×

জাতীয়

বিদেশে চিকিৎসা প্রত্যাশী ও ফলোআপ রোগীরা বিপাকে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৮:৪০ এএম

বিদেশে চিকিৎসা প্রত্যাশী ও ফলোআপ রোগীরা বিপাকে

ফাইল ছবি

নিউরোলজিক্যাল জটিল সমস্যায় আক্রান্ত সাংবাদিক সুলেখা শুভ্রা (ছদ্মনাম)। ২০১৫ সাল থেকে চার মাস পর পর ভারতে গিয়ে চিকিৎসা নিতে হতো তাকে। কলকাতার নিউরো সায়েন্স হাসপাতাল এবং চেন্নাইয়ের শঙ্কর নেত্রালয়ে চিকিৎসা করান তিনি। করোনার কারণে আকাশ ও সড়ক পথে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ এবং ভিসা পাওয়ার সুবিধা বন্ধ থাকায় ব্যাহত হয়েছে তার চিকিৎসাসেবা।

শুভ্রা বলেন, আমি যখনই চিকিৎসা করাতে যাই তখনই চিকিৎসার সুবিধার্থে আমাকে বেশ কিছু পরীক্ষা করাতে হয়। যেগুলো দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ আছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়েছে ওষুধ পাচ্ছিলাম না। চিকিৎসা শেষে দেশে আসার সময় ৫/৬ মাসের ওষুধ সঙ্গে করে নিয়ে আসি। তাছাড়া পরিচিতজনদের দিয়েও অনেক সময় ওষুধ আনাই। কিন্তু করোনার সময় এই সুযোগ ছিল না। হোয়াটস অ্যাপে এবং মেইলে ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। চলতি বছরের মে মাসে চিকিৎসার জন্য ভারতে যাওয়ার কথা থাকলেও এখনো পর্যন্ত যাওয়া হয়ে ওঠেনি।

২০১৯ সালে কলকাতার রবীন্দ্রনাথ টেগোর ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ কার্ডিয়াক সায়েন্সেসে (আরটিআইআইসিএস) চিকিৎসা করিয়েছিলেন হৃদরোগের সমস্যায় আক্রান্ত অপর্ণা ঘোষ (৫৫)। ফলোআপ চিকিৎসার জন্য পরে যাওয়ার কথা থাকলেও এখনো তা সম্ভব হয়নি। অপর্ণা বলেন, ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে চিকিৎসা করাতে গিয়েছিলাম কলকাতায়। ডাক্তার ছয় মাস পর যাওয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু এখনো যাওয়া হয়নি। বাংলাদেশেও ডাক্তাররা তেমন বসছেন না। অনলাইনে রোগী দেখছেন। এভাবে ডাক্তার দেখিয়ে তৃপ্তি আসে না।

গত কয়েক বছর ধরে হাঁটুর সমস্যায় ভুগছেন পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী আলাউদ্দিন (৬২)। গত বছর এপ্রিলে ব্যাংককের একটি হাসপাতালে অপারেশন করানোর কথা ছিল। কিন্তু করোনার সংক্রমণ, লকডাউনের কারণে সেই অপারেশন করতে পারেননি। আলাউদ্দিন বলেন, দেশে অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি। কিন্তু শারীরিক অবস্থার খুব বেশি উন্নতি হয়নি। এ দেশের ডাক্তাররাও বলেছেন অপারেশনটা একটু জটিল। বাংলাদেশে করানোর সাহস পাচ্ছি না। তাই খরচ বেশি হলেও ব্যাংককে করানোর কথা ভেবেছিলাম। কিন্তু এখন তো সব আটকে গেছে। করোনা পরিস্থিতি তো এখন অনেকটা ভালো। যদি পরিস্থিতি আরো স্বাভাবিক হয় তাহলে ব্যাংককে যাব।

