×

মুক্তচিন্তা

চাকর-বাকর ‘বাখরখানি’

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০২:০৬ এএম

চাকর-বাকর ‘বাখরখানি’
বিংশ শতাব্দীর আশির দশক। ইউরোপে কী এক বামপন্থি অনুষ্ঠানে দেখা হলো ফিনল্যান্ড কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান একজন প্রবীণার সঙ্গে। আমার দেশ বাংলাদেশ জেনে বললেন, তোমাদের দেশের কী নাম যেন, বিখ্যাত একজন কমিউনিস্ট, ‘ডক্টর জাফরল্লা’, তাকে আমরা আর্থিক সহায়তা করি। কী আর বলব! তখন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি এবং মণি সিংহ-ফরহাদ ছিলেন সবচেয়ে সুখ্যাত কমিউনিস্ট আন্দোলন প্রতিনিধি। ‘জাফরল্লা’ ভাই বঙ্গবন্ধুর সুবাদে সাভারে বিশাল জমি এবং বৈদেশিক সংযোগে বিপুল অর্থায়নে গণস্বাস্থ্যের ‘হুজরাখানা’ তৈরি করে চমকপ্রদ বাক্যবুলির আসর জমিয়েছেন। ‘জাফরল্লা’ ভাইয়ের ‘ঔষধনীতি’ নিয়ে প্রশংসা আছে। তিনি আশির দশকে সামরিক শাহীর প্রধান কর্তার সঙ্গে ‘ভাও’ দিয়ে সেই ঔষধনীতি চালু করাতে সক্ষম হয়েছিলেন। স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলনের সপক্ষ মানুষরা ডক্টর সাহেবের এহেন ‘নীতিহীন’ পদ্ধতির তীব্র বিরোধী ছিলেন। শোনা যায় ডক্টর চৌধুরী ওই জেনারেলকে নোবেল কিংবা নিদেনপক্ষে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পদক প্রলোভনে ঔষধনীতি গেলাতে চেয়েছিলেন। সময়ের বায়োস্কোপ বাক্সে ‘তারপরেতে কতো কী দেখা গেলো’। সেই জেনারেল পড়ে গেল। ‘গণস্বাস্থ্য’ ভবনে হামলা হলো। ততদিনে সারা বাংলায় ‘গণস্বাস্থ্য’ওয়ালাদের জমি আর জমি কেনার ধুম পড়ে গেল। জাফরুল্লাহ চৌধুরী সাহেবের গভীরে একজন ‘জমিদার’ বাস করেন বলে জানা গেল। একসময় তিনি আরেক জেনারেলের রাজনৈতিক দলে ঢলে পড়লেন। এখন তো তিনি সে দলের মহান ‘বিবেক-উপদেশক’-এর ভূমিকায়। জনগণের ‘রাজনৈতিক স্বাস্থ্য উন্নয়নের’ অদম্য তৎপরতায় তিনি এখন নিয়োজিত। তিনি এখন ‘কী করিয়া বিএনপি মোটাতাজা হইবে’ সে বিষয়ে নিত্য পরম পরামর্শ ঢেলেই যাচ্ছেন। হাসিনা সরকারকে ‘কী করিয়া উৎখাত করিতে হইবে’, সেটা নিয়ে তিনি তারেক-ওষুধকে ‘মেয়াদোত্তীর্ণ-অকেজো’ ঘোষণা করে তারেক কন্যা নব-ব্যারিস্টার ‘জাইমা রহমান’-ওষুধের ব্যবস্থাপত্র দিয়েছেন। সেটা নিয়ে ওই দলের বড় বড় চাঁইয়েরা মনে মনে খুশি হলেও তারেক বাহিনী প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ ও ক্ষিপ্ত। মনে মনে যা-ই ভাবুন না কেন, প্রকাশ্যে সবাই তারেক-হুজুরের একান্ত অনুগত। ‘জাফরল্লা’ চৌধুরীর ওপর তারেক-অনুগত বাহিনী ক-দিন আগে ‘হামলা-হল্লা’ চালাল। তবুও চির অদম্য চৌধুরীর কোনো