×

মুক্তচিন্তা

আনন্দ উত্তেজনার মধ্যে স্কুল-কলেজ খুলছে, সতর্ক থাকতে হবে

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১২:৩০ এএম

দীর্ঘ ১ বছর ৭ মাস পর আজ থেকে খুলতে যাচ্ছে স্কুল ও কলেজ। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও খোলার প্রস্তুতি চলছে। বলার অপেক্ষা রাখে না করোনা অতিমারির কারণে শিক্ষা ক্ষেত্রে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে শিক্ষার্থীদের। ক্ষতির এমন ভয়াল থাবা শুধু আমাদের দেশেই নয়, বিশ্বের সর্বত্রই ছোবল হেনেছে। আমরা সাহস করে স্কুল-কলেজ খুলছি ঠিকই কিন্তু যেন মুহূর্তের জন্যও অসতর্ক না হই সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ কঠোর দৃষ্টি রাখবে এটা আশা করি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রটোকল মতো দৈনিক শনাক্তের হার ৫ ভাগের নিচে নামেনি এখনো। তবু আমরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছি। শনাক্তের হার ক্রমহ্রাসমান আছে- শতকরা ৩১ থেকে বর্তমানে ৮ ও ৯-এর মাঝামাঝি আছে, আপাতত সেটিই ভরসার জায়গা। আনন্দ, উত্তেজনা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার উৎসাহের মধ্যে আতঙ্কও কিন্তু কম নেই! কেননা, আমেরিকাসহ অনেক দেশেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পরপর সংক্রমণের হার হঠাৎ করেই কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়টি শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ অভিভাবক মহলকে গুরুত্বের সঙ্গে মেনে চলতে হবে, বিধির ব্যত্যয় করা যাবে না। প্রাথমিকভাবে কিছুদিন পরীক্ষামূলক এবং সতর্কতার সঙ্গে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনা করতে হবে। শৃঙ্খলার সঙ্গে বিভিন্ন শ্রেণির শিক্ষার্থীদের সঙ্গে করোনাকালীন পাঠদান কার্যক্রমসহ অন্যান্য নানামাত্রিক আচরণ পর্যবেক্ষণ পর্যালোচনা ও প্রয়োজনে সহনশীলতার সঙ্গে সংশোধনের প্রতি মনোযোগী হতে হবে। শিক্ষার্থীদের মানসিক জড়তা থেকে মুক্তি দিতে হবে। আস্তে আস্তে স্বাভাবিকতার দিকে দিকে অগ্রসর হতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় শিক্ষার্থীদের আগ্রহ আছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এক প্রকার আনন্দ অনুভব করছেন। কিন্তু দিন শেষে যদি দেখা যায় তাদের এ ধারণা তত্ত্বগত মাত্র ছিল তখন আমাদের হতাশ হতে হবে। কারণ আমাদের জাতীয় স্বভাব থেকে আমরা আমাদের সন্তানদের মুক্ত করতে পেরেছি বলে কেউ কি জোরের সঙ্গে বলতে পারব? আর সামাজিক দূরত্ব নিয়ে টেলিভিশনে স্কুল-কলেজ খোলার পক্ষের বক্তারা যেভাবে বলছেন আমাদের দেশের স্কুল-কলেজের অবকাঠামোগত বাস্তবতায় আদৌ কি সেরকম সুবিধা আছে? মাঝেমধ্যে তাই মনে হয় আমরা বেশি তাড়াহুড়ো করে ফেলেছি। প্রতিটি ক্লাসে শিক্ষার্থী সংখ্যাকে তিন ভাগে ভাগ করলেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রটোকল অনুযায়ী সামাজিক দূরত্ব মেনে ক্লাস পরিচালনা একটি অসম্ভব বিষয়। আমরা মনে করি পিইসি, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের প্রতিদিন ক্লাসের প্রয়োজন ছিল না। ইতোমধ্যে তাদের সিলেবাস কাস্টমাইজ করা হয়েছে, অ্যাসাইনমেন্টের মাধ্যমে তাদের প্রস্তুতিও মোটামুটি এক প্রকার সন্তোষজনকই। তাই সে ক্ষেত্রে তাদের একদিন অন্তর ক্লাসে ফেরানোই ভালো হতো। এভাবে অন্তত ১৪ দিন পর্যবেক্ষণের পর তাদের প্রতিদিন ক্লাসের বিষয়টি নিশ্চিত করা যেত। শতভাগ ক্লাস পরীক্ষা ও অন্যান্য কার্যক্রম শুরু করা যাবে এমন উচ্চাশা নিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো খুলছে না। মনের ভেতর আশঙ্কা ও ভীতি নিয়ে নিয়েই যেহেতু প্রতিষ্ঠানের দরজা খুলছে তাই সেসব ভীতি