×

মুক্তচিন্তা

‘আনন্দময়’ শিক্ষাক্রম আশাব্যঞ্জক : মানুষ ও প্রকৃতি থেকে শিক্ষাগ্রহণের অবকাশ থাকুক

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৬:২৪ এএম

২০২৩ সাল থেকে বাংলাদেশের শিক্ষাক্রমে আমূল পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে, ২০২৫ সালে এই পরিবর্তন পূর্ণতা পাবে বলে আশা করছি। এনসিটিবি কর্তৃক প্রণীত এরূপ রূপরেখা সম্পর্কে সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয় আমাদের সামনে একটি ধারণা উপস্থাপন করেছে। প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রমের রূপরেখা আমাদের আশাবাদী করেছে। বিশেষ করে নতুন শিক্ষাক্রমের ‘মূল লক্ষ্য’ হিসেবে গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিবরণদৃষ্টে আমরা শুধু আশাবাদীই হইনি, প্রাণচাঞ্চল্যও অনুভব করেছি। যখন বলা হয়েছে এই শিক্ষাক্রমের মূল লক্ষ্য পড়াশোনাকে ‘আনন্দময়’ করে তোলা তখন তো আর মুখ ভার করে বসে থাকার কোনো উপায় থাকে না। আমরা বছরের পর বছর ধরে পাঠ্যবই, নোটবই আর ‘গাইড’ বইয়ের জঞ্জালে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে কেবল ভারাক্রান্তই করে রাখিনি, যাকে বলে জড় ও জবুথবু অবস্থায় ফেলে রেখেছিলাম। আর শিক্ষার্থীদের ফেলে রেখেছিলাম কোচিং সেন্টাররূপী আচানক এক ফ্যাক্টরিতে! সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা কোচিং আর কোচিং! সৃজনশীল কাজে যুক্ত থাকার বিন্দুমাত্র অবকাশ আমরা শিশুদের জন্য রাখিনি! নতুন শিক্ষাক্রমে স্পষ্ট হয়েছে শ্রেণিকক্ষেই শিক্ষার্থীরা পাঠগ্রহণের অধিকাংশ সম্পন্ন করবে। স্কুল শেষে অবসর। অর্থাৎ শিক্ষাক্রমটি পরিচালিত হবে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক। এই পদ্ধতির বাস্তবায়ন হলে বাজার থেকে নোটবই আর গাইড বইয়েরও জঞ্জাল কমবে। প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষাক্রমে ব্যাপক পরিবর্তন এনে ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম’ রূপরেখা প্রণীত হয়েছে। প্রণীত রূপরেখাটি ১৩ সেপ্টেম্বর শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে উপস্থাপন করলে তিনি খসড়া রূপরেখায় অনুমোদন দান করেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের চিন্তাভাবনার সব ক্ষেত্রের মতোই ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার যে বীজমন্ত্র দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই অভিপ্রায়কেই ‘ভিশন’ ও ‘মিশন’ মনে করে শিক্ষাক্রম ঢেলে সাজাবার নির্দেশনা দিয়েছেন। শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য শুনেও আমরা উপলব্ধি করছি নতুন শিক্ষাক্রম সত্যিকারের স্বাধীনচেতা বাঙালি এবং ঔপনিবেশিক ভাবনামুক্ত মানুষ গঠনে সহায়ক হবে। তিনি বলেছেন : ‘আনন্দময় পড়াশোনা হবে। বিষয়বস্তু ও পাঠ্যপুস্তকের বোঝা এবং চাপ কমানো হবে। গভীর শিখনে গুরুত্ব দেয়া হবে। মুখস্থ নির্ভরতার বিষয়টি যেন না থাকে, এর বদলে অভিজ্ঞতা ও কার্যক্রমভিত্তিক শেখাকে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। শিক্ষার্থীর দৈহিক ও মানসিক বিকাশে খেলাধুলা এবং সাংস্কৃতিক কার্যক্রমকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।’ শিক্ষামন্ত্রীর যে বক্তব্যটি তাৎপর্যপূর্ণ তা হলো, তিনি বলেছেন : ‘ক্লাস শেষে যেন শিক্ষার্থীরা নিজেদের মতো সময় কাটাতে পারে। পড়াশোনার বাইরে খেলাধুলা বা অন্যান্য বিষয়ের সুযোগ কমে গেছে, এটা যেন না হয়। জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয়ে যোগ্যতা অর্জন করতে হবে।’ শিক্ষা নিয়ে যে কোনো আলোচনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষাভাবনাও আমাদের প্রেরণা সঞ্চার করে। উপমহাদেশের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার সময় যেসব সংকট চিহ্নিত করেছিলেন তা থেকে এখনো আমরা মুক্ত হতে পারিনি। কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রমের লক্ষ্য হিসেবে মন্ত্রীর বর্ণিত বক্তব্য গভীরভাবে পাঠ করলে আমরা যেন সেই মুক্তিরই আবহ সংগীত স্পষ্ট শুনতে পাই। ১২৯৯ বঙ্গাব্দে রাজশাহী এসোসিয়েশনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শিক্ষার হেরফের’ প্রবন্ধটি পঠিত হয়েছিল। প্রবন্ধের এক জায়গায় তিনি বলেছেন : ‘আমরা যতই বি.এ. এম.এ পাস করিতেছি, রাশি রাশি বই গিলিতেছি, বুদ্ধিবৃত্তিটা তেমন বেশ বলিষ্ঠ এবং পরিপক্ব হইতেছে না। তেমন মুঠা করিয়া কিছু ধরিতে পারিতেছি না, তেমন আদ্যপান্ত কিছু গড়িতে পারিতেছি না, তেমন জোরের সহিত কিছু দাঁড় করাইতে পারিতেছি না। আমাদের মতামত, কথাবার্তা, আচার-অনুষ্ঠান ঠিক সাবালকের মতো নহে। সেইজন্য আমরা অত্যুক্তি আড়ম্বর এবং আস্ফালনের দ্বারা আমাদের মানসিক দৈন্য ঢাকিবার চেষ্টা করি। ইহার প্রধান কারণ, বাল্যকাল হইতে আমাদের শিক্ষার সহিত আনন্দ নাই। কেবল যাহা-কিছু নিতান্ত আবশ্যক তাহাই কণ্ঠস্থ করিতেছি।’ সম্পূর্ণ প্রবন্ধ পাঠ না করলেও উদ্ধৃত মন্তব্য থেকে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনার মৌল প্রেরণা অনুমান একেবারে কঠিন কিছু নয়। আবার এও অনুমেয় যে, আমাদের কালের শিক্ষাব্যবস্থাও রবীন্দ্রভাষ্যেরই অনুরূপ, অনেকটাই মুখস্থসর্বস্ব! প্রবন্ধটি ‘সাধনা’ পত্রিকায় মুদ্রিত হলে সেকালের অনেক যশস্বী ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের এই শিক্ষাভাবনার সঙ্গে ঐকমত্য পোষণপূর্বক পত্রপত্রিকায় দীর্ঘ বক্তব্য প্রকাশ করেছিলেন। এদের মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিচারপতি গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আনন্দমোহন বসুর নাম সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য। কালচক্রে শতাধিক