ব্রেক নেই। তিনি তারেক পার্টির মহাসচিব ও বড় বড় নেতাদের ‘জি হুজুর’ বাহিনী বলে আখ্যা দিলেন। মহাসচিব বললেন, চৌধুরী সাহেব জ্ঞানী-গুণী-সম্মানিত হলেও ওনার বয়েস হয়ে গেছে। কথার তাল-মাত্রা-লয় জ্ঞান নেই। চৌধুরী সাহেব একসময় ওদেরকে ‘চাকর-বাকর’ বলে পাল্টা গোলা ছুড়লেন। বিপরীতে ডক্টর সাহেবকে ‘মাফ’ চাইতে বলা হলো। তিনি বাঁকা কণ্ঠে গর্জে উঠলেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি চাকর-বাকরদের কাছে মাফ চাইছি। অতঃপর কী আর করি, ডিকশনারির শরণাপন্ন হলাম। চাকর-বাকর-বাখরখানির উৎপত্তি-ব্যুৎপত্তি নিয়ে মুখ্খু নগণ্য হিসেবে লেগে পড়লাম। না, তেমন কিছু পেলাম না। দাস-দাসী-পরিচারক-পরিচারিকা ইত্যাদি। তবে চা সেক্টর থেকে যে কর উঠে সেটাকে চা-কর বলা হয় সেটা নতুন জানলাম। আর ছোট্টবেলা থেকেই মনে হতো, যেই ব্যাটাকে হুকুম দিয়ে বলা যায়, এই তাড়াতাড়ি চা কর, সেই বুঝি চাকর। আরেকটা মনে হতো পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্বল ‘কুইন’ কে? উত্তর হলো ‘চাকরানি’। এজন্যই ‘ণ’ হয়ে গেছে ‘ন’। তা এবার দেখুন, লন্ডন থেকে হাঁক উঠল, এ-ই চা কর। অমনি এদেশে চা বানাতে লেগে গেল যারা তাদের এক হারা-দোহারা-তেহারা-চেহারা আমাদের জানা আছে। ফিনল্যান্ডের কমিউনিস্ট প্রবীণা কথিত বাংলাদেশের বিখ্যাত ‘কমিউনিস্ট’ তার গণস্বাস্থ্য হুজরাখানায় যে নিম্নপদস্থ নারী-পুরুষ কর্মচারীদের কী জঘন্য ভাষায় গালমন্দ করে ‘সাম্যময়’ পৃথিবীর জন্য জান পাত করে দিয়ে থাকেন, সেসব কথা ওই বায়োস্কোপের বাক্সে নতুন নতুন সøাইড করে দেখানো যেতে পারে বৈকি! সেই বায়োস্কোপ বাক্স প্রদর্শনীর নাম দেয়া যেতে পারে, ‘চাকর বাকর বাখরখানি’। জমিদার চৌধুরী ‘কমিউনিস্ট’ ভাব ধরে ‘চাকর-বাকরদের’ নিয়ত ‘তুই তোকারি ঘেন্না’ করে নিজের যে ভাবমূর্তি ‘গণস্বাস্থ্য দহলিজে’ গড়ে তুলেছেন, সেটা অমোচনীয়। ১৯৭১ সালে লন্ডন থেকে আগরতলার বিশ্রামগঞ্জে অবিশ্রান্ত উদ্যমে তিনি একটি হাসপাতাল গড়ে তুলে আহত, রোগাক্রান্ত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা প্রদান করে প্রশংসা অর্জন করেন। ফলত স্বাধীনতার পর ওই ‘গণস্বাস্থ্য’ প্রকল্প। বিকল্প চিকিৎসার বৈশ্বিক আন্দোলনের অন্যতম মুখ হিসেবে নিজেকে ফুটিয়ে তোলেন। এভারেস্টে উঠে তিনি এদেশের এক নম্বর স্বাস্থ্য-হুজুর হওয়ার বাসনায় জেনারেলদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলেন দেশের চিকিৎসক সমাজের সঙ্গে চ্যালেঞ্জ দিয়ে। চৌধুরী সাহেব অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেননি বটে, তবুও দেশের