অনেক দিন ধরে ভারতের চেন্নাইয়ে ক্যান্সারের চিকিৎসা করাচ্ছেন ওয়ারির বাসিন্দা নাজমা বেগম (৬৭)। তিন মাস পরপর তার সেখানে যাওয়ার কথা থাকলেও গত বছরের ফেব্রুয়ারি পর আর যাওয়া হয়নি তার। নাজমা বেগমের ব্যবসায়ী ছেলে মুমিনুল ইসলাম বলেন, আম্মার শারীরিক অবস্থা খুব ভালো নয়। হোয়াটস অ্যাপে ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে। তবে সমস্যা হয়েছে দীর্ঘদিন বিভিন্ন টেস্টগুলো বন্ধ আছে। ওষুধ পেতেও বেগ পেতে হয়েছে। আম্মা করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। তখন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। সেখানকার ডাক্তার কিছু ওষুধও দিয়েছেন। কিন্তু ভরসা পাচ্ছি না। ভারতেও করোনা পরিস্থিতি ভালো নয়। করোনা পরিস্থিতি আরেকটু স্বাভাবিক হলে আম্মাকে আবার চেন্নাইয়ে নিয়ে যাব।

সুলেখা শুভ্রা, অপর্ণা ঘোষ, আলাউদ্দিন কিংবা নাজমা বেগমের মতো এমন ভোগান্তিতে পড়েছেন বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষ। যারা উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারত, ব্যাংকক বা সিঙ্গাপুরে যাতায়াত করেন।

ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট, মেডিকেল/বিজনেস ভিসা প্রক্রিয়াকরণ, ফ্লাইট/টিকিট/হোটেল বুকিং সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, করোনার প্রভাবে তাদের ব্যবসায় পুরোপুরি ধস নেমেছে। তারা জানান, স্বাভাবিক সময়ে প্রতিবছর প্রায় ১২ লাখ বাংলাদেশি ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় চিকিৎসার জন্য যান। বাংলাদেশ থেকে বিদেশে যাওয়া রোগীদের অধিকাংশই চিকিৎসা নিতে যান ভারতে। হৃদরোগ, ক্যান্সার, কিডনি ও চোখের সমস্যা নিয়ে সবচেয়ে বেশি রোগী যায় ভারতে। এক্ষেত্রে ক্যান্সারের জন্য দিল্লি, চেন্নাই, চোখের জন্য চেন্নাই ও কলকাতাকে বেছে নেন তারা। অপেক্ষাকৃত ধনী ব্যক্তিরা বেছে নেন থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরকে।

করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালের ১২ মার্চ সব দেশের নাগরিকদের ভিসা দেয়া স্থগিত ঘোষণা করে ভারত। এই সিদ্ধান্তে বিড়ম্বনা ও দুর্ভোগের মুখে পড়েন ভারতের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভিসা গ্রহণকারী বাংলাদেশিরা। ওই বছরই ৯ অক্টোবর ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের এক বিবৃতিতে জানানো হয়, পর্যটন ছাড়া চিকিৎসা, ব্যবসায়, চাকরি, এন্ট্রি, সাংবাদিক, কূটনীতিক, কর্মকর্তা, জাতিসংঘের কর্মকর্তা এবং জাতিসংঘের কূটনীতিকরা ভিসার জন্য অনলাইনে আবেদন করতে পারবেন।

জানা যায়, ঢাকায় ভারতীয় হাই কমিশন ‘জরুরি বিবেচনায়’ কিছু ভিসা ইস্যু করলেও লকডাউন পরিস্থিতিতে যাতায়াতের বিষয় নিয়ে রোগী ও তাদের স্বজনদের দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে। এর বাইরে যাদের আগে মেডিকেল ভিসা নেয়া ছিল এবং মেয়াদও ছিল, তাদের ইমেইলের মাধ্যমে ভারতে যাওয়ার বিশেষ অনুমতি নিতে হয়েছে। চলতি বছর করোনার প্রকোপ বাড়ায় ২৬ এপ্রিল থেকে বাংলাদেশিদের ভারতে যাওয়া আবারো বন্ধ করে দেয়া হয়। পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসায় জুনের শেষের দিকে কিছু শর্তসাপেক্ষে ভারতে যাওয়ার অনুমতি দেয় দেশটির সরকার।

