×

মুক্তচিন্তা

আইয়ুব খানের শাসনকাল

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০১:৫০ এএম

আইয়ুব খানের শাসনকাল
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সম্পাদিত সাহিত্য-সংস্কৃতির ত্রৈমাসিক ‘নতুন দিগন্ত’ পত্রিকার জুলাই-সেপ্টেম্বর (২০২১) সংখ্যায় ‘আইয়ুব খানের শাসনকাল’ শীর্ষক আমার একটি লেখা ছাপা হয়েছে। আমার লেখার ওপর ড. মোহাম্মদ হান্নানের ‘সুকৌশলে আজো আইয়ুব খানের বন্দনা’ শিরোনামে একটি লেখা গত ১৩ সেপ্টেম্বর ‘ভোরের কাগজ’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। লেখাটিতে আমার মূল লেখার বিভিন্ন জায়গা থেকে আগে ও পরের অংশ বাদ দিয়ে খণ্ডিতভাবে কিছু উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে। ১৯৬১ সালে আইয়ুব আমলে মুসলিম পারিবারিক আইনের কিছু সংশোধন করা হয়। মূলত আবুল হাশিমের প্রভাবে এই পরিবর্তন আনা হলেও এটি যে আইয়ুব আমলের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ সেটা অনস্বীকার্য। ধর্মীয় ব্যাপারে প্রথম দিকে আইয়ুবের কিছু উদারতা থাকলেও পরবর্তীতে তিনি যে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার করেন তাও আমার লেখায় উঠে এসেছে। তাছাড়া দুয়েকটি ইতিবাচক কাজ করলেই অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী একজন স্বৈরশাসক সমর্থনযোগ্য হন না। আমার লেখার বিভিন্ন স্থানে আইয়ুব খান সম্পর্কে যা লেখা হয়েছে তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ উদ্ধৃত করা হলো : ১. ‘আইয়ুব মনে করতেন সেনাবাহিনীর আধিপত্য নিরঙ্কুশ করার ক্ষেত্রে বাধা হচ্ছে রাজনীতিবিদগণ এবং বেসামরিক প্রশাসন। গণতন্ত্রকে পদদলিত করে দেশে উর্দিপরা সেনাশাসকদের শাসন কায়েমে ইস্কান্দার মির্জা এবং আইয়ুব যৌথভাবে কাজ করেন’ (পৃষ্ঠা : ৫৯)। ২. ‘আইয়ুব কতটা বেপরোয়া হয়ে ওঠেন যার প্রমাণ পাওয়া যায় পাকিস্তান স্টেট ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নরের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর কাছে লেখা তার একটি ঔদ্ধত্যপূর্ণ চিঠির ভাষা থেকে। তখন স্টেট ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন আবদুল কাদির। তিনি ছিলেন একজন দক্ষ ও দেশপ্রেমিক কর্মকর্তা। তিনি মুদ্রাস্ফীতি কমানোর জন্য সামরিক খাতে ব্যয় হ্রাসের প্রস্তাব করেন। আইয়ুব এর জবাবে ২৪ আগস্ট ১৯৫৮ সালে প্রধানমন্ত্রী ফিরোজ খান নুন বরাবর এক কড়া পত্র লেখেন। একজন সেনাপ্রধানের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে সরাসরি এভাবে পত্র লেখার নজির কোনো গণতান্ত্রিক এবং সভ্য দেশে নেই’ (পৃষ্ঠা : ৬১)। ৩. ‘দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক কাঠামো সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয়াই আইয়ুবের সামরিক সরকারের মূল উদ্দেশ্য ছিল’ (পৃষ্ঠা : ৬৪)। ৪. ‘মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থা ব্যাখ্যা করে এর পক্ষে জনমত গড়ে তোলার কাজে আইয়ুব তার মন্ত্রিসভার দুই গণবিরোধী সদস্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী মঞ্জুর কাদের এবং বাণিজ্যমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে নিয়োগ করেন’ (পৃষ্ঠা : ৬৬)। ৫. ১৯৬৫ সালের ২ জানুয়ারি ফাতেমা জিন্নাহ ও আইয়ুবের মধ্যে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সম্পর্কে আমার লেখায় বলা হয়েছে, ‘আইয়ুব তার প্রচারণায় সকল সরকারি সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করেন। নির্বাচনে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে বিডি মেম্বারদের ভোট ক্রয়ের জন্য ঘুষ দেয়ার অনেক অভিযোগ পাওয়া