×

শিক্ষা

শিক্ষাঙ্গনে জেগেছে প্রাণের স্পন্দন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৯:০০ এএম

শিক্ষাঙ্গনে জেগেছে প্রাণের স্পন্দন

শিক্ষার্থী

কোনো উৎসব নয়; তবুও উৎসবের আবহ! পরনে প্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত পোশাক, পিঠে ব্যাগ। অবয়বে খুশির ঝিলিক। কোলাহলে মুখরিত আঙিনা। দেড় বছর পর দেশের স্কুল-কলেজগুলোতে দেখা গেল এমন দৃশ্য। শিক্ষার্থী-শিক্ষক সবাইকেই ছুঁয়েছে প্রথমদিন ক্লাসে যাওয়ার আনন্দ। তবে উদ্বেগও ছিল।

মহামারিকালে জনসমাগমে যাওয়ার উদ্বেগ। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দেখা গেছে প্রস্তুতির ঘাটতি- ঠিকমতো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন বা মেরামত করা হয়নি। আবার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কঠোর নির্দেশনা থাকলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা মানা হয়নি। শহরের বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শ্রেণিকক্ষে মাস্ক পরে, দূরত্ব বজায় রেখে বসতে দেখা গেলেও বাইরে ছিল অভিভাবকদের জটলা। অন্যদিকে গ্রামীণ স্কুলগুলোতে স্বাস্থ্যবিধির কোনো বালাই ছিলই না।

দেশে প্রথম করোনা শনাক্ত হয় গত বছরের ৮ মার্চ। ওই বছরের ১৮ মার্চ থেকেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ ঘোষণা করা হয়। টানা ৫৪৪ দিন বন্ধ থাকার পর গতকাল রবিবার সকাল থেকে প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীরা পা রেখেছে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। তাই শিক্ষার্থীদের বরণ করে নিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আয়োজনের কমতি ছিল না। একই সঙ্গে দেশের বিভিন্ন এলাকা বন্যাকবলিত হওয়ায় চারশর কিছু বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গতকাল চালু হয়নি। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের পড়–য়াদের বিদ্যালয়ে ফেরার আনন্দ স্পর্শ করেনি।

প্রথমদিনে কয়েকটি স্কুল সরজমিন দেখার সময় কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, দীর্ঘদিন পর স্কুলে আসার পর তাদের মনে হয়েছে প্রথম স্কুলে আসার দিন যেরকম অনুভূতি হয়েছিল, আজ তাদের সেরকম অনুভূতি হচ্ছে। অনেক দিন পর সহপাঠীদের সঙ্গে দেখা হওয়ায় বেশ আনন্দ লাগছে। বহুদিন পর সহপাঠী ও শিক্ষকদের পেয়ে তারা খুব খুশি। স্কুলের বাইরেই হয়ে যায় এক দফা কুশল বিনিময়। স্কুল গেটে তাপমাত্রা মেপে আর হাতে স্যানিটাইজার ছিটিয়ে তারপর যেতে হয়েছে শ্রেণিকক্ষে। দীর্ঘদিন পর শিক্ষার্থীদের পেয়ে খুশি শিক্ষকরাও।

স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত : স্কুল গেটে অভিভাবকদের জটলা ভাবাচ্ছে শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মকর্তাদের। কিন্তু তাদের স্কুলের ভেতরে ঢুকতে দেয়া হয়নি। সকালে স্কুলে শিশুদের পৌঁছে দেয়ার পরও অনেক অভিভাবককে নগরীর স্কুলগুলোর বাইরে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে, যা নিয়ে চিন্তিত শিক্ষকরা।

সেই আগের মতো মূল ফটকের সামনে দলবদ্ধভাবে তাদের বসে থাকতে দেখা গেছে। শুধু অভিভাবকদের নয়, অনেক শিক্ষার্থীকেই স্বাস্থ্যবিধি মানতে দেখা যায়নি। জটলা করে গল্প-আড্ডায় স্বাস্থ্যবিধির কথা ভুলেই যায় তারা। তাপমাত্র মেপে স্কুলে প্রবেশ, মাস্ক পরে ক্লাসে ঢোকা, দূরত্ব মেনে ক্লাসে বসানো হলেও ক্লাসের বাইরের পরিবেশ ভিন্ন। দীর্ঘদিন পর বন্ধুদের পেয়ে শিক্ষার্থীদের আনন্দের শেষ ছিল না। একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে তারা। মাস্ক খুলে দেখেছে চেহারা। লাইন ধরে স্কুলে প্রবেশ করলেও শিক্ষার্থীদের মধ্যে দূরত্ব ছিল খুবই কম। স্কুলের বাইরে অভিভাবকদের ভিড় না করতে বারবার বলা হলেও তারা খুব একটা আমলে নেননি। পরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও বলেছে, শিক্ষার্থী, অভিভাবকদের এই জটলা সংক্রমণকে প্রভাবিত করতে পারে।

