×

জাতীয়

তৃণমূল নেতাদের পক্ষ থেকে কী বার্তা পেল বিএনপি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৯:০৬ এএম

সারাদেশের নেতাকর্মীদের মনোযোগ ছিল টানা ৩ দিনের রুদ্ধদ্বার বৈঠকে। মঞ্চে সিনিয়র নেতারা, স্ক্রিনে শীর্ষ নেতা। আসনে বসা তৃণমূল নেতারা নীতি-নির্ধারকদের সামনে নিজেদের প্রত্যাশা, ক্ষোভ, অভিমান, অভিযোগ নির্ভয়ে মন খুলে প্রকাশ করলেন। তৃনমূল নেতাদের বক্তব্যে কি বার্তা ছিল বিএনপির জন্যে? এমন আলোচনাই এখন দলটিতে।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক কর্মকৌশল ঠিক করার লক্ষ্যে নেতাদের মতামত জানতে গত ১৪-১৬ সেপ্টেম্বর দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সভাপতিত্বে ধারাবাহিক বৈঠক করে বিএনপি। বৈঠকে মধ্যম সারির নেতাদের বক্তব্যের খুঁটিনাটি সব কিছু খাতায় টুকে রেখেছেন সিনিয়র নেতারা। আজ শনিবার দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এসব বিষয় পর্যালোচনা করে ভবিষ্যৎ রূপরেখা প্রণয়ন করা হবে।

বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এমন নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগামী দিনের করণীয় নিয়ে নেতারা তাদের মতামত তুলে ধরেন। সব নেতাই দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে জরুরি পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানান। সবাই একই সুরে বলেন, বর্তমান সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ নয়, ধার করা নেতৃত্বের নয়, আন্দোলনমুখী দলীয় নেতৃত্ব জরুরি। ইসি গঠনের আগে নিরপেক্ষ সরকার দাবিতে আন্দোলনে যেতে হবে। এর আগে অঙ্গ সংগঠনগুলোর কমিটিগুলো পুনর্গঠনসহ জামায়াত ইস্যু দ্রুত নিম্পত্তির দাবি জানিয়েছেন তারা। পাশাপাশি আগামী দিনে যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে তারা প্রস্তুত রয়েছেন বলেও জানান।

তারেক রহমান কেবল সবার বক্তব্য চুপচাপ শুনেছেন। তবে মধ্যম সারির নেতাদের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বারবারই বলেছেন, রাজপথে নামার সংকল্প ও দৃঢ়তার অভাব আছে সবারই। তবে এবার প্রস্তুত হোন। অন্যদিকে সিনিয়র নেতারা দলের ঐক্য ধরে রাখার প্রতি অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। বৈঠকে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, দলের ভেতরে ও বাইরে ঐক্য সৃষ্টি করতে হবে। নিজেদের মধ্যে ঐক্য না থাকলে দলে ঐক্য আসবে না। শেখ হাসিনার সরকার হঠাতে না পারলে দেশে গণতন্ত্র আসবে না। ঐক্য লাগবেই।

বৈঠকের বিষয়ে বিএনপির শীর্ষ নেতারা বলছেন, বিভিন্ন সারির নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময়ে দলে নতুন উদ্যোম সৃষ্টি হয়েছে। দুপক্ষের আলোচনায় যে কোনো পরিস্থিতিতে নিজেরা সুসংগঠিত হওয়ার পরিবেশ তৈরি হয়েছে। কিছু ভুল-বোঝাবুঝি মান-অভিমানেরও অবসান হয়েছে। বৈঠকে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভিন্ন রোডম্যাপ উঠে এসেছে। অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর ‘রিভিউ’ করা হয়েছে।

