সুকৌশলে আজো আইয়ুব খানের বন্দনা
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০১:১০ এএম
জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করে পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করেছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানে বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানেও তিনি কিছু লোকের কাছে খুব ‘জনপ্রিয়’ ছিলেন। আসলে আইয়ুব খানের সামরিক গোয়েন্দারা ছিল খুব চৌকস। তারাই আইয়ুব খানের একটা ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছিল। এ প্রকল্পে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিকদের বিশেষ করে চীনপন্থি ন্যাপ ও কমিউনিস্টদের তারা ভালোভাবেই কিনে নিয়েছিল। সারা পাকিস্তানের রাজনীতিকরা যখন আইয়ুবের বিরুদ্ধে একাট্টা, তখন মওলানা ভাসানী ইসলামাবাদে আইয়ুব খানের সঙ্গে বৈঠক করেন। মশিউর রহমান জাদু মিয়া (ভাসানী ন্যাপের নেতা) এ সময় উপস্থিত ছিলেন। [এ তথ্যটা আমি পেলাম সৈয়দ আবুল মকসুদ লিখিত মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী গ্রন্থে। গ্রন্থটি আগামী প্রকাশনী থেকে ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। পৃষ্ঠা ২৫৬] তারা সবসময়ই কৌশলে আইয়ুব খানের জয়গান করেছেন। আবদুল হামিদ খান ভাসানী প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের প্রতিনিধি হয়ে চীন দেশও সফর করেন। সেখানে কমরেড মাও সেতুং মওলানা ভাসানীকে তার চিরাচরিত ইসলামি পোশাক পরিবর্তন করে মাও সেতুং-এর প্যান্ট-শার্ট পরিয়ে দিয়েছিলেন। মওলানা ভাসানী এ নতুন পোশাক পরে একটা ছবিও তুলেছিলেন। সৈয়দ আবুল মকসুদ তার লেখা মাওলানা ভাসানী গ্রন্থে তা ছেপে দিয়েছেন। [দেখতে পারেন গ্রন্থটির ৬১১ পৃষ্ঠা]। মাও সেতুং মওলানা ভাসানীকে আইয়ুবের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে না করে দেন। সুযোগ পেয়ে আইয়ুব খান মওলানা ভাসানীকে ৬ দফা বিরোধী প্রচারণার সৈনিক বানান। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ৬ দফা দাবি পেশ করলে এর সবচেয়ে বেশি সমালোচনা করেন দুই মওলানা- একজন পশ্চিম পাকিস্তানের মাওলানা মওদুদী, অন্যজন পূর্ব পাকিস্তানের মওলানা ভাসানী। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের প্রাক্কালে মওলানা ভাসানী ছাত্রদের ১১ দফা সমর্থন করে বিবৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানান। গণঅভ্যুত্থানে শামিল হতে তিনি বাধ্য হন, যখন দেখেন শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে সারা পূর্ব পাকিস্তানে এক আওয়াজ, ‘জেলের তালা ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব।’ তিনি এবং তার দল আজীবন মুজিববিরোধী থাকলেও ঊনসত্তরে এসে মুজিবের মুক্তির জন্য জনতার সেøাগানকে কণ্ঠে ধারণ করেন, এছাড়া তাদের আর উপায় ছিল না। আইয়ুবের দালালি করার জন্য জনগণ তাদেরও ছেড়ে দিত না। প্রকৃতপক্ষে তারা কখনো আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে ছিল না। তাদের সমস্যা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খানকে নিয়ে। তারা মনে করত, জেনারেল আইয়ুব ভালোই, দোষ হলো মোনায়েম খানের। ষাটের দশকে তারা আইয়ুব খানকে দিয়ে সমাজতন্ত্র কায়েমের চিন্তা করতেন। তাদের পতাকাগুলোতে তখন লেখা হতো, পাকিস্তানে দুজন কমরেডই আছেন, একজন কমরেড আইয়ুব খান অন্যজন