জটলা প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি অভিভাবকদের স্বাস্থ্যবিধি মানার আহ্বান জানিয়ে বলেন, আপনারা শিক্ষার্থীদের স্কুলে নিয়ে এসে সম্ভব হলে বাসায় চলে যাবেন। অথবা সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে বিদ্যালয়ের বাইরে অপেক্ষা করবেন।

স্কুল দর্শনে দুই মন্ত্রী : শিক্ষার্থীদের জন্য স্কুলগুলোকে কতটা স্বাস্থ্যসম্মত করে প্রস্তুত করা হয়েছে তা সরজমিন দেখতে ঢাকার বেশ কয়েকটি স্কুলে যান শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন। পরিদর্শনে গিয়ে অপরিচ্ছন্নতা চোখে পড়লেই প্রতিষ্ঠান প্রধানের ভাগ্যে জুটছে শাস্তি বা তিরস্কার। গতকাল রবিবার দুপুরে কলাবাগান লেক সার্কাস স্কুলে পরিদর্শনে যান শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। এ সময় স্কুলের বিভিন্ন কোন ও স্টোররুম পরিদর্শন করেন তিনি। ময়লা-অপরিচ্ছন্ন থাকায় স্কুল কর্তৃপক্ষকে তিরস্কার করেন মন্ত্রী। এদিকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার প্রথম দিনে রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও সেগুনবাগিচা আইডিয়াল মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম সরজমিন দেখে আসেন। প্রতিমন্ত্রী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় সন্তোষ প্রকাশ করে আরো বেশি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতি নির্দেশ দেন।

স্টোররুমকে শ্রেণিকক্ষ ভেবে অধ্যক্ষ ও শিক্ষা কর্মকর্তাকে শোকজ না বরখাস্ত? : করোনা মহামারির মধ্যে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরার দিন শ্রেণিকক্ষে ময়লা পাওয়ায় আজিমপুর গার্লস স্কুল ও কলেজ পরিদর্শনে গিয়ে প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ হাসিবুর রহমানকে বরখাস্তের নির্দেশ দেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। একই সঙ্গে তদারকির দায়িত্বে থাকা মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) কর্মকর্তা সেলিনা হোসেনকেও একই শাস্তির আওতায় আনা হয়। কিন্তু দিনশেষে মন্ত্রণালয় এবং অধিদপ্তর থেকে জানানো হয়, বরখাস্ত নয়, শোকজ করা হয়েছে তাদের। গতকাল সন্ধ্যায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের (মাউশি) সচিব মো. মাহবুব হোসেন ভোরের কাগজকে বলেছেন, মাউশি মহাপরিচালকের উদ্ধৃতি দিয়ে তাদের শোকজ করা হয়েছে। কিন্তু শিক্ষামন্ত্রী বরখাস্তের নির্দেশ দিয়েছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি খবর নিয়ে জানাচ্ছি। কিন্তু এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত (রাত ৮টা) সচিবের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা যায়নি।

মাউশি সূত্র জানিয়েছে, আজিমপুর গভর্নমেন্ট স্কুল এন্ড কলেজের একটি স্টোররুমকে শ্রেণিকক্ষ ভেবে অধ্যক্ষকে শোকজ করা হয়। সরজমিন দেখা যায়, তিনতলা স্কুল ভবনটির নিচতলায় কোনো শ্রেণিকক্ষ নেই। যে কক্ষে শিক্ষামন্ত্রী ময়লা পেয়েছেন, সেটি একটি স্টোররুম। রুমের এক পাশে গ্যাসের চুলা, খাট, বেসিন রয়েছে। এ বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ গোলাম ফারুক বলেন, আমরা তাদের শোকজ করেছি। তিন দিনের মধ্যে জবাব দিতে বলেছি। তারপর সিদ্ধান্ত নেব। এ বিষয়ে কলেজ অধ্যক্ষ হাসিবুর রহমান বলেন, রুমটি আমাদের স্টোররুম ছিল। সেখানে ক্লাস করানো হয় না। রুমটা খোলা থাকায় মন্ত্রী মহোদয় সেখানে ঢুকে পড়েন। তবে সিদ্ধান্তের বিষয়ে আমি এখনো জানি না। অফিসিয়ালি আমাকে কিছু জানানো হয়নি।