জানতে চাইলে স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, সাংগঠনিক তৎপরতার অংশ হিসেবে তিন দিনের বৈঠক হয়েছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। একেবারে কেন্দ্রীয় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত কথা বলেছেন। এই বৈঠক থেকে বিএনপি উপকৃত হয়েছে। আওয়ামী লীগের অধীনে ভোট নয় : প্রতিটি বৈঠকেই নেতারা জোর দিয়ে বলেছেন, এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়া উচিত হবে না। নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায়ে দরকার হলে আবার ২০১৩ সালের মতো কঠোর আন্দোলনে যাওয়া উচিত। প্রথম দিনের বৈঠকে মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ বলেন, বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়া বোকামি। ছয়বারের এমপি হয়ে আমি নির্বাচনের সময় ঘর থেকে বের হতে পারিনি। ঘোষণা দিতে হবে, হাসিনার অধীনে ‘নো’ নির্বাচন। সংসদ বহাল রেখেও নির্বাচন হবে না।

নিরপেক্ষ সরকার দাবিতে আন্দোলনে যেতে হবে : নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকার ও নির্বাচন কমিশন গঠন এবং খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য আমাদের সামনে আন্দোলনের বিকল্প নেই। তবে আন্দোলনে নামার আগে দল, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলো গোছানোর পরামর্শ দিয়েছেন তৃণমূল নেতারা। চলতি বছরের মধ্যে সংগঠনের পুনর্গঠনের কাজ শেষ করে সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে রাজপথে নামতে হবে।

সাংগঠনিক সম্পাদক এডভোকেট রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু বলেন, সামনে হয় এস্পার, নয় ওস্পার। কারণ আওয়ামী লীগ সরকার আমাদের নির্বাচন করতে দেয়নি। আবার এখন সরকার নতুন খেলা শুরু করেছে। আওয়ামী লীগের অধীনে আর কোনো নির্বাচন হবে না। নির্বাচন কমিশন গঠনের আগে নিরপেক্ষ নির্বাচন দাবিতে বিএনপিকে এককভাবে আন্দোলনে যেতে হবে।

‘ঘরবন্দি’ কর্মসূচি নয় : বিএনপির বর্তমান রাজনৈতিক দুরবস্থার জন্য ‘ঘরবন্দি’ কর্মসূচিই দায়ী- এমনটি মনে করছেন দলটির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যরা। দলের শীর্ষ নেতাদের হলরুমের কর্মসূচিতে সীমাবদ্ধ না থেকে রাজপথে নামার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। বিএনপির সহ-আইনবিষয়ক সম্পাদক ইকবাল হোসেন তার বক্তব্যে বলেন, একটা সময় বিএনপির জনসভা ও সমাবেশের প্রতি মানুষের আলাদা আকর্ষণ ছিল। এখন আমাদের সমাবেশ প্রেস ক্লাব ও ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে সীমাবদ্ধ। আমাদের এই দুরবস্থা কেন? এখন পাড়া-মহল্লায় বিএনপির কোনো রাজনীতির চর্চা নেই। এর মূল কারণ, নেতার বাসা। তাহলে কীভাবে পাড়া-মহল্লায় আমাদের রাজনীতি থাকবে?

ড. কামালের নেতৃত্ব ভুল ছিল : জানা গেছে দ্বিতীয় দিনের বৈঠকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সামনেই বেশ কিছু বিষয়ে উত্তপ্ত বক্তব্য রাখেন নেতারা। তৃণমূল নেতারা জানতে চান, কার বুদ্ধিতে ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে ড. কামাল হোসেনকে ভাড়া করা হয়েছিল। তারা বলেন, ড. কামাল সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেছেন। বিএনপি তার ফাঁদে পা দিয়েছিল। এটা ছিল চরম ভুল সিদ্ধান্ত। তাই ২০১৮ সালের মতো ধার করা নেতার নেতৃত্বে নয়, দলীয় চেয়ারপারসনের নেতৃত্বেই ভোটের পথে এগুতে হবে।