একজন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা এবং নারী মুক্তি আন্দোলনের জবরজং ব্যক্তিত্ব হিসেবেই পরিচিত হয়ে ওঠেন। এখন পৃথিবীতে কাঁপাচ্ছে তালেবান আফগান। গোপনে মার্কিনিদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করে মার্কিনিদের ২০ বছরের দখলদারি অবসানের প্রকল্প বাস্তবায়নে তালেবানওয়ালারা বিশেষ সহযোগিতামূলক চুক্তি করেন ২০২০ সালে ট্রাম্প আমলেই। বুড়ো বাঘ আমেরিকা আর পারছিল না। সমঝোতার শেষ সময়ে ওই বাঘকে বেকায়দায় ফেলার জন্য তালেবানের হাক্কানী গ্রুপ গতির চাতুরী প্রয়োগ করল। ফলে নাক কাটা গেল মার্কিনি সুপার পাওয়ারের। এরপর পাকিস্তানের ইমরান খান বলে উঠল, তালেবানরা ‘দাসত্বের শৃঙ্খল’ ভেঙে আফগানিস্তানকে স্বাধীন করেছে। আর আমাদের চৌধুরী একই সুরে বলে উঠলেন, তালেবানরা ‘মুক্তিযোদ্ধা’। তা ইমরান মিয়া যে নিজেই নিজের দেশের সেনা কর্তাদের চিরস্থায়ী দাস-গোলাম হয়ে পুতুল সোনামণির মতো ভং ধরে আছেন, পৃথিবী তা জানে। এবার চৌধুরী সাহেবকে গণস্বাস্থ্যের সব দলিলপত্র হাজির করতে আহ্বান জানাই। সেখানে নারীমুক্তির পক্ষে গত পঞ্চাশ বছর ধরে কত শত শব্দ-বাক্য-অনুচ্ছেদ গড়েছেন তারা। গণস্বাস্থ্যের গাড়ি চালায় নারী। বলা যায় গরিব নারীদের শ্রমে গড়ে উঠেছে গণস্বাস্থ্যের ভিত। তালেবানরা দুর্র্ধর্ষ সাহসের পরিচায়ক বটে। আফগান ভূমির প্রায় সবটুকু তারা মুক্ত করেছে। কিন্তু দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙে তারা বন্দিত্বের পিঞ্জর বেঁধেছে বিশেষত নারী সমাজকে। চৌধুরী সাহেব, আপনার গণস্বাস্থ্য এবং সংশ্লিষ্ট নারী সংগঠনের সদস্যদের একটা অধিবেশন ডেকে তালেবান ‘মুক্তিযোদ্ধাদের’ মতো ফরমান দেন, অতঃপর নারীরা গণস্বাস্থ্য ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান ছাড়ো, ঘরে বসে থাকো, আপাদমস্তক বোরকা পরো, যেন পুরুষরা তোমাদের দেখে ‘অস্বাভাবিক’ না হতে পারে। যদি আপনার প্রতিষ্ঠানগুলোর নারীরা আপনার প্রস্তাবকে সমর্থন করে, তবে সমস্বরে তালেবানদের ‘মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে অভিহিত করার আপনার প্রদর্শিত ‘মূর্খতা’ই বিজয়ের পতাকা তুলবে। জানি না এদেশের চৌকস যে নারী মুক্তি সংগ্রামীর সঙ্গে আপনি ঘর বেঁধেছেন তিনি এ প্রশ্নে কী ভাবছেন! আপনার ‘চাকর বাকর বাখরখানি’রাই বা কী ভাবছেন! শেষ কথা : দেশ বাঁচাতে হে উপদেশক ডক্টর আপনি যে ‘জায়মা’ বিকল্প দিয়েছেন, সেই তিনি কি তালেবানি ফরমানের আপাদমস্তক বোরকা পরতে রাজি আছেন? হিলাল ফয়েজী : মুক্তিযোদ্ধা ও রম্যলেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App