আর আশঙ্কামুক্ত থাকার জন্য অবশ্যই গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যবিধির প্রতি যতœশীল মনোযোগ রাখতে হবে। এ দায়িত্ব কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর ছেড়ে দিলে চলবে না। অভিভাবকদেরও গুরু দায়িত্ব নিতে হবে। আর অভিভাবকদের মধ্যে যারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিজ নিজ সন্তানদের নিয়ে আসেন, ছুটি পর্যন্ত অপেক্ষা করে বাচ্চাদের নিয়ে বাড়ি ফেরেন- সবচেয়ে বেশি সতর্ক অবস্থায় থাকতে হবে সেসব অভিভাবককে। মনে রাখতে হবে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললেও আমরা করোনা ঝুঁকির মধ্যেই আছি। স্বাভাবিক জীবনে আমরা আদৌ আর ফিরতে পারব কিনা সন্দেহ। সেই সন্দেহের কথা মনে রেখেই স্কুলের বাইরে অভিভাবকরা সামাজিক দূরত্ব মেনে চলবেন। তা না পারলে পুনরায় সংক্রমণ বৃদ্ধি এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাবে। সুতরাং কোনোরূপ অবিমৃষ্যকারী আচরণের জন্য সংক্রমণ বৃদ্ধির মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আর বন্ধ করা যাবে না। সবার সতর্কতার মধ্যেই শিক্ষাক্ষেত্রের করোনাকালীন সাফল্য নির্ভর করছে। অর্থাৎ স্কুল-কলেজ খুলছে, এই খোলা স্কুল-কলেজ যেন আবার বন্ধ করতে না হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে ছাত্রছাত্রী, শিক্ষকমণ্ডলী এবং বিশেষ করে অভিভাবকদের। ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে তালা ঝোলানো রয়েছে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। শিক্ষার্থীহীনতায় শূন্য খাঁ খাঁ শিক্ষালয়গুলো খুলতে যাচ্ছে আজ। দীর্ঘ প্রায় দেড় বছরের অধিক সময় ধরে গৃহবাসী থাকতে থাকতে শিক্ষার্থী, শিক্ষক এমনকি শিক্ষা সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মনোজগতেও এক ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে। বিশ্বব্যাপী মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বারবার এ কথা মনে করিয়ে দিলেও আমাদের দেশে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তাভাবনার অবকাশ বিভিন্ন কারণেই কম। এর অন্যতম কারণ লোকসংখ্যার অনুপাতে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিত্ব ও প্রতিষ্ঠানের স্বল্পতা। ফলে আমাদের দেশে বিষয়টির গুরুত্ব এবং প্রচারণা উভয়ই অনেক কম। বিগত দেড় বছরে মানসিক স্বাস্থ্য সংকট বড়দের মধ্যে এক রকম তৈরি হয়েছে, শিশুদের ক্ষেত্রে ভিন্নতর হলেও সংকট কিন্তু তৈরি হয়েছে। কিন্তু সংকট যতই সৃষ্টি হোক তাকেও স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে হবে সব পক্ষেরই। ঘরের মধ্যে বসে বসে দেড় বছরের দীর্ঘ এই সময়ে টেলিভিশন বা সামাজিক গণমাধ্যমে করোনা মহামারির নেতিবাচক সংবাদ শুনে শুনেই সময় কেটেছে সবার। সময় কেটেছে প্রতিদিনকার মৃত্যু ও সংক্রমণের পরিসংখ্যানের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে। ফলে সেসব পরিসংখ্যান মনের ওপর প্রভাব ফেলেছে এই দীর্ঘ সময় ধরেই। শিশুরা মাঠে খেলতে পারেনি। শারীরিকভাবেও তাদের কিছু পরিবর্তন হয়েছে। করোনার আতঙ্ক তাদেরও মানস জগতে ছায়া ফেলেছে। এ পরিবর্তন বয়স্কদের ক্ষেত্রেও আশঙ্কাজনক হারে বেশি হওয়ার কথা, বিশেষ করে পঞ্চাশোর্ধ্বদের। শিশুরা মাঠে যাওয়ার বিকল্প হিসেবে বেছে নিয়েছে বিভিন্ন রকমের ডিভাইসে ভার্চুয়াল গেমস। এসব গেমসে আসক্ত হওয়ায় তারা মনস্তাত্ত্বিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা কঠিন তো বটেই কিছুটা সময়সাপেক্ষও। অর্থাৎ স্বাভাবিক জীবনযাপনের সুযোগ না থাকায় দেড়টি বছর অস্বাভাবিক জীবনযাপনে আমরা যেমন বাধ্য হয়েছি তেমনি শিশুরাও বাধ্য হয়েছে। ফলে