×

মুক্তচিন্তা

করোনার টিকা আমদানি ও দেশে উৎপাদন কার্যক্রম প্রসঙ্গে

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০১:৫১ এএম

অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে করোনা ভাইরাসের টিকাদান কার্যক্রম। করোনা মহামারির ভয়াবহ বিপর্যয় থেকে বেরিয়ে আসতে সহায়তা করছে করোনা প্রতিরোধী টিকাগুলো। শুরুতে এক আর দুই ডোজের টিকার প্রাধান্য দেয়া হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে টিকার কার্যক্ষমতা কমে যাওয়ায় এখন বুস্টার ডোজের কথা ভাবা হচ্ছে। এমনিতেই টিকাদানের ক্ষেত্রে উন্নত দেশের চেয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলো বেশ পিছিয়ে। আবার টিকাদান কার্যক্রমও ধীরগতিতে চলছে এই দেশগুলোতে। এভাবে বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের টিকাদান কার্যক্রম ধীরগতিতে চলতে থাকলে ২.৩ ট্রিলিয়ন ডলার ক্ষতি হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ)। এই ক্ষতির মুখে পড়বে মূলত উন্নয়নশীল দেশগুলো। ওদিকে বুস্টার ডোজ নিয়ে কোটি কোটি ডলারের মুনাফা কামানোর স্বপ্ন দেখছে টিকা প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো। অপ্রিয় হলেও নির্মম বাস্তব সত্যি হলো, সাধারণ মানুষের টিকা প্রাপ্তির বিষয়টি মানবিক দিক থেকে বিবেচনা করা হচ্ছে না। টিকা প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলো কোটি ডলার কামানোর ধান্দায় রয়েছে। তাই সাধারণ মানুষ যাতে টিকা নিতে পারে, জীবন বাঁচাতে পারে, সেজন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে আরো সোচ্চার হতে হবে। বাংলাদেশের মতো উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর টিকাদান কার্যক্রম ধীরগতিতে চলতে থাকলে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হবে। এক্ষেত্রে সরকারকে আরো সচেতন হতে হবে। প্রয়োজনে অন্য খাতের গুরুত্ব কমিয়ে টিকাদান কার্যক্রমকে প্রথম অগ্রাধিকার দিতে হবে সরকারকে। আগের তুলনায় করোনার টিকার জোগান অনেকটাই শক্তিশালী করেছে সরকার; অন্ততপক্ষে বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে কোথাও ক্রয়চুক্তি, আবার কোথাও বিনামূল্যে টিকা পাঠানোর প্রতিশ্রæতি আদায়ে সক্ষম হয়েছে। যদিও এর মধ্যে কোনো কোনো দেশ বা সংস্থার সময়মতো প্রতিশ্রæতি বা চুক্তি না রাখার নজিরও তৈরি হয়েছে। ফলে সরকার টিকার গতি বাড়িয়েও তা ধরে রাখতে পারছে না; গতি একটু বাড়ালেই হোঁচট খেতে হচ্ছে বারবার। শুরুর দিকে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি খাতকেও এগিয়ে আসার আহ্বান জানানো হয়েছিল টিকা আমদানি ও সরবরাহের জন্য। কিন্তু বাস্তবে এখন পর্যন্ত দেশের কোনো বেসরকারি উদ্যোক্তা কিংবা প্রতিষ্ঠানকে এ ক্ষেত্রে শক্তিশালী ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে না। তবে প্রকাশ্যে না থাকলেও অনেকেই সরাসরি বিদেশের নির্দিষ্ট কোম্পানির কাছ থেকে টিকা এনে সরকারকে সরবরাহের জন্য তৎপরতা চালাচ্ছে। শুধু আমদানিই নয়, যথেষ্ট সুযোগ থাকার পরও টিকা উৎপাদনে গতি আসছে না বেসরকারি উদ্যোক্তাদের প্রয়োজনীয় মাত্রায় সুযোগ না দেয়ার কারণে। বরং সরকার একাই এখন টিকা আনছে আবার উৎপাদনেও কাজ করছে। সব মিলিয়ে টিকার ইস্যুতে দেশের বেসরকারি ওষুধ শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে যথেষ্ট মাত্রায় সরকার কাজে লাগাতে পারছে না। স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে টিকার সুষম বণ্টন না হলে শুধু পশ্চিমা দেশগুলোতে বুস্টার ডোজ প্রয়োগের উদ্যোগ নেয়া হলে বিশ্বজুড়ে করোনায় মৃত্যুহার আরো বাড়বে। কারণ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো তাদের নাগরিকদের জন্য এখনো করোনার টিকার প্রথম ডোজই নিশ্চিত করতে পারেনি। এজন্য বুস্টার ডোজ স্থগিত করার আহ্বান জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্য মতে, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত টিকা এসেছে ৩ কোটি ৮৭ লাখ ডোজ। এর মধ্যে ২ কোটি ৫২ লাখ ৫৮ হাজার ৫১৯ ডোজ টিকা দেয়া হয়েছে। সেই হিসাবে এই মুহূর্তে ৬৪ লাখ ৬৬ হাজার ৬৪১ ডোজ টিকা মজুদ আছে। এর মধ্যে বিভিন্ন টিকার প্রথম ডোজ দেয়া হয়েছে ১ কোটি ৭৮ লাখ ২৮ হাজার ৩০২ জনকে। আর দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছেন ৭৪ লাখ ৩০ হাজার ২১৭ জন। এগুলো দেয়া হয়েছে অক্সফোর্ডের অ্যাস্ট্রাজেনেকা, চীনের তৈরি সিনোফার্ম, ফাইজার এবং মডার্নার ভ্যাকসিন। এদিকে এখন পর্যন্ত নিবন্ধন করেছেন ৩ কোটি ৬৮ লাখ ১৭ হাজার ৫৪৪ জন। যদিও স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী কয়েক দিন ধরে বলে আসছেন, ডিসেম্বরের মধ্যেই আরো ১৬ কোটি ডোজ টিকা দেশে এসে যাবে। মন্ত্রীর কথার বাস্তবায়ন ঘটলে এ পর্যন্ত হাতে পাওয়া প্রায় ৪ কোটি ডোজ এবং ডিসেম্বরের মধ্যে কোভ্যাক্স ও চীন থেকে ১৬ কোটি ডোজ মিলে প্রাপ্তি ২০ কোটি ডোজ ছাড়িয়ে যাবে। এর সঙ্গেই যুক্ত হবে দেশি প্রতিষ্ঠান ইনসেপ্টার মাধ্যমে প্রস্তুতকৃত টিকা থেকে আরো এক-দুই কোটি ডোজ। কিন্তু দেশে টিকা উৎপাদনের ক্ষেত্রে আরো সুযোগ থাকলেও সরকার তা ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারছে না। শুধু দেশীয় সমস্যাই নয়, বৈশ্বিক পরিস্থিতির শিকার হয়েও টিকায় বাংলাদেশ প্রত্যাশিত জায়গা থেকে অনেকটাই পিছিয়ে আছে। এবার কোনো দেশই সরকারের বাইরে টিকা আমদানি-রপ্তানি করতে পারছে না। তবে বিভিন্ন দেশের সরকার প্রয়োজনমতো বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সহায়তা নিয়ে টিকা আমদানি করে নিজেদের হাতে রাখছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার নিজের হাতেই নিয়ন্ত্রণ বেশি রেখেছে। অন্য দেশগুলো আগেভাগে টিকা কিনে ফেলায় এখন সরকারের হাতে টিকার জন্য পর্যাপ্ত টাকা থাকলেও সময়মতো টিকা পাচ্ছে না বাংলাদেশ। এখন সব দেশই সরকারের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক এবং অন্যান্য বিষয়ে বোঝাপড়ার মাধ্যমে টিকা ছাড় করছে বা চুক্তি করছে। এ পর্যন্ত দেশে কিছু প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে আবেদন জমা দেয়া হয়েছে; যাদের কেউ টিকা আমদানি করতে চায়, কেউ উৎপাদন করতে চায়, আবার কেউ কেউ ট্রায়াল করতে চায়। কিন্তু এগুলোর বেশির ভাগই সরকারের সায় পাচ্ছে না। টিকা আমদানি ও উৎপাদনের জন্য বিভিন্ন দেশ ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরকার নিজেই যোগাযোগ করছে এবং প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া চালাচ্ছে। এর পেছনে যুক্তি দেয়া হচ্ছে, টিকা নিয়ে যাতে বেসরকারি খাত কোনো বাণিজ্য করতে না পারে কিংবা বেশি টাকা দিতে না হয়। সরকারের নিজের ব্যবস্থাপনায় টিকা আনার পরিকল্পনা ভালোই ছিল, কিন্তু তারা সময়মতো কাজ করতে না পারায় এখন আগের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি দাম দিয়ে টিকা কিনছে। সরকারের টিকা নিয়ে নতুন করে রোডম্যাপ তৈরি করে তা প্রকাশ্যে জানানো উচিত স্বচ্ছতার সঙ্গে। নয়তো এক ধরনের বিভ্রান্তি থেকেই যায়। সরকার কোন মাধ্যমে কতটা টিকা পাবে, সেটা জানানোর পাশাপাশি খরচও জানানো উচিত। ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের গবেষণায় দেখা গেছে, করোনা ভাইরাসের টিকাদান কার্যক্রম ধীরগতির কারণে ক্ষতির মুখে পড়বে মূলত উন্নয়নশীল দেশগুলো। টিকাদানের ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলোর চেয়ে উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশগুলো অনেক পিছিয়ে আছে। ইতোমধ্যে উন্নত দেশগুলো তাদের নাগরিকদের বুস্টার ডোজ দিতে শুরু করেছে। যেখানে দরিদ্র দেশগুলোর জন্য টিকা সরবরাহের আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা অপ্রতুল রয়ে গেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব দেশ ২০২২ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত তাদের জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ টিকা দিতে ব্যর্থ হবে তারা ২০২২-২৫ মেয়াদে ২ ট্রিলিয়ন ইউরোর সমান ক্ষতির সম্মুখীন হবে। ইআইইউ বলেছে, উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলো এই ক্ষতির প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ বহন করবে এবং উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে তাদের অর্থনৈতিক দূরত্ব বেড়ে যাবে। তারা সতর্ক করেছে, টিকা বিলম্বিত হওয়ায় অসন্তোষ বাড়তে পারে এবং উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে সামাজিক অস্থিরতার ঝুঁকি বাড়বে। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যা প্রায় মোট ক্ষতির তিন-চতুর্থাংশ। গবেষণায় বলা হয়েছে, দরিদ্র দেশগুলোর মাত্র ১ শতাংশের তুলনায় উচ্চ আয়ের দেশগুলোর প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ আগস্টের শেষ পর্যন্ত কমপক্ষে একটি ডোজ পেয়েছে। বেশিরভাগ টিকার ক্ষেত্রে দুটি ডোজ নিতে হয়। নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে টিকাদান কার্যক্রম মন্থর গতিতে এগিয়ে চলছে। আজ এটা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, দরিদ্র দেশগুলোকে টিকা সরবরাহে আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা কোভ্যাক্স তার সামান্য প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। এই সময়ের বাস্তব পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে সাধারণ মানুষের টিকা প্রাপ্তির ব্যাপারে মানবিক দিক বিবেচনা করা হচ্ছে না। এমনিতেই টিকাদানের ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলোর চেয়ে বাংলাদেশের মতো উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশগুলো অনেক পিছিয়ে আছে। আর টিকাদান কার্যক্রম ধীরগতিতে চলতে থাকলে স্বাভাবিকভাবেই ক্ষতির সম্মুখীন হবে এই দেশগুলো। তাই সাধারণ মানুষ যাতে টিকা নিতে পারে, জীবন বাঁচাতে পারে, সেজন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে আরো সোচ্চার হতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদের সরকারকে আরো সচেতন হতে হবে। প্রয়োজনে অন্য খাতের গুরুত্ব কমিয়ে টিকাদান কার্যক্রমকে প্রথম অগ্রাধিকার দিতে হবে সরকারকে। তা না হলে আগামীতে টিকা পেতে আরো ব্যয় বৃদ্ধি পেতে পারে বলে ধারণা করা যায় অনায়াসেই। এদিকে করোনা মহামারির ভয়াবহ বিপর্যয় থেকে বেরিয়ে আসতে শুরুতে এক আর দুই ডোজের টিকার প্রাধান্য দেয় টিকা উৎপাদনকারী সংস্থাগুলো। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে টিকার কার্যক্ষমতা কমে যাওয়ায় বুস্টার ডোজের পরামর্শ দিচ্ছে তারা। আর এই বুস্টার ডোজ নিয়ে কোটি কোটি ডলার হাতিয়ে নেয়ার স্বপ্ন দেখছে টিকা প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো। এদিকে বুস্টার ডোজ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া দেশের তালিকা দিন দিনই বাড়ছে। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে ব্রিটিশ সরকার বুস্টার ডোজ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। ওদিকে যুক্তরাষ্ট্র দুর্বল ও বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য বুস্টার ডোজের অনুমোদন দিয়েছে। ফ্রান্স ও জার্মানিও একই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এরই মধ্যে ইসরায়েল ও চিলি তাদের বয়স্ক নাগরিকদের বুস্টার ডোজ দেয়া শুরু করেছে। বলা হচ্ছে যে, করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো কোভিড টিকা তৈরি ও সরবরাহ করছে, তারা অতি মুনাফা না করলে মানুষ হয়তো ৫ ভাগের ১ ভাগ দামে টিকা পেত। সবদিক গভীরভাবে বিচার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বাংলাদেশের টিকাদান কার্যক্রম ভালো অবস্থায় নেই। সেই হিসেবে দেশের অর্থনীতির ক্ষতিটা বড়ই হবে। কারণ দেশির পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগও খুব বেশি আসছে না। যতদিন না টিকা প্রদান শতভাগ হচ্ছে ততদিন বিনিয়োগ পরিস্থিতি খারাপ হতেই থাকবে। তাই টিকাদানে জোর দিতে হবে সরকারকে। রেজাউল করিম খোকন : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App