×

অর্থনীতি

ই-কমার্স নীতিমালায় গলদ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৮:৫২ এএম

ই-কমার্স নীতিমালায় গলদ

ফাইল ছবি

প্রতারণতার মাধ্যমে কোনো প্রতিষ্ঠান হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিলেও সরকার শুধু ট্রেড লাইসেন্স, ভ্যাট নিবন্ধনসহ কিছু অনুমতি বাতিল করতে পারে। ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে অভিযুক্তরা গ্রেপ্তার হলেও লাভ নেই ক্ষতিগ্রস্তদের। জাতীয় ডিজিটাল কমার্স (সংশোধিত) নীতিমালা ২০২০ ও নির্দেশিকা অনুযায়ী, ক্ষতিপূরণ বা অর্থ ফেরত পেতে হলে প্রচলিত আইনের দীর্ঘসূত্রতা মেনেই আদালতে যেতে হবে গ্রাহককে। ফলে অতীতের ডেসটিনি, যুবকের ঘটনার মতোই ঝুলে যাবে ইভ্যালির পাওনা আদায়ের ইস্যুটিও। ‘সর্ষের ভেতরে ভূত’ থাকায় দেশে একের পর এক এ জাতীয় ঘটনা ঘটছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

দেশে গত কয়েক বছর ধরে অনলাইনে পণ্য কেনাকাটা বা ই-কমার্স ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তবে এরই মধ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগও ওঠে। ফলে গোটা খাতটি এখন আস্থার সংকটে ভুগছে। অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহকদের আকর্ষণ করতে প্রথমে অস্বাভাবিক সব অফার দেয়। যে কারণে হুমড়ি খেয়ে পড়েন গ্রাহক। পরে দেখা যায়, টাকা পরিশোধ করেও মাসের পর মাস পণ্য পাচ্ছেন না তারা। বেশ কয়েকটি প্রতারণার ঘটার পর দেশের ই-কমার্স খাতে ‘জাতীয় ডিজিটাল কমার্স নীতিমালা (সংশোধিত) ২০২০ ও এর আলোকে গত ৪ জুলাই একটি নির্দেশিকা জারি করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তবে এতেও গ্রাহক স্বার্থ সঠিকভাবে সংরক্ষিত হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। নির্দেশিকার বাস্তবায়নও এখন পর্যন্ত কাগজে-কলমে রয়ে গেছে।

ডিজিটাল কমার্স পরিচালনার ওই নির্দেশিকার ৩-২-৯ ও ৩-২-১০ অনুচ্ছেদ বলা হয়েছে, পণ্যের হালনাগাদ মজুত বা ‘স্টক’ ক্রেতাকে জানাতে হবে। স্টকে নেই এমন পণ্যের জন্য অগ্রিম টাকা নেয়া যাবে না। দেশে ‘রেডি টু শিপ’ অবস্থায় থাকা পণ্য, যা ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সরবরাহ করা সম্ভব হবে না- এমন পণ্যের জন্য ১০ শতাংশের বেশি অগ্রিম নেয়া যাবে না। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদিত ‘এসক্রো’ সেবার মাধ্যমে পণ্যের ১০০ ভাগ অগ্রিম মূল্য নেয়া যাবে। যদিও ই-ভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, বুমবুমসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা নেয়ার ক্ষেত্রে এসব নিয়মের কিছুই মানেনি। নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেয়নি দীর্ঘদিন।

নির্দেশিকার ৩ দশমিক ৪ ‘অভিযোগ ও প্রতিকার’ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, এসব বিধিবিধান প্রতিপালনে ব্যর্থ হলে সরকার ওই বিক্রেতা বা মার্কেটপ্লেসের ট্রেড লাইসেন্স, কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন, ভ্যাট নিবন্ধন ইত্যাদি বাতিল করতে বা যথাযথ প্রতিষ্ঠানকে ব্যবস্থা নিতে বলতে পারবে। তবে ক্ষতিগ্রস্তদের অর্থ আদায়ে সরকার নিজ উদ্যোগে কোনো ব্যবস্থা নেবে কিনা- সেটি বলা হয়নি এতে। শুধু বলা হয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি, ক্রেতা বা সরকারি-বেসরকারি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট আদালতে অভিযোগ দায়ের করতে পারবে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মুনীরুজ্জামান এ প্রসঙ্গে বলেন, গ্রাহক প্রতারিত হওয়ার পর টাকা ফেরত পাওয়া ও ক্ষতিপূরণের বিষয়টি সামনে চলে আসে। কিন্তু এটি দীর্ঘ একটি আইনি প্রক্রিয়া। যদি শুরুতেই বিষয়গুলোর ওপর সরকারি যথেষ্ট নজরদারি থাকে, তবে বাজার থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিতে পারবে না কেউ। কিন্তু এই নজরদারির দায়িত্বে কাউকে দেখা যায়নি। তিনি বলেন, আসলে প্রতারকরা এ সুযোগটিই কাজে লাগাতে চায়। তারা জানে, সব গ্রাহক মামলা মোকদ্দমায় যেতে আগ্রহী হবেন না। যদি কিছুদিন প্রতারণা করা যায়, তবে বিশাল অঙ্ক নিতে বাজার থেকে উধাও হতে পারবে তারা। অনেকে ধরা পড়লেও দেখা যায়, যে পরিমাণ অর্থ তারা হাতিয়ে নিয়েছে; সে তুলনায় কিছুদিন জেল খাটা তারা লাভজনক বলে মনে করে।