তাদের জীবনে অস্বাভাবিক কিছু প্রবণতা ‘স্বাভাবিকভাবেই’ যেন যুক্ত হয়ে গেছে! এতে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের মনস্তাত্ত্বিক জগৎটাও বেশ কিছুটা এলোমেলো হয়ে গেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর আস্তে আস্তে সেসব পরিবর্তন স্পষ্ট হতে শুরু করবে। তাই তাদের ওপর এখনই পড়ালেখা কিংবা পরীক্ষা সংক্রান্ত বাড়তি ‘চাপ’ সৃষ্টি থেকে বিরত থাকতে হবে। অর্থাৎ এবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর শিক্ষকদের শিক্ষকতার ‘অতিরিক্ত’ কিছু দায়িত্ব পালন করতে হবে। সেটি হলো শিশুদের মনস্তত্ত্বকে গুরুত্ব দিয়ে পর্যবেক্ষণ ও পাঠদান কার্যক্রমকে পরিচালনা করা। এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আমাদের প্রস্তাব থাকবে সিলেবাসের আয়তন কমিয়ে নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে পাঠদানের পরিধি নির্ধারণ করে দিতে হবে। পরীক্ষার ভীতিসহ কোনো প্রকার নতুন চাপ শিক্ষার্থীদের ওপর আরোপ করা যাবে না। বরং স্বল্প সিলেবাস পড়ানোর মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে এবং ‘ধীরে চলো নীতি’ মেনে আস্তে আস্তে অগ্রসর হওয়াই ভালো হবে বলে আমরা মনে করি। একই সঙ্গে প্রতিদিনকার ক্লাসের বিষয়টি নিয়ে পুনর্বিবেচনারও অবকাশ আছে। প্রতিটি শ্রেণিকে শাখাভিত্তিক বিভাজনের মাধ্যমে একেক দিন একেক শাখার ক্লাস অনুষ্ঠানের বিষয়টি প্রাথমিকভাবে যুক্তিসঙ্গত ছিল। জাতীয় পরামর্শক কমিটির এরূপ প্রস্তাবনাই ছিল শুনেছি। এটি কিছুদিন পর্যবেক্ষণ করা যেত। পরিবর্তিত নতুন পরিস্থিতিতে ছোট আকারের সিলেবাস কিছুটা বেশি সময় নিয়ে শিক্ষার্থীদের ধীরেসুস্থে পাঠদানের মাধ্যমে আস্তে আস্তে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়াই সবার জন্য মঙ্গল। এছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা থাকলেও অনলাইন কার্যক্রম বন্ধ হবে না বলেও ঘোষণা রয়েছে। আগামী অল্পদিনের মধ্যেই দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় খোলার ঘোষণাও আসবে। শারীরিকভাবে উপস্থিতির মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ দীর্ঘদিন বন্ধ থাকলেও শিক্ষাদান কার্যক্রম একেবারে বন্ধ ছিল না। ২০২০ সালে মার্চে বন্ধ হলেও জুলাই থেকে অনলাইন ক্লাস এবং পরীক্ষা গ্রহণ অব্যাহত গতিতেই চলেছে। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন পরীক্ষা কার্যক্রম ছাত্রছাত্রীদের পুরোদমে ব্যস্ত রাখছে। এ কথা সত্য, আমরা যারা খুব বেশি প্রযুক্তিবান্ধব ছিলাম না তারাও পর্যায়ক্রমে অনলাইন প্রক্রিয়ায় পাঠদান এবং পরীক্ষা গ্রহণে অভ্যস্ত হয়ে উঠছি। বুঝতে পারছি প্রচলিত পদ্ধতিতে পরীক্ষা গ্রহণ সংক্রান্ত পরিশ্রমের চেয়ে অনলাইনে পরীক্ষা গ্রহণে পরিশ্রম ও মনোনিবেশ অনেক বেশি প্রয়োজন। অর্থাৎ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত পরিশ্রম প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে কয়েক শুণ বেশি। একটি দৃষ্টান্ত দিয়ে বলি। আগে এক পাতার একটি কাগজে পরীক্ষার সমস্ত রুটিন প্রচার সম্ভব হতো। এখন সেখানে ৩-৪ পাতা কেবল রুটিনই করতে হচ্ছে! তারপর নেটওয়ার্ক সমস্যার কারণে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে তাকে যুক্ত করা ইত্যাদি ‘হেপা’ তো নিত্য ঘটনা। তবু অনেকটা নির্বিঘেœই পরীক্ষাগুলো অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে। যতটা অসম্ভব ভেবেছিলাম এখন আর ততটা মনে হচ্ছে না। তবে স্বীকার করতেই হবে অনলাইন শিক্ষার গুণগত মানের প্রশ্নটি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।

আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App