যায়’ (পৃষ্ঠা : ৭০)। ৬. “১৯৬৮ সালে আইয়ুব তার ক্ষমতারোহণের ১০ বছর পূর্তি উপলক্ষে দেশব্যাপী ‘উন্নয়ন দশক’ উদযাপন করার ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করে। এই দশকের মূল বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে রয়েছে জনগণের ভোটাধিকার হরণ, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ এবং রাজনৈতিক দমন পীড়ন” (পৃষ্ঠা : ৭২-৭৩)। ৭. ‘ইয়াহিয়া খান ছিলেন আইয়ুবের প্রিয়ভাজন, যদিও সেনাবাহিনীতে তিনি মদ্যপ ও নারীলিপ্সু হিসেবে পরিচিত ছিলেন। লে. জেনারেল আলতাফ কাদির এবং লে. জেনারেল বখতিয়ার রানা নামে দুজন সিনিয়রকে ডিঙিয়ে ১৯৬৬ সালের মার্চ মাসে আইয়ুব ইয়াহিয়াকে সেনাবাহিনী প্রধান পদে পদোন্নতি দেন। এর আগেই আইয়ুবের ব্যক্তিগত ইচ্ছায়ই তাকে লে. জেনারেল পদে উন্নীত করা হয়। নিজের হীন রাজনৈতিক স্বার্থে ইয়াহিয়ার মতো একজন নিকৃষ্ট ব্যক্তিকে সেনাপ্রধান নিযুক্ত করা ছিল একটি অমার্জনীয় অপরাধ’ (পৃষ্ঠা: ৭৯)। ৮. ‘আইয়ুব খান চরম পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অনুসরণ করেন। ফলে সৃষ্টি হয় ২২টি পরিবার, যারা ছিল পাকিস্তানের সমস্ত শিল্প-কারখানার শতকরা ৬৫ ভাগ এবং ব্যাংকের শতকরা ৭৫ ভাগ মালিক’ (পৃষ্ঠা : ৮১)। ৯. ‘আইয়ুবের আমলে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার বৈষম্য প্রকটভাবে দৃষ্টিগোচর হয়। পূর্ব পাকিস্তানে বেশ কিছু মিল-কারখানা স্থাপন এবং অবকাঠামোগত কিছু উন্নয়ন হলেও পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় তা ছিল অনুল্লেখযোগ্য। আইয়ুব আমলে দুটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ঘোষণা করা হয়, দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৬০-১৯৬৫) এবং তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৬৫-১৯৭০)। দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় মোট উন্নয়ন ব্যয়ের মাত্র ৩১ শতাংশ এবং তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় মাত্র ৩৬ শতাংশ পূর্ব-পাকিস্তানে ব্যয় করা হয়’ (পৃষ্ঠা : ৮১)। ১০. ‘মোট বাজেটের ৪.৮ শতাংশ সামরিক খাতে বরাদ্দ করা হতো। আশ্চর্যের বিষয় এর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে ব্যয় করা হতো ০.১ শতাংশ। পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল ৫৬ শতাংশ। সশস্ত্র বাহিনীতে পূর্ব পাকিস্তানিদের সংখ্যা ছিল মাত্র ১০ শতাংশ, বেসামরিক চাকরিতে ২০ শতাংশ এবং বৈদেশিক চাকরিতে ১৫ শতাংশ। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে পাঞ্জাবের জনসংখ্যা ছিল মাত্র ২৯ শতাংশ। কিন্তু ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সচিবালয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ৬৯ জন শীর্ষ কর্মকর্তার মধ্যে পাঞ্জাবি ছিলেন ৪৫ জন এবং বাঙালি মাত্র ৩ জন। আইয়ুব খানের আমলের শেষ দিকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় বাঙালিদের প্রতিনিধিত্ব ছিল মাত্র ৩৫ ভাগ। আর এই পূর্ব পাকিস্তানি মন্ত্রীদের অধিকাংশ ছিলেন পাঞ্জাবিদের চেয়েও অধিক বাঙালিবিরোধী’ (পৃষ্ঠা : ৮১-৮২)। ১১. মোনায়েম খানের মাসমধ্য বেতার ভাষণ না শুনলেও আইয়ুবের মাস পহেলা বেতার ভাষণ লোকে শুনতো, এটা আমি আমার স্কুল জীবনে দেখেছি। এ প্রসঙ্গে আমি লিখেছি, ‘তাঁর রাজনীতিকে সমর্থন না করলেও মানুষ আইয়ুবের মাস পহেলা বেতার ভাষণ শুনতো’ (পৃষ্ঠা : ৮৬)। ১২. রাজনৈতিকভাবে কেউ আইয়ুবকে সমর্থন করতেন না, এখানে তাই বলা হয়েছে। ‘রাজনৈতিক দল করতে গিয়ে, বিশেষ করে ১৯৬৫ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময়ে আইয়ুব