×

মুক্তচিন্তা

ইভ্যালি-পীরালি : ঠগের বাম্পার ফলন

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১২:৫৯ এএম

ইভ্যালি-পীরালি : ঠগের বাম্পার ফলন

ধর্ম, অর্থ, লোভ ইত্যাদির ক্যামিস্ট্রিতে আঙুল ফুলে গজানো কলাগাছের ছড়াছড়ি এখন কেবল গ্রামে নয়, শহরেও বেশুমার। ঠগবাজির এ জমজমাট বাণিজ্যের চলতি পথে ঘটনাচক্রে ছেদ পড়ছে মাঝেমধ্যে। ধরা পড়ছে দু-চারটা। দমে ক’দিন। আবার গজায়। আর্থ ফাউন্ডেশন, যুবক, ডেসটিনি থেকে আজকের ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, কিউকম, আলেশা মার্ট একই ধারার। ধরন বদল হয় মাত্র। পীর-মাশায়েখ লেবাসেও এ ধামাকা চলছে বেশ জুতসইভাবে। টুকটাক বাধা এলেও শেষতক সমস্যা হয় না। ল্যাঠা মিটে যায় কিছুদিনের মধ্যে। ঠগবাজির শিকাররা ভুলে যান। পরে জড়ান আরেক মোকামে। ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, এহসান, ডেসটিনি, যুবক, ইউনিপে, আলাদিনের প্রদীপ ছাড়াও আগে-পরে এ কাণ্ডের তালিকা বেশ দীর্ঘ। এই হায়-হায় কোম্পানি নিয়ে কোনো হাল শুমারি নেই। এর বিপরীতে এ ধরনের প্রতারকদের খপ্পরে পড়াদের জন্য মায়া লাগা ছাড়াও করণীয় কিছু থাকে না। তারা এক অর্থ নিজেদের লোভের দায় শোধ করছে। আর প্রতারক চক্র গ্রেপ্তারের জন্য তৈরিই থাকে। নিজেদের দেউলিয়া প্রমাণের যাবতীয় ব্যবস্থা তারা করেই রাখে। ব্যবসাটা চমৎকার। কয়েক দিন সামান্য হৈচৈ, শেষে গ্রেপ্তার। অঘটনের পর তাদের কাছে বারডেম বা বিএসএমএমইউ বেশ নিরাপদ-আরামদায়ক। পাশেই তো ইন্টারকন, ঢাকা ক্লাব। খাওয়া-দাওয়াসহ সেখানকার অনেক কিছুই হাসপাতালে পৌঁছে যায় তাদের কাছে। ইভ্যালির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রাসেলও তাই করেছেন। ই-অরেঞ্জের মালিক দম্পতি সোনিয়া মেহজাবিন ও তার স্বামী মাসুকুর রহমানও তাই করেছেন। গ্রাহকের টাকা ফিরিয়ে না দেয়ার যত পরিকল্পনা ছিল তার সবই তারা করে ধরা দিয়েছেন। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সামান্য কিছু টাকা রেখে বাকিটা উধাও করেছেন ধরা পড়ার আগে। প্রস্তুতি নিয়ে ধরা পড়তে অপেক্ষা করেছেন। কারণ গ্রেপ্তার এবং কারাবরণ তার জন্য লাভজনক। এসব কোম্পানির সম্পদের চেয়ে দেনার পরিমাণ অনেক বেশি করে রাখে। টাকা ফিরিয়ে দেয়ার ক্ষমতা নেই, তা প্রমাণের কিছু বাকি রাখে না তারা। যুবক, ডেসটিনি, আইসিএল, আর্থ ফাউন্ডেশনের কথা মনে রাখলে তা প্রতারিতদেরও জানার কথা। ইভ্যালি-আলেশা মার্টসহ ১০টি ই-কমার্সের সঙ্গে বাংলাদেশের কয়েকটি ব্যাংক ক্রেডিট, ডেবিট ও প্রি-পেইড কার্ডের লেনদেন বন্ধ রেখেছে, কয়েকদিন ধরে এ খবর প্রচারের পরই না কারো কারো একটু হুঁশ ফিরেছে। ততক্ষণে সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে গেছে। ডেসটিনি গ্রুপের ৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি অনিয়ম-দুর্নীতি ও প্রতারণার ফাঁদ ধরা পড়ার পর সরকার বিষয়টি প্রথম আমলে নেয় ২০১২ সালে। এ ঘটনায় দুদকের মামলা দায়েরের প্রায় ৯ বছর চলে যাচ্ছে। ২০১৩ সালের অক্টোবরে এমএলএম ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কার্যক্রম (নিয়ন্ত্রণ) আইন প্রণয়ন করা হয়। এতে বলা আছে, লাইসেন্স ছাড়া বহু ধাপ বিপণন কার্যক্রম চালানো যাবে না; যেসব প্রতিষ্ঠানের এ কার্যক্রম রয়েছে, আইনটি পাসের পর ৯০ দিনের মধ্যে তাদের লাইসেন্স নিতে হবে। এ আইন অনুযায়ী লাইসেন্স ছাড়া এমএলএম ব্যবসা করা যায় না। সরকারের অনুমোদন ছাড়া লাইসেন্স হস্তান্তর করতেও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞা ঠেলেও নতুন নতুন নামে এমএলএম ব্যবসা চলছে। তবে এমএলএম না বলে জাহির করা হয় ই-কমার্স নামে। তফাত এদ্দুরই। এতদিনেও ‘মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কার্যক্রম (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩’ কার্যকর না হওয়ার কারণ কেউ ঠিকমতো জানেন না। অথবা জানলেও বলেন না। এই ফাঁকে গজায় ইভ্যালিরা। ইভ্যালির পর ই-অরেঞ্জ, ধামাকা, বুমবুমসহ হিজিবিজি নানা নাম সামনে এসেছে। সর্বস্ব খুইয়ে ফাঁকা মাঠে হঠাৎ সাহসী হয়েছেন কেউ কেউ। মামলাও করেছেন। প্রতারকরা তো সেটাই চায়। নিরাপদে হেফাজতে চলে যেতে যায়। আইনের কার্যকারিতা না থাকায় অবৈধ মাল্টিলেভেল মার্কেটিং-এমএলএম ব্যবসা চলছে দেশে। এতে প্রতারিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। এর আগে ডেসটিনি, যুবকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো এ প্রতারণা করেছে। হাতিয়ে নিয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা। এমনকি অনুমোদনহীন ওষুধ বিক্রির অভিযোগ রয়েছে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। কারোই কোনো ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট হয়নি। এবাবে চলতে থাকলে ধর্মীয় ভণ্ডরা বসে থাকবে কেন? ধর্ম পুঁজি করে সুদবিহীন বিনিয়োগের নামে রাগীব আহসানরাও ঝোপ বুঝে প্রতারণার কোপ মারতে দেরি করেননি। দুই-চার কোটি নয়, গ্রাহকদের আমানতকৃত ১৭ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করতে একটুও ভাবেননি। বরং প্রস্তুতি নিয়েই করেছেন। পিরোজপুরের মাল্টিপারপাস কোম্পানি এহসান গ্রুপের এই এমডি রাগীব ও তার তিন ভাই আবুল বাশার, মাহমুদুল হাসান ও মো. খাইরুল ইসলাম মিলে যা করার করে নিয়েছেন। ১০ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় ঢাকার বাসা থেকে রাগীব ও তার ভাই বাশারকে আটক করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-র‌্যাব। রাগীবের অন্য দুই ভাই মাহমুদুল ও খাইরুলকে পিরোজপুরের খলিশাখালী নিজ বাড়ি থেকে ধরেছে পুলিশ। শিনা টান রেখেই তারা সব করেছেন। ধরাও