×

মুক্তচিন্তা

ধর্ম এখন বর্ম

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৬:২৩ এএম

ধর্ম এখন বর্ম
সম্প্রতি এহসান গ্রুপের মালিককে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা গ্রেপ্তার করেছে। এহসান গ্রুপ সম্পূর্ণ ইসলামিক শরিয়াভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান। ধর্মীয় শরিয়ার বিষয়টি মূল আদর্শিক ভাবনা হিসেবে এহসান গ্রুপ তার কার্যক্রম শুরু করে। প্রতিষ্ঠানটির মালিক ও কর্মরত কর্মীদের পোশাকেও ছিল ধর্মীয় লেবাস। ধর্মীয় পোশাক ও শরিয়াভিত্তিক প্রতিষ্ঠান হওয়ায় সহজেই মানুষ এহসান গ্রুপের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। এ রকম শরিয়াভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্ণধারদের ধর্মীয় পোশাক দেখে সাধারণত অনেকেই প্রশ্ন করতে যায় না এর কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে? আবার দেখা যায় শরিয়াভিত্তিক তাদের আর্থিক কার্যক্রমগুলোর বিচ্যুতি নিয়ে কোনো প্রশ্ন করলে প্রশ্নকারীকে নাস্তিক বা ধর্ম অবমাননাকারী হিসেবে তারা আখ্যা দেন। তাছাড়া শরিয়ার অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ত্রæটিগুলো নিয়ে আলোচনা করলে সমাজেও কেউ কেউ বলে থাকেন, এ রকম আলোচনায় নাকি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে। তাই দেখা যাচ্ছে যে, এভাবে ধর্মকে বর্ম হিসেবে ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে শরিয়াভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলো গায়েব হয়ে যায়। আইটিসিএল নামে একটি প্রতিষ্ঠান আজ থেকে তিন যুগ আগে কয়েক হাজার কোটি টাকা জনগণের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়। আইটিসিএলের পূর্ণ নাম ইসলামিক ট্রেড এন্ড কমার্স লিমিটেড। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ধর্মভীরু। পরকালের মঙ্গলার্থে সাধারণ মানুষ ধর্মীয় অনুশাসনগুলোকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করে। আর এই বিশ্বাসের ভিতের ওপর ভিত্তি করে লুটপাটের আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে আর নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে তারা কেটে পড়ে। বর্তমানে বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের ধর্মীয় মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তিটাও গড়ে তোলা হচ্ছে অন্ধভাবে। ধর্ম সম্পর্কে নেতিবাচক প্রশ্ন করলে তাকে নাস্তিক বানানো হয়। আর আইনিভাবে শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। আর এই প্রক্রিয়ায় প্রশাসনও সহায়তা করে। তাই ধর্মীয় বিশ্বাসের বিষয়গুলো সাধারণ মানুষ বিশ্লেষণ না করেই ধর্মীয় যাজকদের বা ধর্মীয় পোশাকীয় লেবাসধারীদের কথা শুনে মেনে নেয়। এর মূল কারণ ঘাঁটলে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের নৈতিক শিক্ষাটা প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত ধর্মীয় পাঠ্যসূচি অনুসারে প্রদান করা হয়। তাই দেখা যায়, পড়–য়াদের মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টি না করে তাদের বানানো হয় ধর্মীয় অ্যাক্টিভিস্ট। ফলে নিজ নিজ ধর্মীয় বলয়কে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে এই পড়–য়ারা কাজ করে। তাই মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে নানা অপকর্ম করতে পারছে ধর্মীয় লেবাস সাঁটানো প্রতিষ্ঠানগুলো। দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক সংগঠনগুলো ধর্মীয় প্রভাবে প্রভাবিত। এই সংগঠনগুলোও মনে করে ধর্মীয় আদর্শিকতা সংগঠনের কার্যক্রমভুক্ত না করতে পারলে নিজেরা জনসমর্থন হারিয়ে ফেলবেন। ফলে দেখা যায় দেশের বড় থেকে ছোট প্রতিটি রাজনৈতিক সংগঠন ধর্মীয় বিষয়গুলোকে সাংগঠনিকভাবে গুরুত্ব দেয় এবং ধর্মীয় আদর্শটাও নিজ নিজ সংগঠনের কার্যক্রমে প্রতিফলন ঘটায়। তাই দেখা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্ম পালনকারী মানুষগুলো নিজ নিজ ধর্মভিত্তিক একটি কমিউনিটিতে পরিণত হয়ে পড়ছে। আর এভাবেই বাংলা জনপদের মূল সংস্কৃতি আবহ হারাচ্ছে ও নৈতিক মূল্যবোধের ঘটছে অবক্ষয়। নিজ ধর্ম পালনকারীর অপরাধকে অনেকেই অপরাধ হিসেবে মানতে চায় না। এ ধরনের অপরাধের আলোচনা কোনো আড্ডায় উঠলে নিজ ধর্ম পালনকারীকে সমর্থন করে। ধমীয়ভাবে এর ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা চালায়। অপরাধমূলক কাজ তা যে কোনো ধর্ম পালনকারীই করুক না কেন তাকে অপরাধীর দৃষ্টিতে দেখা উচিত। কিন্তু বর্তমানে আগে দেখা হয় সে কোন ধর্মের অনুসারী। ফলে বিষয়টা হয়ে যায় কমিউনাল বেজড। মানুষের মূল্যবোধের জায়গাটি বদলে যাচ্ছে অপরাধীকে ধর্মীয়করণ করার মাধ্যমে। তাই হচ্ছে মূল্যবোধের অবক্ষয়, বাড়ছে সামাজিক বিশৃঙ্খলা। আর এভাবে সমগোত্রীয় মনোভাবনাটাই সৃষ্টি করছে মৌলবাদ ও সহিংসতা। বর্তমানে তালেবানিরা আফগানিস্তানের ক্ষমতায়। আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থায় ঘটেছে মারাত্মক বিপর্যয়। আফগানিস্তানের আর্থিক বিপর্যস্ততার মূল কারণ ধর্মীয় হানাহানি। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মতে আগামী বছর দেশটিতে দরিদ্র্যের হার হবে ৯৭ শতাংশ। আফগানিস্তানের দারিদ্র্যের মূল কারণ ধর্মীয় সংঘাত। আফগানিস্তান দরিদ্র দেশে পরিণত হলো তালেবানিদের কর্মকাণ্ডের জন্য অথচ এই তালেবানদের ক্ষমতায় দেখে বাংলাদেশের কিছু মানুষ খুশি হয়েছে। বাংলাদেশের তৃণমূল পর্যায়ের ধর্মভীরু কিছু মানুষ বুঝে না বুঝেই তালেবানিদের নিজেদের পক্ষ ভাবছে। এ রকম ভাবনার কারণ হলো ধর্মীয় অনুভূতি। বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদের সাধারণ মানুষের মনস্তাত্ত্বিকতায় খুব কৌশলে ঢোকানো হচ্ছে ধর্মান্ধতা। ফলে মানুষের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের জায়গাটি ক্রমেই হয়ে যাচ্ছে সংকুচিত। আর এই কারণে কিছু সাধারণ মানুষ তালেবানি অপশাসনকেই ভাবছে এটাই ইসলামিক শাসন। ঠিক তেমনিভাবে ধর্মের নাম ব্যবহার করে চলছে নানা ধরনের লুটপাট এদেশে। দেশীয় প্রডাক্টের অনেক পণ্যসামগ্রীর গায়ে আরবি হরফে লেখা দেখতে পাওয়া যায়। সাধারণ মানুষ মনে করেন আরবি ইসলামিক ভাষা। তাই আরবি ভাষার প্রতি ধর্মভীরু মানুষের রয়েছে শ্রদ্ধা ও ভক্তি। দেশীয় প্রডাক্টে আরবিতে লিখলে পণ্য বিক্রি ভালো হবে, মুনাফা লাভের উদ্দেশ্যে ব্যবসায়ীরা ব্যবহার করছেন আরবি বর্ণগুলো। ধর্মটা এখন ধর্মীয় ভাবাবেগের পবিত্রতায় কতটা আছে তা পরিমাপ করা উচিত। হ্যান্ড স্যানিটাইজেশনসহ অনেক পণ্যের বিজ্ঞাপনে বলা হয় পণ্যটি ১০০ ভাগ হালাল। এর কারণ কী? হালাল আর হারাম নিরূপণের মাপকাঠি কী কী? পৃথিবীতে ধর্মের আবির্ভাব হয়েছে হাজার বছর আগে, তখন কোন কোন পণ্য হারাম আর কোনগুলো হালাল তা নির্ধারণ করে গেছেন ধর্ম প্রবর্তকরা। ধর্ম আবির্ভূত হওয়ার হাজার বছর পর তৈরি করা পণ্যগুলোর হালাল-হারাম নির্ধারিত হবে কী মাপকাঠি দিয়ে? পেনিসিলিন তৈরি হয় এক ধরনের অতি ক্ষুদ্রাকৃতির জীব থেকে। এই জীব সম্পর্কে হালাল-হারামের কী সংজ্ঞা আছে? ইন্টারনেট, ফেসবুক, হোয়াটসআপের ব্যবহার কতটা হারাম বা হালাল তা কীভাবে নির্ধারিত হবে, এর কোনো বর্ণনা কি ধর্মীয় বিধানে আছে। বাংলাদেশে বর্তমানে অফিস, আদালত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ধর্মকে ব্যবহার করা হয় ব্যক্তিস্বার্থে। এতে ধর্মের কোনো উৎকর্ষতা বাড়ে না বরং এ ধরনের ব্যবহারে ধর্মের প্রতি মানুষের আকৃষ্টতাই কমে যায়। প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের নেতারা এখন জামায়াতের চেয়ে ধর্মীয়প্রবণ হয়ে গেছেন। নেতারা এখন ধর্মীয় মোড়কের পোশাক পরেন। কথাবার্তা-আচরণের মাধ্যমে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যতা তুলে ধরেন। কিন্তু রাজনীতিতে ক্রমেই বাড়ছে দুর্বৃত্তায়ন। রাজনীতি ও প্রশাসনিক কার্যক্রম থেকে ধর্মকে দূরে রাখতে হবে। তা না হলে ধর্মই হারাবে পবিত্রতা। এটা প্রতিনিয়ত প্রতীয়মান হচ্ছে যে লুটেরা, ঘুষখোর ও দুর্নীতিবাজরা সুনিপুণভাবে ধর্মকে নিজের অপকর্ম ঢাকার বর্ম হিসেবে ব্যবহার করছে। এই বিষয়টি সম্পর্কে দেশের নীতি-নির্ধারকদের ভাববার প্রয়োজন। শাহ মো. জিয়াউদ্দিন : কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App