×

খেলা

ঘরোয়া ক্লাবগুলোর আয়ের উৎস কী

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১১:৪০ পিএম

ঘরোয়া ক্লাবগুলোর আয়ের উৎস কী

জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক স্ট্রাইকার শেখ মোহাম্মদ আসলাম

ঘরোয়া ক্লাবগুলোর আয়ের উৎস কী

দিনকে দিন জৌলুস হারাচ্ছে ঘরোয়া ফুটবল। যার প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশ ফুটবল দলের ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ে। বাংলাদেশ ফুটবল দলের সাফল্য বলতে ২০০৩ সালে সাফ ফুটবলের শিরোপা জয় উল্লেখ করার মতো। এরপর আজ অবধি দ্বিতীয়বার সাফের শিরোপা জিততে পারেনি লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা। সদ্য ঘোষিত ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ে জামাল ভূঁইয়াদের অবস্থান ১৮৯।

এক সময় নেপাল, মালদ্বীপকে বলে কইয়ে হারাতো লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা। এখন এই দুদেশই নয় উপমহাদেশের অন্য দলগুলোর সঙ্গেও জিততে কষ্ট হয় জামালদের। ২০১৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ফকিরাপুল এলাকায় ফকিরাপুল ইয়ংমেনস ক্লাবে প্রথম ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। একই দিন অভিযান চলে ঢাকা ওয়ান্ডার্স ক্লাব ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রে। উন্মোচিত হতে থাকে ঢাকার ক্লাবপাড়ার অন্ধকার জগতের ভয়ংকর নানা দিক। ওই বছরের ২০ সেপ্টেম্বর কলাবাগান ক্রীড়াচক্র ও ধানমন্ডি ক্লাব এবং ২২ সেপ্টেম্বর আরামবাগ ক্রীড়াসংঘ, দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাব, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব ও মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবেও ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান চলে। বেরিয়ে আসে খেলার নামে ক্লাবগুলোর অবৈধ কর্মকাণ্ডের অজানা অধ্যায়।

ক্যাসিনো কেলেঙ্কারি বদনাম গুছিয়ে ক্লাবগুলো সুনাম ফেরার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিদেশি ক্লাব ফুটবলে টাকার ছড়াছড়ি হলে এ দেশের ফুটবল ক্লাবগুলো অর্থনৈতিক সংকটে হিমশিম খাচ্ছে ভালো দল গড়তে। ঘরোয়া ফুটবলের হালচাল নিয়ে ভোরের কাগজের সঙ্গে কথা বলেছেন, জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার শেখ মোহাম্মদ আসলাম এবং দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাবের সভাপতি সৈয়দ রিয়াজুল করিম।

ইউরোপীয় ফুটবলে অর্থের ছড়াছড়ির মূল কারণ টিভি চ্যানেল স্বত্ব, ম্যাচ টিকেট বিক্রির আয়, স্পন্সরশিপ, জার্সি বিক্রির আয়, খেলোয়াড় কেনাবেচা ও টুর্নামেন্ট জয়। ইউরোপের প্রায় প্রতিটি ক্লাবই নিজ দেশীয় ও উপমহাদেশীয় মিলিয়ে একাধিক লিগে খেলে থাকে। এক মৌসুমে প্রতিটি ক্লাব হোম ও অ্যাওয়ে ভিত্তিতে মোট ৩৮টি করে ম্যাচ খেলে থাকে (অংশগ্রহণকারী দল ২০ হওয়ায়)। এর মধ্যে অর্ধেক ম্যাচ তারা খেলে নিজেদের মাঠে, বাকি অর্ধেক ম্যাচ খেলে প্রতিপক্ষের মাঠে। নিজেদের মাঠে অনুষ্ঠিত তথা হোম ম্যাচগুলোতে প্রতিটি ক্লাব নিজ ভক্ত-সমর্থকদের অকুণ্ঠ সমর্থন তো পায়ই, সেই সঙ্গে তারা লাভবান হয় অর্থনৈতিকভাবেও। কারণ গ্যালারিতে বসে তাদের খেলা দেখতে আসেন যে দর্শকেরা, তাদের টিকেটের পেছনে মোটা অঙ্ক খরচ করতে হয়, যার বেশির ভাগই জমা হয় ক্লাবের কোষাগারে। সাধারণত ব্যক্তিগত আয়োজন, স্টেডিয়াম ও মিউজিয়াম ট্যুর, এমনকি বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্যও বিভিন্ন প্যাকেজে স্টেডিয়াম ভাড়া দিয়ে থাকে ক্লাবগুলো।

