করার কথাও তার বক্তব্যে রয়েছে। আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ তিনি ওইদিনের আলোচনায় উল্লেখ করেছেন, যাতে বাংলাদেশের রাজনীতির একটি বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে, যা মোটেও ছাত্ররাজনীতি বা জাতীয় রাজনীতির জন্য সুখকর নয়। তার এই আলোচনার সূত্র ধরেই ছাত্ররাজনীতির বিবর্ণ রূপ নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করার প্রয়োজন মনে করছি। অতীতে অবশ্য অনেক লেখায় আমি ছাত্ররাজনীতি প্রসঙ্গে নানা প্রশ্ন তুলেছি। এর থেকে বের হওয়া এবং ছাত্রসমাজকে ছাত্ররাজনীতির চাইতে লেখাপড়ায় উন্নত দুনিয়ার মতো গভীরভাবে মনোনিবেশ করার কথা বলার চেষ্টা করেছি। সেটি করা গেলেই দেশে মানবসম্পদের উন্নয়ন ঘটত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মানের সংকট কাটিয়ে ওঠতে অনেকটাই সক্ষম হতো। এমনকি দেশে দুয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক মানের গবেষণায় খ্যাতি অর্জন করতে পারত বলেও আমি বিশ্বাস করি। গোটা পৃথিবীর কোথাও এখন আর ছাত্ররাজনীতি বলে কোনো বিশেষ ধারণা নেই। আমাদের দেশেও এটি থাকার কোনো বাস্তবতা নেই। কিন্তু আমরা অনেকটাই যেন বুঝেই হোক আর না বুঝেই হোক শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র সংগঠনের উপস্থিতিকে বড় করে দেখার চেষ্টা করছি, রাজনৈতিক দলগুলোও ধরে রাখার চেষ্টা করছে। নিজেদের অঙ্গসংগঠন হিসেবে ছাত্র সংগঠনের স্বীকৃতি বড় করে দেখানো হচ্ছে। বলার চেষ্টা করা হচ্ছে যে, ছাত্ররাজনীতি করেই জাতীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করলে দলীয় রাজনীতি নাকি সমৃদ্ধি লাভ করে! জাতীয় রাজনীতিতে দল অঙ্গসংগঠনের ‘ছাত্রনেতাদের’ নিয়েই সমৃদ্ধ হয়। তাছাড়া নেতাদের অতীত ছাত্ররাজনীতির সংশ্লিষ্টতা জাতীয় দলের গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবি লাভে গুরুত্ব পেয়ে থাকে। ছাত্ররাজনীতিতে ব্যক্তি যদি লেখাপড়ায় অসফলও হয়, জাতীয় রাজনীতিতে তা তেমন কোনো গুরুত্ব পায় না। শুধু ছাত্র সংগঠনে যুক্ত থাকার স্বীকৃতিই যথেষ্ট। সে কারণেই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অনেক ছাত্রছাত্রীই ছাত্র সংগঠনের পদ-পদবি পাওয়ার জন্য এত মরিয়া হয়ে ওঠে। সেখানে কোনো একটি পদ-পদবি পেলে তার ভাগ্য অনেকটাই যেন খুলে যায়। সে বনে যায় ‘ছাত্রনেতা’ পরিচয়ে। অথচ সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা এসব নেতা নির্বাচনে কোনো ধারেকাছেও নেই, প্রয়োজনও পড়ে না। ছাত্র সংগঠনে কেউ যুক্ত হয়ে নিজের ছাত্রত্বের পরিচয়কে যথেষ্ট মনে করে না। সে চায় ‘ছাত্রনেতা’ পরিচয়ে পরিচিত হতে। সেটি সে নিজেও যেমন দিয়ে থাকে, অন্যেরাও তাই করে থাকে। সবাই এখানে ‘ছাত্রনেতা’ বনে যায়। সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন হলে তো কথাই নেই সবর্ত্রই তার বা তাদের নেতা নেতা ভাব নিয়ে চলার দৃশ্য দেখা যায়। তারা ছাত্রাবাস, বিভাগ, কলেজ প্রশাসন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনসহ সর্বত্র ঘুরে বেড়ায়। এখানে-সেখানে তদবির করা, প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টি করা, নানা ধরনের অবৈধ কাজকর্মে নিজেদের ক্ষমতার প্রয়োগ করা। এমনকি নানা ধরনের নির্মাণকাজে চাঁদা আদায় করে নেয়াও তাদের ভূমিকা মোটেও গোপন কিছু নয়। স্থানীয় কলেজগুলোতে সরকারদলীয় ছাত্রনেতাদের শ্রেণিপাঠে কেউ কোনোদিন দেখে না। তারা কলেজ অধ্যক্ষের কক্ষে চেয়ার হাঁকিয়ে বসে শিক্ষকদের খুব বেশি মর্যাদা দেয় বলে শুনিনি। পরীক্ষার সময় তাদের থাকে নানা ধরনের তদবির। পরীক্ষায় বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্তির ‘অধিকার’ যেন অনেকটাই পূর্বনির্ধারিত। কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকেই এদের মাধ্যমে পরীক্ষার বৈতরণী পার হওয়ার সুযোগ নিয়ে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অবশ্য পরীক্ষায় বিশেষ কোনো সুযোগ ‘ছাত্রনেতারা’ নিতে পারে না। তবে কলেজগুলোতে এটি একেবারেই অবধারিত হয়ে আছে। শুধু সরকারি ছাত্র সংগঠনই নয়, অন্য ছাত্র সংগঠনেরও নেতাকর্মীদের পড়াশোনার