×

শিক্ষা

মুখস্থ বিদ্যা বাদ, আসছে ‘অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষা’

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৯:০৫ এএম

মুখস্থ বিদ্যা বাদ, আসছে ‘অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষা’

ফাইল ছবি

প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পাল্টে যাচ্ছে শিক্ষাক্রম। বিষয় ও পরীক্ষা কমানোর পাশাপাশি বইয়েও আনা হচ্ছে পরিবর্তন। ফলে সিলেবাসভিত্তিক মুখস্থ বিদ্যার চর্চাও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের ‘অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন ফল’ অর্জনের জন্য পড়াশোনা করতে হবে। অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখনের মধ্যে থাকছে- প্রকল্পভিত্তিক শিক্ষা, অ্যাসাইনমেন্ট ও গ্রুপভিত্তিক শিক্ষা। এছাড়া সমসাময়িক ঘটনার অংশ হিসেবে নতুন শিক্ষাক্রমে ঢুকছে ‘করোনা’ নামের অতিসংক্রামক রোগের আদ্যোপান্ত। দেশের বর্তমান শিক্ষাক্রম মূলত উদ্দেশ্যভিত্তিক। এখানে পরীক্ষার ওপর বেশি জোর দেয়া হয়েছে। কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রমে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে ধারাবাহিক মূল্যায়ন।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নতুন শিক্ষাক্রমের এসব বিষয় নিয়ে আজ সোমবার সকাল ১০টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে বসবে শিক্ষা প্রশাসন। বৈঠকে নতুন এই শিক্ষাক্রম উপস্থাপন করা হবে। প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন দিলে আগামী বছর প্রাথমিকের ১০০টি এবং মাধ্যমিক, কারিগরি ও দাখিল স্তরের ১০০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরীক্ষামূলকভাবে নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠদান শুরু হবে। এরপর ২০২৩ সালে গিয়ে এই দুটি শ্রেণির সব শিক্ষার্থীর হাতে নতুন শিক্ষাক্রমের বই তুলে দেয়া হবে।

প্রসঙ্গত, চলতি বছর থেকেই পর্যায়ক্রমে নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠদান শুরুর সিদ্ধান্ত ছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। এজন্য প্রস্তুতিও নেয়া হয়েছিল। করোনা সংক্রমণের কারণে শেষ পর্যন্ত সেটা সম্ভব হয়নি। পরে সেটা পিছিয়ে নেয়া হয় ২০২২ সালে। কিন্তু করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় এই সিদ্ধান্ত থেকেও সরে আসে মন্ত্রণালয়। সর্বশেষ সিদ্ধান্ত হয়েছে- ২০২৩ সাল থেকে প্রথম, দ্বিতীয় এবং ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণি, ২৪ সালে তৃতীয়, চতুর্থ এবং অষ্টম, নবম শ্রেণি ও ২৫ সালে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা নতুন শিক্ষাক্রমে বই পড়বে।

জানতে চাইলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা ভোরের কাগজকে বলেন, আজকের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীকে সব বলা হবে। এরপর প্রধানমন্ত্রী যদি কোনো অনুশাসন দেন তাহলে সেটি নতুন শিক্ষাক্রমে যুক্ত হবে।

এনসিটিবি সূত্র জানিয়েছে, জাতীয় শিক্ষাক্রমে সর্বশেষ পরিবর্তন আনা হয়েছিল ২০১২ সালে। এর আগে ১৯৯৫ ও ১৯৭৬ সালে আরো দুবার শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করা হয়। চলতি ২০২১ সাল থেকে জাতীয় শিক্ষাক্রমে ব্যাপক পরিবর্তন আনার কথা ছিল। কিন্তু করোনার কারণে বদলে যায় সর্বশেষ কারিকুলাম বাস্তবায়নের শুরুর সময়ও।

নতুন শিক্ষাক্রমের খুঁটিনাটি জানিয়ে এনসিটিবির সদস্য (মাধ্যমিক শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক ড. মো. মশিউজ্জামান ভোরের কাগজকে বলেন, নতুন শিক্ষাক্রমে বদলে যাবে বই, বইয়ের ধরন ও পরীক্ষা পদ্ধতিও। এছাড়া শিখন কৌশলেও নানা পরিবর্তন আসবে। এখন যেভাবে মুখস্থ বিদ্যা চলছে, নতুন শিক্ষাক্রমে সেটি একেবারেই অনুপস্থিত থাকবে। অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে যে শিক্ষাক্রম আসছে তা আয়ত্তে আনতে হলে শিক্ষার্থীদের তাৎক্ষণিক মেধার প্রয়োগ বাড়বে। তিনি নতুন শিক্ষাক্রমের উদাহরণ দিয়ে বলেন, রাঙ্গামাটিতে আনারস বেশি উৎপাদন হয়। এত দিন কৃষিবিজ্ঞান বইয়ে কীভাবে আনারস চাষাবাদ করা যায় তা শেখানো হয়েছে। কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রমে রাঙ্গামাটির শিক্ষার্থীদের আনারসের অর্থগুণ, পুষ্টিগুণও শিখতে হবে এবং প্রকল্পভিত্তিক শিক্ষায় যুক্ত হতে হবে। এছাড়া থাকবে অ্যাসাইনমেন্ট, থাকবে গ্রুপভিত্তিক শিক্ষা। শিক্ষাক্রমে করোনা ঢুকছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অবশ্যই। তবে কোন ক্লাসের পাঠ্যবইয়ে করোনা নামের অধ্যায় অন্তর্ভুক্ত হবে তা এখনো ঠিক হয়নি বলে জানান তিনি।

নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখায় বলা হয়েছে, প্রাক-প্রাথমিক থেকে শুরু করে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শ্রেণিকক্ষে মূল্যায়ন হবে। এদের কোনো বার্ষিক পরীক্ষা হবে না। চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে শ্রেণিকক্ষে ৭০ শতাংশ নম্বরের মূল্যায়ন হবে এবং বার্ষিক পরীক্ষা হবে ৩০ শতাংশ নম্বরের। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণিতে শ্রেণিকক্ষে ৬০ শতাংশ নম্বরের মূল্যায়ন হবে এবং বার্ষিক পরীক্ষায় ৪০ শতাংশ নম্বরের মূল্যায়ন হবে। আর একাদশ, দ্বাদশ শ্রেণিকক্ষে ৩০ শতাংশ নম্বরের মূল্যায়ন হবে ও বার্ষিক পরীক্ষায় ৭০ শতাংশ নম্বরের মূল্যায়ন হবে। এর ফলে দেশের প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষাক্রমে বড় পরিবর্তন হচ্ছে। অবশ্য শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর আগে ২০১০ সালে করা জাতীয় শিক্ষানীতির অনেক বিষয় এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামর্থ্য, শিক্ষকদের যোগ্যতাসহ সবকিছু বিবেচনা করে শিক্ষাক্রমে পরিবর্তন আনতে হবে।

নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জও আছে বলে মনে করেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কেউ কেউ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের উচ্চ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, বর্তমান সময়ের বাস্তবতা এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন বিষয় মাথায় নিয়ে এ শিক্ষাক্রম করা হচ্ছে। এটি বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ আছে। তবে সবার সহযোগিতায় এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করতে চান তারা।

এনসিটিবি সূত্রমতে, নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা অর্জনের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। সাধারণভাবে বলা হয়, একজন শিক্ষার্থীর জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা সমন্বিতভাবে অর্জিত হলে তার যোগ্যতা গড়ে ওঠে। উদাহরণ দিয়ে এনসিটিবি বলেছে, একজন শিক্ষার্থী একটি গাড়ি কীভাবে চালাতে হয়, তা যখন বই পড়ে বা শুনে বা দেখে জানতে পারে, তখন তার জ্ঞান অর্জিত হয়। ওই শিক্ষার্থী যদি গাড়ির বিভিন্ন যন্ত্র হাতে-কলমে পরিচালনা করতে শেখে, অর্থাৎ সামনে, পেছনে, ডানে-বাঁয়ে চালাতে পারে, ব্রেক করতে পারে, তখন তার দক্ষতা তৈরি হয়। আর যদি ওই শিক্ষার্থী গাড়ি চালিয়ে নিজের ও রাস্তার সব মানুষ, প্রাণী ও সম্পদের নিরাপত্তা রক্ষা করে গন্তব্যে পৌঁছানোর সক্ষমতা অর্জন করে, তখন তার গাড়ি চালনার বিষয়ে যোগ্যতা অর্জিত হয়। নতুন জাতীয় শিক্ষানীতিতে এসব বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তবে চ্যালেঞ্জ হবে ধারাবাহিক মূল্যায়ন নিয়ে। এজন্য শিক্ষকদের আরো যোগ্য করে তুলতে হবে এবং প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়াতে হবে।

নতুন শিক্ষাক্রমে প্রাক-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ১০ ধরনের শেখার ক্ষেত্র ঠিক করা হয়েছে। এগুলো হলো- ভাষা ও যোগাযোগ, গণিত ও যুক্তি, জীবন ও জীবিকা, সমাজ ও বিশ্ব নাগরিকত্ব, পরিবেশ ও জলবায়ু, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য, সুরক্ষা, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি। প্রাক-প্রাথমিকের শিশুদের জন্য আলাদা বই থাকবে না, শিক্ষকরা শেখাবেন। প্রাথমিকের জন্য আটটি বিষয় নির্বাচন করা হয়েছে। এগুলো হলো- বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান, ধর্মশিক্ষা, ভালো থাকা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি। এর মধ্যে ‘ভালো থাকা’ এবং ‘শিল্প ও সংস্কৃতি’ বিষয়ে আলাদা বই থাকবে না।

এগুলো শিক্ষকরা শেখাবেন, যার জন্য নির্দেশনামূলক বই দেয়া হবে। আর ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীকে ১০টি অভিন্ন বই পড়ানো হবে। এগুলো হলো- বাংলা, ইংরেজি, গণিত, জীবন ও জীবিকা, বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান, ডিজিটাল প্রযুক্তি, ধর্মশিক্ষা, ভালো থাকা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি। বর্তমানে মাধ্যমিকে ১২ থেকে ১৪টি বই পড়ানো হয়। এখন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত কিছু অভিন্ন বই পড়তে হয়। আর নবম শ্রেণিতে শাখা বিভাজন হয়। নতুন শিক্ষাক্রমে একাদশ শ্রেণিতে গিয়ে শাখা পরিবর্তন হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App