×

মুক্তচিন্তা

কেন এলে, কেন এভাবে গেলে!

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০১:০৯ এএম

কেন এলে, কেন এভাবে গেলে!

বাই বাই বাইডেন! একালের তুঘলক ট্রাম্পকে আপনি যখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হারালেন, কী দারুণ ভাবমূর্তি আপনার মার্কিনিদের কাছে। আজ খোদ ট্রাম্পই কিনা রাজনৈতিক গর্ত থেকে বেরিয়ে আপনাকে উদ্দেশ করে বলছে আপনার নেতৃত্বে আমেরিকা বিশ্ববাসীর কাছে ‘বোকা এবং দুর্বল’ প্রতিপন্ন হয়েছে। ২০ বছর আগে বুশ মিয়া পুশ করেছিল মার্কিনি সেনাবাহিনীকে আফগানিস্তানে, হটিয়ে দিয়েছিল তালেবান সরকারকে, আলকায়দার আশ্রয়কেন্দ্র গুঁড়ো গুঁড়ো করে দেবার ব্রতে। ওবামা তার ৮ বছরে পাকিস্তানে লুকিয়ে থাকা লাদেনকে গোপন মিশনে হত্যা করে বাহবা কুড়াতে ব্যাকুল হলো। ট্রাম্প এসে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনাদের ফিরিয়ে আনার দরবার করল বরদারী তালেবানদের সঙ্গে। ট্রাম্পের চুক্তি অনুসরণ করে বাইডেন প্রেসিডেন্ট, আপনি আর অন্যদেশের দায়ভার নেবেন না বলে সেদেশ থেকে সৈন্য সরাবার দিন-তারিখ ঘোষণা করে দিলেন। নিজ দেশের জনগণের ভাগ্য বদলাবার মূল কাজে মার্কিনি অর্থনীতির হিম্মতি ব্যবহার করবেন। যখন মার্কিনি বাহিনী ২০ বছর আগে আফগানিস্তানে ঢুকে তালেবান সরকারকে উৎখাত করে নিজেদের তাঁবেদার সরকার বসাল, তখন তালেবানবিরোধী অনেকেও বলল, কেন এলে। আফগানিস্তানকে সাইন বোর্ড হিসেবে ব্যবহার করে গোটা মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারের অপকৌশল বুঝতে তেমন মাথা খাটাতে হয় না। আফগানিস্তান ও আশপাশে লাখ লাখ আদম সন্তানের রক্তনদী বইয়ে দিলেন। কিন্তু রুশ নেতা পুতিনের মতে, শেষ পর্যন্ত আপনারা নাকি পেয়েছেন মস্ত গোল্লা। আপনারা বেদম পরিস্থিতিতে দম হারিয়ে ফেলেছেন। অতএব এবার বাই! বাইডেন ভাই!! মার্কিনি শাসকগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে সেই ‘বাই’ জানাবার চাঁই হিসেবে আপনি এ কী দেখালেন! আপনাদেরই এককালে গড়ে তোলা তালেবান বাহিনীর কাছে আপনাদের এ কী লেজে-গোবরে নাজেহাল অবস্থা। ভিয়েতনামে একবার আপনাদের এই হতদ্দশা হয়েছিল। বিংশ শতাব্দীতে। একবিংশে এসে কী বিষে দংশিল আপনাকে! মার্কিনি দম্ভ, অহম ও বিশ্বপোদ্দারীর গভীরে এমন আঘাত বিশ্ববাসী দেখল, পরাশক্তি হিসেবে আপনাদের ভাবমূর্তির বেলুন এমন ফুশ করবে, জানি না বুশ মিয়া এখন কী ভাবছে! আপনাদের গোয়েন্দা বাহিনী বলেছিল কাবুল দখল করতে তালেবানদের ৬ মাস যাবে। এর মাঝে সব গুছিয়ে আফগানিস্তান থেকে লেজ গুটাবেন আপনারা। তারপর? মাত্র ১০ দিনে? এমন হাবুডুবু! নাকানি চুবানি!! এমন নাকে খত!!! এ কেমন গোয়েন্দা বাহাদুরি আপনাদের! এমন বিশ্ব হুজুরের এমনি অবিশ্বাস্য হায় হায় কাতরানি ডিজিটাল টালমাটাল যুগে বিশ্বময় বিস্ময় ছড়িয়ে দিল। আপনাদের বিশাল রণসম্ভার। আপনাদের বিশাল বাহিনী। আপনাদের গড়ে তোলা ৩ লাখ আফগান সেনাবাহিনী। তারপর? এমন হুড়মুড় সব ভেঙে পড়ল কেন ওই বঙ্গ বচন ‘তাসের ঘরের’ মতো? প্রায় এক ট্রিলিয়ন ডলার আপনারা ঢেলেছেন আফগানিস্তানে। আর কত? ট্রাম্প বললেন, এভাবে আফগানিস্তানে ঢোকাটাই ঠিক হয়নি। চার চারজন প্রেসিডেন্ট এলো। বাইডেন আপনার ঘাড়ে চেপে বসল অবশেষে ঘোগের বোঝা। এ বোঝা নামাতে গিয়েই এমন ধপাস পতন! একদিন সে সময়ের সোভিয়েত ইউনিয়নের চার নেতা ‘বিপ্লব রপ্তানির’ নামে আফগানিস্তানে সোভিয়েত তরুণ সেনাদের ঢুকিয়ে দিয়েছিল বাকি কোনো নেতার সঙ্গে