বর্ষ আমরা পেছনে ফেলে এসেছি। কিন্তু এখনো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে আমরা জবুথবু ও আড়ষ্টই করে রেখেছি। পাঠ্যবইয়ের দীর্ঘ সিলেবাস, ঢাউস আকারের নোট বই আর বিচিত্রনামা গাইড বইয়ের ভিড়ের মধ্যে ফেলে একদিকে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে যেমন পিষে মারছি তেমনি পিষে মারছি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও। আমাদের সন্তানরাও বংশ-পরম্পরায় আমাদের মতোই পৃথিবীকে গভীরভাবে উপলব্ধির শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এরূপ বাস্তবতায় একদা রবীন্দ্রনাথ আক্ষেপ করে বলেছিলেন : ‘জগৎকে আমরা মন দিয়া ছুঁই না, বই দিয়া ছুঁই।’ গাইড বই আর নোট বইয়ের মুখস্থ বিদ্যালাভের ফলে আমাদের সহজাত স্বভাব যেমন বিনষ্ট হয়েছে, তেমনি শিক্ষা থেকে আনন্দেরও অপনোদন ঘটেছে, সার্বিকভাবে আমাদের জীবন থেকেও আনন্দ হারিয়ে গেছে। শিক্ষামন্ত্রীর ভাষায় ‘আনন্দময়’ শিক্ষাক্রমের দিকে তাই আমাদের মনোযোগ এবং আশাবাদ। আমাদের উন্মুখ অপেক্ষা এখন নতুন শিক্ষাক্রমের জন্য। আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি যুগোপযোগী এক শিক্ষাক্রমের। যার মাধ্যমে বাংলাদেশে একটি দক্ষ, সৃজনশীল ও মানবিক প্রজন্ম তৈরি সম্ভব হবে। যারা আমাদের এই দেশকে বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করে উন্নত ও সমৃদ্ধ করবে। বাংলাদেশ আমাদের দেশ, বাংলা আমাদের ভাষা। কিন্তু মনে রাখতে হবে, আমাদের এই ভাষা ও এই দেশ এমনি এমনি আমরা পাইনি। এ দুটিই আমাদের অর্জন করতে হয়েছে। ভাষা ও দেশের মর্যাদা রক্ষার জন্য, ভাষা ও দেশের মুক্তির জন্য আমাদের পূর্বপুরুষদের বুকের তাজা রক্ত দিতে হয়েছে। আশ্চর্যের ব্যাপার- আমাদের এ দুটি বৃহত্তর মুক্তির সঙ্গেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গভীর সম্পৃক্ততা রয়েছে। আমাদের নতুন শিক্ষাক্রমে জাতির ইতিহাস ও সংস্কৃতির সন্নিবেশ থাকতে হবে। বাঙালির হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং জাতীয় মুক্তির ইতিহাসকে খেলাচ্ছলে শিশু বয়সেই শিক্ষা দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সন-তারিখ মুখস্থের চেয়ে ঘটনাক্রমকে প্রাধান্য দিলে শিশুমন থেকে ইতিহাসভীতি কমে যাবে। রূপকথা যেমন সমগ্র জীবনের জন্য শিশুমনে দাগ কেটে যায়, তেমনি বাঙালির শাশ্বত ইতিহাসকেও রূপকথার আদলে শিশু-শিক্ষার্থীদের সম্মুখে তুলে ধরতে হবে। সন-তারিখ নিয়ে মাথা ঘামাবে উঁচু ক্লাসে, বড় হয়ে, গবেষণাকালে। প্রকৃতি বিষয়েও শিশু বয়স থেকেই শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিতে হবে। প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রকৃতি বিষয়ে শিক্ষা দিতে হবে। কোনো বইপুস্তক নয়- গাছপালা-লতাগুল্ম ধরে ধরে শিক্ষা। শিক্ষা দিতে হবে ঋতুচক্রের আবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রং ও রূপ বদলানোর পারম্পর্য সম্পর্কে। শিক্ষা দিতে হবে নদ-নদীর গতি প্রবাহের উত্থান-পতন নিয়ে, আকাশের উদ্বেলতা নিয়েও। শিশুদের কাঁধের ভারী ব্যাগ থেকে বই কমিয়ে মানুষের কাছ থেকেও শিক্ষাগ্রহণের কৌশল শিক্ষা দিতে হবে। প্রকৃতি ও মানুষ থেকে শিক্ষাগ্রহণের অর্থ যে তথ্যপ্রযুক্তির বাইরে চলে যাওয়া কিংবা সভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া, তা কিন্তু নয়। গভীর বৈজ্ঞানিক আলোচনার প্রসার ঘটালে দেখতে পাব নিখিলভুবনের গোপন গভীর রন্ধ্রে রন্ধ্রে সুপ্তাবস্থায় রয়েছে বিচিত্রতর বিজ্ঞান। অধিকাংশ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারই অন্তর্নিহিত প্রকৃতির গভীর থেকেই। সে সম্পর্কেও শিক্ষার্থীদের ধারণা দিয়ে সজাগ করে তুলতে হবে। আমাদের প্রকৃতি চিনতে হবে, চিনতে হবে বিচিত্র স্বাভাবের মানুষকেও। শুধু চেনাশোনা নয়- মানুষকেই জানতে হবে। রবীন্দ্রনাথ অনেকটা এমন করেই বলেছিলেন যে, আমরা জনসভায় ভাষণ দিতে পারি, কিন্তু একজন মানুষের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কথা বলতে পারি না। তার ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের অনুভবগুলোও উপলব্ধি করতে পারি না। মানুষের সঙ্গে সহজভাবে মিশতে না শিখলে এরূপ অনুভবের উপলব্ধি সহজও নয়। সহজ ও সজীবভাবে মানুষের সঙ্গে মিশবার সহজ শিক্ষাই শিশুদের দিতে হবে। আবার শিক্ষার্থীদের মধ্যে নিজ নিজ স্বভাববোধকে জাগ্রত করার কৌশলটিও শিখিয়ে দিতে হবে। কেননা সে যদি নিজের স্বভাবটি উপলব্ধি করতে পারে তবে তার ভেতর দিয়ে সে যা অর্জন করবে তাই হবে প্রকৃত ও খাঁটি। এই অর্জনই তাকে পরিপূর্ণ সাহস, শক্তি ও আশ্রয় দেবে। অর্থাৎ আমরা বলতে চাইছি শিশুরা যা শিখবে তা যেন প্রয়োগও করতে পারে। এটি সম্ভব হলে তার অর্জিত শিক্ষা কখনো নিষ্ক্রিয় থাকবে না। অর্থাৎ তার ওপর শিক্ষা কখনো চেপে বসবে না বরং সেই-ই শিক্ষার ওপর চেপে বসার যোগ্য হয়ে উঠবে। শিক্ষাক্রমকে যতটুকু পারা যায় সহজ করতে হবে, সহজাত ও সাবলীল করতে হবে। তবেই শিক্ষা হবে আনন্দময়। আবারো রবীন্দ্রনাথের কথা দিয়েই শেষ করতে চাই। শিক্ষাভাবনার ‘আবরণ’ প্রবন্ধে তিনি বলেছেন : ‘আমরা মন খাটাইয়া যে জ্ঞান উপার্জন করি, তাহা আমাদের মজ্জার সঙ্গে মিশিয়া যায়; বই মুখস্থ করিয়া যাহা পাই তাহা বাহিরে জড়ো হইয়া সকলের সঙ্গে আমাদের বিচ্ছেদ ঘটায়।’ কিন্তু আমরা শিক্ষার মাধ্যমে বন্ধনও সৃষ্টি করতে চাই, আত্মিক বন্ধন। তবেই তো মানুষের মুক্তি- রবীন্দ্রনাথের ভাষায় : ‘অসংখ্য বন্ধনমাঝে মহানন্দময় লভিব মুক্তির স্বাদ!’ আমাদের আগামী প্রজন্ম হোক মুক্তমনের, মুক্তচিন্তার। প্রস্তাবিত ‘আনন্দময়’ শিক্ষাক্রমে আমরা মুক্তমনের মানবিক মানুষের পদধ্বনিই যেন শুনতে পাই। আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App