সঙ্গে তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। অনেক তথাকথিত ‘ছাত্রনেতা’ ছাত্রত্ব ছাড়াও ছাত্র সংগঠনের নেতার পরিচয়ে জীবনের একটি বড় অংশ কাটিয়ে দেয়। ঘর-সংসার, ছেলেমেয়ে তাদের অনেকটাই জানাজানি হওয়ার পরও তাদের ‘ছাত্রনেতার’ পরিচয় কিছুতেই ঘুচে না! সরকারি দলের ছাত্রনেতা হলে কলেজ পর্যায়েও বিত্তশালী হওয়া কোনো ব্যাপার নয়। বিত্ত হলেই রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারে সহজ হয়, পদ-পদবি বাগিয়ে নেয়ার জন্য। গোষ্ঠীতন্ত্র অনেকেই প্রতিষ্ঠা করে চলছে। সেই শক্তিকেই স্থানীয় রাজনীতি ও নির্বাচনে অপেক্ষাকৃত উপরের পদ-পদবি আদায় করে নেয়া যেন অনেকটাই সহজ হয়ে পড়ে। সে কারণেই আজকাল বড় রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের শিক্ষাগত সনদ যেন গুরুত্বহীন বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আবার অনেকের নামমাত্র সনদ আছে কিন্তু মঞ্চে দাঁড়িয়ে ৫ মিনিট মানুষকে আকৃষ্ট করার মতো গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দেয়ার দক্ষতা দেখাই যায় না। বলা চলে এখন দেশ, জাতি ও বিশ্ব বাস্তবতা সম্পর্কে নতুন চিন্তা করার মতো নেতাও অনেক দলে খুব বেশি দেখা যায় না। ‘ছাত্রনেতাদের’ বক্তব্যে শোনার মতো কিছু নেই। একসময় ‘ছাত্রনেতাদের’ বক্তৃতা শোনার জন্য কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা সভাস্থলে উপস্থিত না থেকেও করিডরে দাঁড়িয়ে একাগ্রচিত্তে শোনত। তাদের বক্তব্যে দেশ, জাতি এমনকি আন্তর্জাতিক রাজনীতির অনেক খবরাখবর জানা যেত। এখন সেই চিত্র আশা করা দুরূহ ব্যাপার। কারণ কী? উত্তর একটাই। তথাকথিত এসব ‘ছাত্রনেতা’ শ্রেণিপাঠেই বসে না, বই-পুস্তকও খুব একটা নাড়াচাড়া করে না, পত্রপত্রিকাও খুব একটা উল্টেপাল্টে দেখে না। চিৎকার-চেঁচামেচি করে বক্তৃতা দিতে পারলেই হাততালি পাওয়া যায়, সাঙ্গোপাঙ্গও যথেষ্ট জুটে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেশিরভাগ ‘ছাত্রনেতারই’ লেখাপড়ার সঙ্গে সম্পর্ক ক্ষীণতর পর্যায়ে চলে গেছে। এমনকি একসময় যারা বাম ছাত্ররাজনীতি করতেন তাদের পড়াশোনার পরিধিও অন্যদের চাইতে বেশি ছিল। তাদের আচার-আচরণও ছিল ভদ্র ও মার্জিত। কিন্তু এখন সেই বামও নেই, নেতাও নেই, আচার-আচরণও নেই। ওদের মধ্যেও তীব্রচিন্তা বাসা বেঁধেছে, অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক ছাত্র সংগঠনের নেতারা এককালে দেশের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় দাপিয়ে বেরিয়েছিল। এখন তারা আড়ালে-আবডালে চলে গেছে। কিন্তু চিন্তা-চেতনায় তারা আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞানের বিরোধী বিশ্বাসী শক্তি হিসেবে পরিচিত। ১৮ বছরের যে কোনো তরুণই স্বীয় বিবেচনায় যে কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য হতে পারেন। উন্নত দুনিয়ায় এটিই দেখা যায়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র সংগঠন সেসব দেশে আলাদা কোনো স্বত্বা নিয়ে সক্রিয় নয়। ছাত্রছাত্রীদের প্রধান কাজই হচ্ছে লেখাপড়া করা, উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণায় নিজেদের মেধা-মননে যোগ্য করে তোলা। সেখানে নিয়মিত পড়াশোনা ছাড়া কারোই সনদ পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। ‘ছাত্রনেতা’ বলেও কেউ নেই। মেধাবী শিক্ষার্থীর আলাদা পরিচয় বিভাগ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়ে। তবে সেটি শিক্ষা ও গবেষণায় বিশেষ কৃতিত্বের জন্য। এই কৃতী শিক্ষার্থীরাই দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষক, গবেষক হিসেবে বিনা তদবিরে নিয়োগ পায়, এরাই দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজেদের স্থান যোগ্যতা বলে লাভ করে। রাজনীতিতেও মেধাবীরাই সমাদৃত হয়। অতএব ‘ছাত্রনেতা’ বলে যাদের আমরা পরিচিত করছি তারা আসলে নেতৃত্ব দেয়ার কোনো গুণাবলি অর্জন করে না। কারণ নিরবচ্ছিন্ন পড়াশোনা থেকে তারা বিচ্ছিন্ন। এটি মেধার অপচয়, মানব সম্পদেরও অপচয়। কবে আমরা এই চরম সত্য উপলব্ধি করতে পারব?

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App