এ সময় বিএনপির বিশেষ সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, ড. কামাল হোসেন তো জিয়াউর রহমানকে নেতাই মানতে চান না। তাহলে বিএনপি কীসের ভিত্তিতে তাকে নিয়ে নির্বাচনে গেল? তখন কেন আমাদের মতামত নেয়া হয়নি? আশা করব, বিএনপি এই ভুল আর দ্বিতীয়বার করবে না। জামায়াত ইস্যু দ্রুত নিষ্পত্তির পরামর্শ : কেন্দীয় নেতৃত্বকে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোটগত সম্পর্ক রাখা বা ছেড়ে আসার বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অঙ্গ সংগঠনের নেতারা। তৃতীয় দিনের বৈঠকে তারা বলেছেন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর গুরুত্ব অনেকাংশেই কম। সেকারণে জামায়াতের সঙ্গে বিদ্যমান জোটগত সম্পর্ককে নতুনভাবে দেখা প্রয়োজন।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শওকত মাহমুদ বলেন, আওয়ামী লীগের অধীনে আবার নির্বাচন হলে জামায়াত ’৮৬ ও ’৯৬ সালের মতো বিএনপি ছাড়াই নির্বাচনে চলে যাবে। তাই জামায়াতের ব্যাপারে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ এ বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে নানা ধরনের সংবাদ প্রকাশিত হবে। আগাম নির্বাচনের প্রস্তুতি : প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায় আগাম নির্বাচনের আভাস পাচ্ছে বিএনপি। বিষয়টি নিয়ে বিএনপি সাংগঠনিক সম্পাদকরা বলেন, আওয়ামী লীগ হয়তো আগাম নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথে যাচ্ছে। বিষয়টিকে মাথায় রেখে বিএনপিকেও আগামী দিনের কর্ম-পরিকল্পনা ঠিক করতে হবে।

সরকারের সঙ্গে সংলাপ নয় : বৈঠকে নেতারা বলেন, সরকারের কাছ থেকে নিরপেক্ষ নির্বাচন আদায় করতে হলে বিএনপিকে মাঠে নেমেই আদায় করতে হবে। কোনো সংলাপ বা আলাপ-আলোচনা করে দাবি আদায় করা সম্ভব নয়। এর আগেও অনেক লোক দেখানো সংলাপ হয়েছে। সরকারের এসব লোক দেখনো সংলাপ সখ্যতায় না গিয়ে দলকে শক্তিশালী করে যত দ্রুত সম্ভব মাঠে নামতে হবে।

শীর্ষ নেতাদের ওপর ক্ষোভ : দ্বিতীয় দিনের বৈঠকে সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক দিকগুলো তুলে ধরে দলের শীর্ষ নেতাদের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাংগঠনিক সম্পাদকরা। তারা জানান, দলীয় কর্মসূচির বাইরে জনসম্পৃক্ত ইস্যুগুলো নিয়ে আগামীতে রাজপথে নামতে হবে। এ সময় খালেদা জিয়ার মুক্তির ইস্যুতে সিনিয়র নেতারা সময়োপযোগী কর্মসূচি দিতে পারেননি বলেও অভিযোগ করেন তারা। পাশাপাশি কার্যকর নেতৃত্ব গড়ে তুলতে প্রয়োজনে রাজপথে সক্রিয় নেতাদের তালিকা করার পক্ষে মত দেন তারা।

কমিটি গঠনে প্রভাবশালীদের তদবির বন্ধের পরামর্শ : বিভিন্ন জেলা উপজেলা কমিটি গঠনে স্থানীয় বিএনপিসহ দলের শীর্ষ নেতাদের তদবির দোষারোপ করেছেন অঙ্গ সংগঠনের নেতারা। তারা বলেন, প্রভাবশালী নেতাদের পছন্দের লোককে নেতা বানালেই তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দেন। ফলে অনেক ত্যাগী ও যোগ্যরা বাদ পড়েন। কয়েকজন কৃষক দলসহ কয়েকটি সহযোগী সংগঠনের কমিটি নিয়ে লেজেগোবরে অবস্থার চিত্রও তুলে ধরেন। নারী নেতৃত্বকে শক্তিশালী করার তাগিদ : বিএনপিতে নারী নেত্রীদের গুরুত্বপূর্ণ পদ দেয়ার দাবি ওঠে বৈঠকে। মহিলা দলের সভাপতি আফরোজা আব্বাস বলেন, মহিলা দলকে শক্তিশালী করতে সংগঠনের বাইরে থাকা অনেক নারী নেত্রী, সাবেক এমপিকে সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন। তাই নতুনভাবে এ সংগঠনকে ঢেলে সাজাতে হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App