আলাপ না করেই। তখন শত শত বছরের দুর্দান্ত সাহসী বিশেষত পশতুন আফগানরা পাকিস্তানে শরণার্থী হতে বাধ্য হয়েছিল। সেই পশতুন শরণার্থীদের মার্কিনিরা পাকিস্তানি সেনাদের সহায়তায় ‘তালেবান’ বাহিনী গড়ে পশতুন জাতীয়তাবাদী দুঃসাহসের সঙ্গে কট্টর ধর্মান্ধতা মিশিয়ে এক ভয়ংকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করল। সোভিয়েত ইউনিয়নের নাক থ্যাবড়া হলো একসময়, হাজার হাজার সোভিয়েত তরুণের রক্তের মর্মান্তিক পটভূমিতে লেজ গুটাতে হলো তাদেরও। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ব্রিটিশরাও আফগানিস্তানকে বাগে আনতে পারেনি। তিন তিনটি বড় শক্তি আফগান সাহসিকতার বল্লমবিদ্ধ হয়ে একশ বছরে যে উদাহরণ সৃষ্টি করল, সেটা থেকে শিক্ষা নেবার ইতিহাস-ছাত্র হতে পারবে কি নতুন-পুরনো পরাশক্তিবৃন্দ? ব্যাপারটা এমন হলো কেন? ওই এক ট্রিলিয়ন মার্কিনি ডলার কীভাবে ব্যয় হলো। যুদ্ধ প্রস্তুতি ও রণভাণ্ডারের সব কিছু সরবরাহ করত মার্কিনি কন্ট্রাক্টর। তাঁবেদার সরকারের দুর্নীতির মাত্রা ছিল মারাত্মক। আফগান সেনাবাহিনী ঠিকমতো বেতনই পেত না। পুরো বাহিনীর মনোবল আর যুদ্ধস্পৃহার ভরা নদী মরুপথে হারাল ধারা। যুদ্ধের শেষ দিকে মার্কিনি কন্ট্রাক্টর সব প্রকার প্রযুক্তিভিত্তিক অস্ত্র গায়েব করে দিল। আফগান সরকারি বাহিনীর যুদ্ধ রসদ, খাদ্য সরবরাহ সব বন্ধ হতে থাকল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নামক ‘শ্যাম চাচা’ তখন ‘আপন পরাণ বাঁচার’ পথ ধরল। কার জন্য তাহলে কেন জীবন দেবে আফগান সরকারি সেনারা? তদুপরি তালেবান কমান্ডাররা আফগান সরকারি বাহিনীকে ঘুষ দিয়ে কিনতে থাকল। ওদিকে পাকিস্তানের ওম দেয়া তালেবান বাহিনীর এবার পোয়াবারো। এবার চীনের শ্যেনচক্ষু আফগানিস্তানে। কেন? চীনের ‘ক্যারিকেচার কমিউনিজম’ গন্ধ পেল আফগান খনিজ সম্পদের। তদুপরি চীন আফগানিস্তান-পাকিস্তান হয়ে এক বিশাল সমুদ্রবন্দর তথা সামরিক ঘাঁটির সুযোগ সন্ধানী পাঁয়তারায় তালেবানদের বলল, কুছ পরোয়া নেহি, যত দ্রুত পারো কাবুল দখল করো। আমরা আছি। এখন চীন স্বীকৃতি দিয়ে দিয়েছে তালেবানিস্তানকে। চীন প্রাথমিক সাহায্য দিয়েছে তালেবান সরকারকে। পাকিস্তানও পাশে। রাশিয়া দু-পা আগে এক-পা পিছে। এবার তালেবানি জাতীয়তাবাদ পড়ল নব চ্যালেঞ্জে। চীনা পরাশক্তির স্বার্থপরতা কাকে বলে বুঝবে আফগান নবশাসকরা! এই ২০ বছরে আমেরিকা আর ন্যাটো বাহিনীর পরিকল্পনায় আফগানিস্তানের সমাজে নানারূপ পরিবর্তন হতে থাকল। ধর্মান্ধতার বদলে কিঞ্চিৎ উদারনৈতিক আবহাওয়ায় আফগান তরুণ-তরুণীরা পরিবর্তনের স্বাদ পেল। আফগান মেয়েরা শিক্ষা আর কাজের সুযোগ পেল। হঠাৎ তালেবানরা এসে সব ভণ্ডুল করে দিল। তালেবানরা ফিরে এসে ফের ভয়ংকর নির্মম কট্টর শাসন চালাবে এমনটা তারা ভাবেনি। এমনই ভীতি ছড়াল যে অগণিত আফগান মার্কিনি সহায়তায় দেশত্যাগের জন্য এক প্রকার উন্মাদ হয়ে গেল। বিমানের চাকায় ঝুলে তালেবানদের হাত থেকে রক্ষা পেতে গিয়ে প্রাণ হারাল কেউ কেউ। আহারে কত শিশু-বৃদ্ধ-যুবা, কত যে কষ্ট! সবারই প্রশ্ন, এমন হঠাৎ কেন গেলে? হাজার হাজার মানুষের জীবন এখন মহাবিপন্ন। আমেরিকার লোক আগামী নির্বাচনে বাইডেনকে ‘বাই বাই’ জানাবে বলে অনেকেরই মনে হচ্ছে। সে কথা থাক। তবে পৃথিবীজুড়ে মানুষ একদিন বলেছিল, কেন এলে? এখন সেই মানুষের অনেকেই বলছে, এভাবে কেন গেলে?

হিলাল ফয়েজী : মুক্তিযোদ্ধা ও রম্যলেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App