এর আগে সকালে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যবিধির ক্ষেত্রে অবহেলা পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। স্কুলে প্রথম আসার মতো আনন্দ : দীর্ঘ ৫৪৩ দিন পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলায় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অনেকে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। সে সময় শিক্ষকদের আনন্দের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের বরণ করে নিতে দেখা গেছে। রাজধানীর কয়েকটি স্কুলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করতে দেখা গেছে। সকাল সাড়ে ৭টার দিকে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী জারিন তাসনীম মৃধাকে রাজধানীর আজিমপুর থেকে ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল এন্ড কলেজে নিয়ে আসেন তার মা রাজিয়া সুলতানা। রাজিয়া সুলতানা বলেন, অনেক দিন পর মেয়েকে স্কুলে নিয়ে আসতে পারায় খুব ভালো লাগছে। দীর্ঘদিন বাসায় থেকে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিল। আগে স্কুলে যখন মেয়েকে নিয়ে আসতাম, আর আজকে যে নিয়ে আসলাম এর মধ্যে অনেক পার্থক্য দেখতে পাচ্ছি। রূপনগরের মনিপুর স্কুল এন্ড কলেজে গিয়ে দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের জন্য স্কুলটি রঙিন কাগজ আর বেলুনে সাজানো হয়। লাইন ধরে শিক্ষার্থীরা তাপমাত্রা মেপে, হাত স্যানিটাইজ করে থার্মাল স্ক্রিনিং করে স্কুলে প্রবেশ করে। অনেকে আবার স্কুলের বাইরের ফুচকা-চটপটি, ঝালমুড়ির দোকানে ভিড় করে। আগের সেই পরিচিত পরিবেশ ফিরে পাওয়ায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে তারা। দশম শ্রেণির ৮-১০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে কয়েকজনকে মাস্ক খুলেই বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে দেখা যায়।

নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী রাকিবুল ইসলাম বলেন, নবম শ্রেণিতে ওঠার পর আজকেই প্রথম ক্লাসে এলাম। অনেকদিন পর শিক্ষক-সহপাঠীদের সঙ্গে দেখা হলো। আমি খুবই আনন্দিত। স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষকরা আমাদের বরণ করে নিয়েছেন। মিরপুরের কামাল আহমেদ মজুমদার স্কুল এন্ড কলেজে গিয়ে দেখা গেছে, স্কুলের গেটের বাইরে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী স্বাস্থ্যবিধি অবজ্ঞা করেছে। একসঙ্গে জড়ো হয়ে গল্প করতে দেখা গেছে। মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রীদের ক্লাস সকাল সাড়ে ৯টায় শুরু হয়ে শেষ হয়েছে ১১টায়। আর ছাত্রদের ক্লাস শুরু হয়েছে বেলা ১২টায়। দুটি পৃথক গেট দিয়ে আলাদাভাবে ছাত্রছাত্রীদের প্রবেশ করানো হয়। উদয়ন স্কুল এন্ড কলেজে সকাল ৮টা থেকে শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করানো হয়। স্কুল কর্তৃপক্ষকে স্কুলের প্রবেশপথে শিক্ষার্থীদের হাত পরিষ্কার করার পর তাদের চকলেট ও গোলাপ দিয়ে বরণ করে নিতে দেখা যায়। ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল এন্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সেলিনা আক্তার বলেন, শিক্ষার্থীদের বরণ করতে ক্লাসরুমগুলো সাজানো হয়েছে। শিক্ষার্থীদের মনে যেন করোনার ভয় না থাকে, সেজন্যে শিক্ষকরা প্রথম অনুপ্রেরণামূলক ক্লাস নেন।

চট্টগ্রামের ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী অমৃতা সেন বলেন, প্রতিদিন স্কুলে আসা একধরনের অভ্যাস ছিল। প্রায় পুরো দুইটা ক্লাস সেশন স্কুলে না এসে বাসায় বসে কাটিয়ে দিতে হয়েছে। নবম শ্রেণিটা তো আমরা আর ফেরত পাব না। দশম শ্রেণির সময়ও তো প্রায় শেষ। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে- দেড়টা বছর স্কুলে আসতে পারিনি। বাসায় অনেকটা বন্দি হয়ে ছিলাম। অনলাইন ক্লাসে তো আর সেভাবে স্কুলের আমেজ পাইনি। সেজন্য স্কুলে আসতে পেরে আমার খুব ভালো লাগছে। অনেকদিন পর বান্ধবীদের সঙ্গে দেখা হল। তবে একটা শঙ্কা কাজ করছে, যদি আবারো সংক্রমণ শুরু হয় তাহলে কি আবারো স্কুল বন্ধ হয়ে যাবে? আবারো কি আমাদের ঘরে বন্দি হয়ে থাকতে হবে?

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App