আস্থা মেডিকেল ট্যুরিজমের স্বত্বাধিকারী কাওসারুল হক খান ভোরের কাগজকে বলেন, ভারত ও বাংলাদেশে লকডাউন শুরু হওয়ার পর চিকিৎসা প্রত্যাশী সবাই সংকটের মধ্যে পড়েছেন। করোনা সংক্রমণ কমে এলেও এখনো মানুষ বিদেশে চিকিৎসা করাতে যাচ্ছে না। কারণ ভারতের অবস্থাও এখন ভালো নয়। সীমান্ত বন্ধ থাকা, ভিসা, পাসপোর্ট পাওয়ার জটিলতায়ও অনেকে যেতে পারেননি। করোনার কারণে চিকিৎসা প্রত্যাশীদের বিদেশ যাওয়া ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ কমেছে। সংক্রমণ পরিস্থিতি আরেকটু স্বাভাবিক হলে এই অবস্থারও উত্তরণ হবে।

আলম মেডিকেল ট্যুরিজমের অফিস কর্মকর্তা তৌহিদুল ইসলামও ভোরের কাগজকে এমন কথা জানান। তিনি বলেন, আমাদের মাধ্যমে প্রতিবছর যদি ৮’শ থেকে এক হাজার জন চিকিৎসার জন্য বিদেশ যেতেন। লকডাউন শুরু হওয়ার পর সেটি একেবারেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ক্যান্সার, হৃদরোগের মতো গুরুতর অসুস্থ ব্যক্তিদের জন্য তারা টেলিমেডিসিনের ব্যবস্থা করেছেন। পরবর্তীতে অবস্থার যখন কিছুটা উন্নতি হলো তখন এই সংখ্যা ২ থেকে ৩’শ জনে এসে ঠেকে। তাও খুবই জটিল অবস্থা যাদের তারা যাচ্ছেন। তবে আশা করা হচ্ছে ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নতি হবে।

ইন্ডিয়া মেডিকেল ট্যুরিজম, খন্দকার মেডিকেল ট্যুরিজমের পক্ষ থেকেও জানানো হয় একই বক্তব্য। এই দুই প্রতিষ্ঠান থেকে বলা হয়, করোনা সংক্রমণ শুরুর আগে তাদের অনেক রোগীর চিকিৎসার ফলোআপে যাবার কথা ছিল। অনেকের আবার নানা অপারেশনের জন্য হাসপাতালের অ্যাপয়ন্টমেন্ট নেয়া ছিল। কিন্তু লকডাউনের কারণে অনেকেই আটকে পড়েছিলেন। তখন তাদের খরচ বেড়ে গিয়েছিল। ফলে এই ভয়ে অনেকেই যেতে চাননি। এখন এই সংকট কাটতে শুরু করেছে।

চলতি বছরের ৭ জুন জাতীয় সংসদ অধিবেশনের প্রশ্নোত্তর পর্বে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, করোনার কারণে কেউ চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যেতে পারছে না। তারা এই দেশেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। দেশে সেই সক্ষমতা তৈরি হয়েছে।

উন্নত চিকিৎসার জন্য রোগীদের যাতে বিদেশে যেতে না হয়, সেজন্য হাসপাতালের সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা হবে বলে সম্প্রতি জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, রোগীরা যাতে এখানেই উন্নত চিকিৎসাসেবা পান এবং তাদের যেন বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নিতে না হয়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীরও প্রত্যাশা, এ বিশ্ববিদ্যালয়েই রোগীরা যাতে সর্বোত্তম ও সর্বাধুনিক চিকিৎসাসেবা পান, তা নিশ্চিত করে চিকিৎসার জন্য রোগীদের বিদেশে যাওয়া থেকে বিরত রাখা। সে লক্ষ্যেই কাজ করছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App