দিয়েছেন টান-টান হয়ে। গ্রেপ্তার রাগীব ছিলেন একটি মসজিদের ইমাম। পরে ঢাকার একটি মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কোম্পানিতে কাজ নেন। সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নিজেই গড়ে তুলেন এহসান গ্রুপ নামে একটি এমএলএম কোম্পানি। সেখানে নিয়োগ দেন জেলাসহ জেলার পার্শ্ববর্তী বাগেরহাট, ঝালকাঠি, গোপালগঞ্জ, পটুয়াখালী, বরিশালসহ বিভিন্ন জেলার মসজিদের ইমাম, কওমি মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকসহ স্থানীয় বিভিন্ন প্রভাবশালীদের। তারা মাহফিলের মাধ্যমে ইসলামী শরিয়াহ মোতাবেক অধিক মুনাফা দেয়ার প্রলোভনে ভিন্ন স্টাইলে আমানত কালেকশন করেছেন। এ সংগৃহীত আমানত দিয়ে ২০০৮ সালে পিরোজপুর পৌরসভার খলিশাখালী এলাকায় এহসান রিয়েল এস্টেট এন্ড বিল্ডার্স প্রতিষ্ঠা করেন রাগীব। এরপর পৌর শহরের সিও অফিস মোড় সংলগ্ন এলাকায় জমি কিনে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয় স্থাপন করেন। যা ‘এহসান গ্রুপ’ নামে পরিচিতি। ওই এহসান গ্রুপ নামে মক্কা, মদিনা, বিসমিল্লাহ, আল্লাহর দানের মতো নাম দিয়ে খোলেন অন্তত ১৭টি প্রতিষ্ঠান। প্রায় ২২ হাজার কর্মীর মাধ্যমে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করেন। আর এসব আমানতের বিপরীতে দেয়া হয় প্রতি লাখে ২ হাজার টাকা করে ব্যবসায়িক লাভের প্রতিশ্রæতি। নামকরা পীর-মুর্শিদই বা বাদ থাকবেন কোন দুঃখে? এমএলএম বা ই-কমার্স নয়। তাদের স্টাইলে আরো রকমফের। হাইকোর্টকেও হতভম্ভ করেছেন ঢাকার এক পীর। ৪৯ মামলার চক্করে ফেলে ৫৫ বছর বয়সি এক মুরিদের নাকানিচুবানি দশায় হাইকোর্ট বলে বসেছেন, ‘বাংলাদেশে পীর সাহেবের কাণ্ড দেখেন। জায়গা-জমি দখলের জন্য পীর সাহেব কী করেছেন, দেখেন। সম্পত্তির জন্য তথাকথিত মুরিদ দিয়ে মামলা করেছেন। পীর সাহেবের কেরামতি দেখেন।’ একরামুল আহসান নামের ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন জেলায় করা মামলার নেপথ্যে এক পীর ও তার অনুসারীদের জড়িত থাকার তথ্য এসেছে সিআইডির ওই প্রতিবেদনে। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে শুনানির জন্য ওঠে। সেখানে হাইকোর্ট এ বক্তব্য দেন। ধর্ষণ, মারধর, চুরি, মানব পাচার- কোনো মামলাই বাদ যায়নি তার নামে। দেশের ১৩টি জেলায় করা ২০টি মামলার চক্করে রাজধানীর শান্তিবাগের বাসিন্দা একরামুল আহসানকে ১ হাজার ৪৬৫ দিন কারাভোগ করতে হয়। এ অবস্থায় জামিনে বের হয়ে ওইসব মামলা ‘মিথ্যা’ উল্লেখ করে মামলা দায়েরে সম্পৃক্ত বা বাদীকে খুঁজে বের করতে তদন্তের নির্দেশনা চেয়ে গত ৭ জুন হাইকোর্টে রিট করেন ৫৫ বছর বয়সি ব্যবসায়ী একরামুল। এর পরিপ্রেক্ষিতে গণমাধ্যমে আসে পীরালির এই তেলেসমাতি।

মোস্তাফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App