কমরেড ভাসানী। তাই কৌশলে তারা আইয়ুব খানের উন্নয়নের ফিরিস্তি তুলে ধরতেন। কিন্তু আইয়ুবকে তারা রক্ষা করতে পারেননি। আইয়ুবের কবরের ওপরে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু এ লোকগুলো এখনো আইয়ুব খানকে ভুলতে পারেনি। সম্প্রতি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সম্পাদিত নতুন দিগন্ত জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০২১ সংখ্যা হাতে আসল। সেখানে সৈয়দ জিয়াউল হক লিখেছেন, ‘আইয়ুব খানের শাসনকাল’ নামে একটি প্রবন্ধ। প্রবন্ধটিতে আইয়ুব খানের সামান্য সমালোচনা আছে, এটা একটা কৌশল। কিন্তু ভেতরে ভেতরে যে কথাগুলো পাঠককে গেলানোর চেষ্টা করা হয়েছে, তার একটি সংক্ষিপ্তসার দেখুন : ১. ‘তিনি (জেনারেল আইয়ুব খান -লেখক) পাকিস্তানের লৌহমানব হিসেবে খ্যাত ছিলেন’। ২. ‘তার মতে (আইয়ুব খানের মতে -লেখক) রাজনীতিবিদরা দুর্নীতিবাজ এবং দেশ চালানোর অযোগ্য’। ৩. ‘আয়ুবের ক্ষমতা গ্রহণের পর দেশের কোথাও কোনোরূপ প্রতিবাদের ঘটনা ঘটেনি’। ৪. ‘এতে কোনো সন্দেহ নেই আইয়ুব পাকিস্তানের অর্থনীতিকে একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে পেরেছিলেন’। ৫. ‘আইয়ুব যখন ক্ষমতা দখল করেন তখন ডলারের মূল্য ছিল ৪ টাকা। দশ বছর পর যখন তিনি ক্ষমতা ত্যাগ করেন তখনো ডলারের মূল্য প্রায় অপরিবর্তিত (৪.৭৬ টাকা) ছিল’। ৫. ‘পুঁজিবাজারের আকার কয়েক গুণ বৃদ্ধি পায়’। ৬. ‘ব্যাংকিং খাতে কোনো নৈরাজ্য ও লুটপাট ছিল না’। ৭. ‘রেল যোগাযোগের ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়’। ৮. ‘পিআইএ বিশ্বের অন্যতম সেরা বিমান সার্ভিস হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে’। ৯. ‘পূর্ব পাকিস্তানে বেশকিছু মিলকারখানা স্থাপন এবং অবকাঠামোগত কিছু উন্নয়ন হলেও পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় তা ছিল অনুল্লেখযোগ্য’। ১০. ‘আইয়ুবের মাস পয়লা বেতার ভাষণ ছিল সুলিখিত এবং তার বলার ভঙ্গিও ছিল আকর্ষণীয়’। ১১. ‘মানুষ আইয়ুবের মাস পয়লা ভাষণ শুনত’। ১২. ‘ধর্মীয় ক্ষেত্রে আইয়ুবের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল বেশ আধুনিক’। ১৩. ‘তিনি ধর্মের সঙ্গে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চাকে গুরুত্ব দিতেন’। ১৩. ‘মুসলিম পারিবারিক আইনে আইয়ুব যে সংস্কার আনেন তাকে যুগান্তকারীই বলা যায়’। ১৪. ‘প্রশাসক হিসেবে আইয়ুব দক্ষ ছিলেন’। ১৫. ‘তার আমলে গৃহীত বিভিন্ন পরিকল্পনা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় সেগুলোর পেছনে দূরদর্শিতা আছে’। ১৬. ‘আইয়ুব খানের শাসনামলে সব অফিস আদালতে সাপ্তাহিক ছুটি ছিল রবিবার, জুমার নামাজের অজুহাতে শুক্রবার নয়’। ১৭. ‘আইয়ুব খানের আমলে শিক্ষা ব্যবস্থা অনেকটাই ধর্মনিরপেক্ষ ছিল’। ১৮. ‘পাঠ্যপুস্তকের মানও ছিল উন্নত। দেশের বরেণ্য শিক্ষাবিদদের দ্বারা পাঠ্যসূচি প্রণয়ন করা হতো’। ১৯. ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকরা ছিলেন অত্যন্ত যোগ্য’। ২০. ‘যে গুটিকয়েক শিক্ষক সরকারের সমর্থক হিসেবে পরিচিত ছিলেন শিক্ষক হিসেবে তাদেরও জ্ঞান ও পাণ্ডিত্য ছিল প্রশ্নাতীত’। ২১. ‘আইয়ুব খান একটি শক্তিশালী মুসলিম রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখতেন’। ২২. ‘তিনি মনে করতেন শক্তিশালী রাষ্ট্রের জন্য শক্তিশালী সেনাবাহিনী প্রয়োজন’। [দেখুন, সৈয়দ জিয়াউল হক : ‘আইয়ুব খানের শাসনকাল’, নতুন দিগন্ত, জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০২১, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সম্পাদিত, ঢাকা, পৃষ্ঠা ৫৮-৯১]। এভাবে নানা কথার আড়ালে-আবডালে আইয়ুব খানের বন্দনা করা হয়েছে, যাতে তার একটা ভাবমূর্তি গড়ে তোলা যায়। প্রকৃতপক্ষে তা পাকিস্তান বন্দনারই নামান্তর। এসব লোক পাকিস্তান আমলেও নানাভাবে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের গুণকীর্তন করতেন। তারা বলতেন, পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়ন হয়েছে, এবার পূর্বপাকিস্তানের উন্নয়ন হবে। শুধু তারাই নন, বাংলাদেশে আইয়ুব বন্দনার ছলে পাকিস্তানের গুণকীর্তন খুব গোপনভাবে কথার মারপ্যাঁচ করে আরো অনেকেই করে চলেছেন। সৈয়দ আবুল মকসুদও দীর্ঘদিন পাকিস্তান আমল থেকেই চীনাপন্থি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তার লেখা বৃহৎ গ্রন্থ ‘মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী’তেও তিনি লিখেছেন, ‘তার সময়ই (আইয়ুব খানের সময়ই- লেখক) পূর্ব পাকিস্তানে উন্নয়নমূলক কিছু কাজ হয়’ [দেখুন, সৈয়দ আবুল মকসুদ : মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, আগামী প্রকাশনী, ২০১৪ মুদ্রণ, ঢাকা, পৃষ্ঠা ২৫৩]। সৈয়দ আবুল মকসুদ আরো লিখেছেন, ‘ভাসানী আইয়ুবের পররাষ্ট্রনীতিকে কিছুদিন সমর্থন দিয়েছেন।’ কারণ কী, কারণ হলো, আইয়ুবের পররাষ্ট্রনীতি ‘প্রগতিশীল’ ছিল। [দেখুন, সৈয়দ আবুল মকসুদ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৬৪]। জেনারেল আইয়ুব খানকে নিয়ে এভাবে স্বাধীন বাংলাদেশে বন্দনা-গীত রচিত হবে কোনো পাকিস্তানিই এটা বিশ্বাস করবে না। কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্য, এটা এখন বাংলাদেশে হচ্ছে। ইনিয়ে-বিনিয়ে তারা বারবার এটাই বলতে চায়, পাকিস্তান রাষ্ট্রটা ভালোই ছিল, ছোটখাটো কিছু ভুল হয়েছে এই যা। এরা আবার বাংলাদেশের সফলতা দেখাতে পরাক্সমুখ, আর ব্যর্থরাষ্ট্র প্রমাণ করতে অতিশয় সক্রিয়। ‘আইয়ুব লৌহমানব’- এটা দ্বারা পাকিস্তান আমলে প্রচার করত- আইয়ুবের চররাই। ‘আইয়ুব ক্ষমতা গ্রহণের পর দেশের কোথাও কোনোরূপ প্রতিবাদের ঘটনা ঘটেনি।’ এ মন্তব্য প্রকৃত সত্য নয়, ন্যাপ নেতা আবদুল বারিকে নির্যাতন করে পাকিস্তানের মিলিটারিরা বধির করে দিয়েছিল, প্রতিবাদ মিছিল বের করার অপরাধেই। ‘আইয়ুব পাকিস্তানের অর্থনীতিকে একটা শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে পেরেছিলেন’- কথাটা সত্যি, তবে ‘পাকিস্তান’ শব্দটার আগে একটা ‘পশ্চিম’ শব্দ যুক্ত করতে হবে অর্থাৎ পাকিস্তান নয়, পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতিকে তিনি মজবুত করেছিলেন। আইয়ুবের শাসনামলে পূর্ব পাকিস্তান জ¦লছিল বৈষম্যের আগুনে। ‘আইয়ুবের বলা ভঙ্গি ছিল আকর্ষণীয়’- তবে সেটা একমাত্র চাটুকারদের কাছে। এবং চাটুকার শ্রেণির লোকেরাই একজন ‘ডিটেকটর’কে আকর্ষণীয় বলতে পারে। ‘প্রশাসক হিসেবে আইয়ুব দক্ষ ছিলেন’- তা তো বটেই, তা না হলে দীর্ঘ দশ বছর কী করে তিনি ‘স্টিম রোলার’ চালিয়ে ক্ষমতার মসনদে ছিলেন! ‘আইয়ুব মনে করতেন শক্তিশালী রাষ্ট্রের জন্য শক্তিশালী সেনাবাহিনী প্রয়োজন’- আর সেজন্যই বাংলাদেশেও তারা ১৯৭৫ থেকে সেনাশাসনকে সমর্থন জানিয়ে আসছেন। হায়! কী বিচিত্র এ দেশ!
ড. মোহাম্মদ হাননান : ইতিহাসবিদ ও গবেষক।