ধর্মকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেন। নির্বাচনে ফাতেমা জিন্নাহ প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হলে আইয়ুব একশ্রেণির সুবিধাবাদী আলেম ও পীরদের দ্বারা ফতোয়া জারি করান যে, ইসলামে নারী নেতৃত্ব জায়েজ নয়’ (পৃষ্ঠা : ৮৭)। ১৩. ‘আইয়ুব খান একটি শক্তিশালী মুসলিম রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখতেন। তিনি মনে করতেন শক্তিশালী রাষ্ট্রের জন্য শক্তিশালী সেনাবাহিনী প্রয়োজন। তাঁর মতে শক্তিশালী সেনাবাহিনী না থাকাতেই মোগল সাম্রাজ্যের পতন হয়। কিন্তু জনগণের সমর্থন না থাকলে সেনাবাহিনী যে কোনো কাজে আসে না, আইয়ুবের উপলব্ধির মধ্যে সেটা ছিল না। সামরিক শক্তিনির্ভর শক্তিশালী রাষ্ট্র কায়েম করতে গিয়ে তিনি প্রকারান্তরে একটি ভঙ্গুর রাষ্ট্র কায়েমে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করেছেন। পাকিস্তানের প্রেক্ষাপটে তিনি হয়তো একজন দেশপ্রেমিক পাকিস্তানি ছিলেন; কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্র ধ্বংসের বীজ তিনিই রোপণ করেছিলেন ইস্কান্দার মির্জা ও পাঞ্জাবি জেনারেলদের সঙ্গে মিলে গণতন্ত্রকে নির্বাসন দিয়ে এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি চরম বৈষম্যমূলক আচরণ করে। এজন্য ইতিহাসের কাঠগড়ায় তাঁকে আসামি হিসেবেই দাঁড়াতে হবে’ (পৃষ্ঠা : ৯০-৯১)। এখানে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে আইয়ুবের পেছনে ‘জনগণের কোনো সমর্থন ছিল না’ এবং ‘গণতন্ত্রকে নির্বাসন’ দেয়ার ও ‘তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি চরম বৈষম্যমূলক আচরণ’ এর জন্য দায়ী প্রধান ব্যক্তি হচ্ছেন আইয়ুব খান। ড. মোহাম্মদ হান্নান ‘স্বাধীনতার ৫০ বছর, শত ঘটনার শত কাহিনী’ শীর্ষক একটি বই লিখেছেন। বইটি তিনি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বদরুদ্দীন উমর এবং মুনতাসীর মামুনকে উৎসর্গ করেছেন। ওই বইতে এবং ‘ভোরের কাগজ’-এর লেখাতেও মওলানা ভাসানী সম্পর্কে চরম মিথ্যাচার করে ইতিহাসের বিকৃতি করেছেন। ভাসানীই প্রথম ব্যক্তি যিনি পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের প্রথম প্রত্যাখ্যানের প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়েছিলেন, ১৯৫৭ সালের কাগমারী সম্মেলনে। ড. হান্নান ইতিহাস নিশ্চয় পরিবর্তন করতে পারবেন না, তবে কেন এসব মিথ্যাচার? বদরুদ্দীন উমরের পিতা আবুল হাশিম একবার আইয়ুব খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সে সময় বদরুদ্দীন উমর আবুল হাশিমের সঙ্গে ছিলেন। এই সাক্ষাৎকারের বর্ণনা দিয়ে বদরুদ্দীন উমর তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘আইয়ুব খান যে একজন ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন ও বুদ্ধিমান ব্যক্তি এটা আমার মনে হলো। তাছাড়া তাঁর যে কিছু পড়াশোনা ছিল এটাও তাঁর কথাবার্তায় বোঝার অসুবিধে ছিল না। তিনি একজন বাঙালি বিদ্বেষী ও ডিক্টেটর ইত্যাদি এ নিয়ে তো কোনো সংশয় ছিল না। কিন্তু মোনায়েম খানের মতো বাঙালির থেকে যে তিনি অনেক বড় মাপের লোক ছিলেন তাতে সন্দেহ নেই। তিনি একজন নির্যাতক হলেও তাঁর কাণ্ডজ্ঞানের অভাব ছিল না, এজন্য তিনি নির্বোধের মতো কিছু করতেন না’ (পৃষ্ঠা : ২৫২, বদরুদ্দীন উমর, আমার জীবন ২য় খণ্ড, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, ২০১৪)। আমি আইয়ুব খানকে কখনোই বড় মাপের মানুষ মনে করি না। ‘নতুন দিগন্ত’-এ প্রকাশিত আমার লেখার শেষ লাইনে আমি ইতিহাসের কাঠগড়ায় আইয়ুব খানকে ‘আসামী’ হিসেবেই দাঁড় করিয়েছি। সৈয়দ জিয়াউল হক : লেখক ও গবেষক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App