তবে বিষয়টি নজরদারি করা হয় বলেই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে দাবি করেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা-ডব্লিউটিও সেলের মহাপরিচালক ও কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেলের আহ্বায়ক হাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, এটা ঠিক যে প্রতিকার পেতে আইনি প্রক্রিয়ায় আসতে হবে। তাই আমরা গ্রাহকদের বলব তারা যেন ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ দায়ের করেন বা ভোক্তা অধিকার আইনে মামলা করেন। আর যেসব মার্চেন্ট আছেন তারা যেন ব্যবসায়িক চুক্তি ভঙের অভিযোগ এনে প্রচলিত আইনে আদালতে মামলা দায়ের করেন। আগে কেন ব্যবস্থা নেয়া হলো না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা ধারণা করতে পারেনি যে এর মাধ্যমে দুর্নীতি, প্রতারণা, অস্বচ্ছতার আশ্রয় নেয়া হবে। যদি ব্যবসার শুরুতেই কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করতাম, তবে ব্যবসার প্রসার থেমে যেত। কারণ, ডিসকাউন্ট অফার দেয়া তো অবৈধ নয়।

গত বছর জুলাইয়ে একটি প্রতিষ্ঠানের অভিযোগ তদন্তের কথা জানিয়ে হাফিজুর রহমান আরো বলেন, বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, দুর্নীতি দমন কমিশন, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ ৭ জায়গায় চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছিল। তখন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে তদন্ত প্রতিবেদনটি আবার খতিয়ে দেখার জন্য পাঠানো হলে প্রতিষ্ঠানটির আয়-ব্যয় ও সম্পদে মারাত্মক অসামঞ্জস্যতার বিষয়টি সামনে আসে। তখন আমরা কঠিন ব্যবস্থা নেই। তিনি জানান, আমরা অভিযোগ নিষ্পত্তির বিষয়ে নীতিমালা করতে যাচ্ছি। একই সঙ্গে ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত করতে ই-ক্যাব এবং কমিটির সমন্বয়ে একটি ই-কমার্স অভিযোগ সেল গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে।

যদিও হাফিজুর রহমানের এমন বক্তব্যের সঙ্গে অনেক গ্রাহকই একমত হতে পারেননি। ইভ্যালি থেকে মোটরসাইকেল বুকিং দেয়া পুরান ঢাকার আরিফুল ইসলাম বলেন, ৬ মাস পরও বাইক পাননি তিনি। কিছুদিন পর তারা টেলিভিশনে এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হতে দেখেন। অনেক গ্রাহক ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন। কিন্তু এরপরও ইভ্যালির অফিসে গিয়ে দেখেন বুকিং চলছে। তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

রিয়াজ হোসেন নামে আরেক গ্রাহক জানান, তিনি জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ জমা দিয়েছেন অনেক আগে। এমন অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু অনেক পরে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাংক হিসাব তলব করা হয়। আসলে সর্ষের ভেতরেই ভূত রয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।

এদিকে ইভ্যালিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতারণায় ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে টেলি কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টিক্যাব)।

সংগঠনের আহ্বায়ক মুর্শিদুল হক বলেন, ইভ্যালির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রাসেলকে গ্রেপ্তারের কারণে এর গ্রাহকরা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হন সে বিষয়টি সরকারকে খেয়াল রাখতে হবে।

তিনি বলেন, এ প্রতিষ্ঠানে অর্থ আটকে থাকা গ্রাহকরা তাদের অর্থ ফেরত পাওয়া নিয়ে আতঙ্কিত। এর আগে গত ১৮ আগস্ট আরেকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জের মূল মালিক সোনিয়া মেহজাবিন ও তার স্বামী মাসুকুর রহমানকে আইনের আওতায় নেয়া হয়েছে। ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ তুলেছে গ্রাহকরা। একইভাবে আলেশা মার্ট, সিরাজগঞ্জ শপ, পেপারফ্লাইসহ বিভিন্ন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ তুলেছেন গ্রাহকরা। লোভনীয় অফার দিয়ে এবং আস্থাশীল ব্যক্তিদের দিয়ে বিজ্ঞাপন বানিয়ে জাতীয় গণমাধ্যমে প্রচারের মাধ্যমে সাধারণ গ্রাহকদের কাছে থেকে বিভিন্ন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু প্রতিকারের জায়গা এখনো নিশ্চিত করতে পারেনি সরকার।

এ খাতের বিকাশ নিশ্চিত করতে তিনি দ্রুত ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অধীন বিশেষ সেল গঠনের পরামর্শ দেন। যেখানে গ্রাহকদের অভিযোগ অনলাইনে নিয়ে অর্থ উদ্ধারের ব্যবস্থা করা হবে। এছাড়া ভবিষ্যতে যাতে গ্রাহকরা প্রতারিত না হয় সে জন্য সরকারের সঠিক ও নিয়মিত নজরদারির দাবি জানান তিনি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App