ইউরোপিয়ান ফুটবল ক্লাবগুলো খুবই জনপ্রিয়, তাই তাদের প্রায় সবারই রয়েছে নিজস্ব দোকান ও অনলাইন শপ, যেখানে তারা বিক্রি করে থাকে নিজস্ব মার্চেন্ডাইজ, মেমোরাবিলিয়া ও স্যুভেনির। অনেক ভক্ত-সমর্থকই চান, নিজের পছন্দের ক্লাবের থিমওয়ালা স্নো গ্লোব, স্কার্ফ, স্টেশনারি বা অন্য যে কোনো শোপিস কিনে নিজের সংগ্রহে রেখে দিতে। আর তাদের এই চাহিদাই পরিণত হয়েছে ক্লাবগুলোর অন্যতম আয়ের উৎসে।

[caption id="attachment_308475" align="aligncenter" width="700"] দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাবের সভাপতি সৈয়দ রিয়াজুল করিম[/caption]

২০১৯-২০ মৌসুমে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ফুটবল ক্লাব যে হোম কিটটি পড়েছে, সেটির স্পনসর ছিল তিনটি পৃথক কোম্পানি: অ্যাডিডাস, শেভ্রোলে ও কোহলার। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড প্রতি মৌসুমে অ্যাডিডাসের কাছ থেকে ৭৫ মিলিয়ন পাউন্ড, শেভ্রোলের কাছ থেকে ৬৪ মিলিয়ন পাউন্ড এবং কোহলারের কাছ থেকে ১০ মিলিয়ন পাউন্ড পেয়ে থাকে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে টিভি সম্প্রচার স্বত্ব ইউরোপের ক্লাবগুলোর জন্য নিশ্চিত আয়ের উৎস হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সম্প্রচার স্বত্ব বিক্রি করার পর প্রাপ্ত অর্থ ইপিএল ভাগ করে দেয় লিগে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মধ্যে। তবে এক্ষেত্রে সব ক্লাব যে সমান অর্থ পায়, তা কিন্তু না। কোন ক্লাব কত ভিউয়ার টানল, সেই পরিসংখ্যানের ওপর ভিত্তি করে অর্থ ভাগাভাগি হয়। ভিউয়ার টানার বিষয়টি আবার দুটি জিনিসের ওপর নির্ভর করে, একটি ক্লাবের জনপ্রিয়তা কতটুকু এবং তাদের মাঠের পারফরম্যান্স কেমন।

কোনো লিগে কোনো দল কেমন খেলল ও কী ফল করল, তার ওপর ভিত্তি করেই নির্ধারিত হয় যে তারা ঠিক কী পরিমাণ প্রাইজমানি বা অর্থ পুরস্কার লাভ করবে।

এই ক্যাটাগরির শর্তাবলি খুবই সোজাসাপটা। যে ক্লাব মাঠে যত ভালো খেলবে এবং তার দরুণ যত বেশি লিগ বা টুর্নামেন্টে জয়লাভ করবে, তারা প্রাইজমানি হিসেবে তত বেশি অর্থ পাবে।

বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে খেলা ১৩ ক্লাবগুলোর আয়ের উৎস হচ্ছে পৃষ্ঠপোষকদের দেয়া অর্থ ও ডোনেশন এবং বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন থেকে প্রাপ্য অর্থ। আর্থিক সংকটে অনেক ক্লাব প্রিমিয়ার লিগ থেকে ছিটকে গিয়েছে। ঘরোয়া লিগে ক্লাবগুলোর পেশাদারত্ব এবং আয়ের উৎস সম্পর্কে ভোরের কাগজকে জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক স্ট্রাইকার শেখ মোহাম্মদ আসলাম বলেন, আমাদের ক্লাবগুলোর যে অবকাঠামো তাতে পেশাদারত্বে আনা অনেক কঠিন। পেশাদারত্ব বলতে সবার আগে যে কথাটি বুঝায় তা হচ্ছে হোম এন্ড অ্যাওয়ে খেলার সিস্টেম। আমাদের ক্লাবগুলোর যে অবকাঠামো তা রাতারাতি পরিবর্তন করা যাবে না। একটি বা দুইটি ক্লাব বাদে অন্যরা পেশাদারত্ব পালন করছে না। আবাহনী, বসুন্ধরা ক্লাবের নিজস্ব মাঠ আছে। অন্যদের তা নেই। এ কারণেই আমি মনে করি আমাদের এখনো পেশাদারত্বে যাওয়ার সময় আসেনি। আমাদের সামাজিক অবকাঠামো এখনো পেশাদারত্বে যাওয়ার মতো নয়। আবাহনী, বসুন্ধরা ও মোহমেডান কিছুটা হলেও পেশাদারত্বে ফেরার চেষ্টা করছে। পেশাদারত্ব থাকলে ব্রাদার্সের মতো ক্লাবের অবনমন হতো না। পেশাদারত্ব করার মতো কোয়ালিটি কর্মকর্তা আমাদের রয়েছি কিনা আমি সন্দিহান।

ক্লাবগুলোতে পেশাদারত্ব আনা সস্পর্কে শেখ মোহাম্মদ বলেন, আকাশ-কসুম চিন্তা করলে হবে না। পেশাদারত্ব আনতে হলে সবার আগে দরকার অর্থ। অর্থের জোগানটা কে দেবে। আমাদের এখানে খেলোয়াড় কেনাবেচা হয় না। স্পন্সরশিপ পেতে হিমশিম খেতে হয়। হোম এন্ড অ্যাওয়ে খেলার সিস্টেম নেই। খেলার একদিন দুইদিন আগে গিয়ে খেলার সিস্টিম এখনো গড়ে ওঠেনি।

আমাদের সময়ে প্রিমিয়ার ডিভিশন লিগ হতো। ১৮-১৯টা ক্লাব ছিল। সবাই সবার সঙ্গে খেলে ২-৩ মাসের মধ্যে লিগ শেষ হতো। এরপর আমরা জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে শেরা বাংলা, সোহওয়ার্দী কাপে খেলতাম। ওই সময় খেলোয়াড় কেনাবেচা হয়তো। আমাদের সময় সরকার থেকে ক্লাবগুলোকে হাউজি খেলার অনুমতি দেয়া হতো। এই হাউজির আয় থেকে ছোট ক্লাবগুলো আমাদের পেমেন্ট করত। ছোট ক্লাবগুলো বেচে থাকত ওই হাউজি আয়ে। বড় ক্লাবগুলো চলত ডোনারদের আয়ে। অনেক কর্মকর্তা স্ত্রীর গহনা বিক্রি করে খেলোয়াড়দের পেমেন্ট দিত। এখন এমন দরদি কর্মকর্তা নেই।

ঘরোয়া ফুটবলে জৌলুস ফিরিয়ে আনা সম্পর্কে ভোরের কাগজকে জাতীয় দলের সাবেক স্ট্রাইকার বলেন, ৬৪ জেলা থেকে ৮ ডিভিশনের ৮টি ক্লাব নিয়ে টুর্নামেন্ট আয়োজন করতে পারলে বাংলাদেশের ফুটবলে পেশাদারত্ব আনা যাবে। তখন হোম এন্ড অ্যাওয়ে ম্যাচ আয়োজন করতে কোনো অসুবিধে হবে না। ক্লাবে আর্থিক সহায়তা করতে এলাকার ধনাঢ্য ব্যক্তিরা এগিয়ে আসবে। ম্যাচ দেখতে মাঠে দর্শকদের উপচে পড়া ভিড় হবে। খেলোয়াড় কেনাবেচা হবে। ম্যাচ সম্প্রচার থেকে ক্লাবগুলো লভ্যাংশ পাবে। সমর্থকদের আনাগোনা বাড়বে।

ক্লাবের পেশাদারত্ব সম্পর্কে দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাবের সভাপতি সৈয়দ রিয়াজুল করিম ভোরের কাগজকে বলেন, ক্যাসিনো কেলেঙ্কারিতে আমাদের ক্লাবের যে সুনাম ক্ষুণ্ন হয়েছে তা ফিরিয়ে আনাই নতুন কমিটির প্রধান কাজ। আমরা খেলার মাঠে পারফরম্যান্স প্রদর্শনের মাধ্যমে হারানো সুনাম ফিরিয়ে আনব। হকি লিগের জন্য আমরা শক্তিশালী দল গড়েছি। ফুটবলে দিলকুশা প্রথম বিভাগে খেলে। এবার আমরা শক্তিশালী দল গড়ব। হ্যান্ডবলে শিরোপা জয়ে ভালো দল গড়ব। আমাদের প্রধান লক্ষ্য সুনাম পুনরুদ্ধার।

ক্লাবের আয়ের উৎস সম্পর্কে সভাপতি সৈয়দ রিয়াজুল করিম বলেন, আমাদের স্থাপনা রয়েছে। কিছু দোকান আছে। দোকান ভাড়া পাই। হকি টিম গড়তে আমরা প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে সহায়তা পেয়েছি। আমরা যারা কমিটিতে আছি তারাই ফুটবল টিম এবং হ্যান্ডবল টিম গড়তে পারব। আমরা ক্লাবের নামে কাউকে চাঁদাবাজি করতে দেব না। ক্লাবের আর্থিক অবস্থা শক্তিশালী করার পর আমরা ক্লাবের পেশাদারত্বের দিকে নজর দেব।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App