×

মুক্তচিন্তা

জরিপ হলে রুস্তম আলীদের সংখ্যা কম হবে না

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১২:২৯ এএম

বেশ আক্ষেপ সিএনজিচালক রুস্তম আলীর। একটা সময় করোনাকালের লকডাউনে জীবিকা নির্বাহ কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তখন যন্ত্রচালিত যানের চলাচল নিষেধ ছিল। পাঁচ সদস্যের পরিবার নিয়ে বসবাস মহাখালীর টিএন্ডটি বস্তিতে। দুই রুমের ঘর ভাড়া মাসিক ৫ হাজার টাকা। তার ওপর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করোনাকালে বন্ধ থাকলেও স্কুল ও কলেজপড়ুয়া তিন সন্তানের বেতন পরিশোধ করতে হয়েছে। ফাঁক খুঁজে ঝুঁকি নিয়ে সিএনজি চালিয়েছেন রুস্তম আলী। নিজে মালিক নন, ভাড়ায় সিএনজি চালান। মালিক শর্তসাপেক্ষে তাকে সিএনজি চালাতে দেন। শর্ত ছিল লকডাউনে মামলা হলে তার দায় রুস্তম আলীর। ভ্রাম্যমাণ আদালত জরিমানা করলে তার সব দায় রুস্তম আলীকে নিতে হবে। মালিকের টাকার অংশে তা পরিশোধ করা যাবে না। পরিবারের কথা ভেবে মালিকের শর্ত মেনে নেন। রুস্তম আলীর কষ্ট বা আক্ষেপ এই শর্তে নয়, অন্যখানে। গলার রগ ফুলিয়ে কথা বলছিলেন তিনি, পুলিশ দেখলে ভয় হয় তার! কেমন ভয় জানতে চাইলে বললেন, দেশের মানুষের নিরাপত্তা দেয়ার কথা তাদের। অথচ তারাই এখন মানুষকে বিপদে রাখছে। বিপদে ফালাইতেছে। কেমন বিপদ জানতে চাইলাম। মাথা ঘুরিয়ে অবাক দৃষ্টি ছুড়লেন। যেন অবিশ্বাস্য কোনো প্রাণী তার সম্মুখে। এমন কাউকে দেখবার আশা সম্ভবত তার ছিল না। হাতের মুঠোতে ব্রেক শক্ত করে ধরলেন। ধাক্কা খেলাম। বললেন, আপনারা শিক্ষিত সমাজ। ওঠাবসা কত জায়গায়। পেপার-পত্রিকা পড়েন। ঘরে কালার টেলিভিশন। ডিশ লাগাইয়া চ্যানেল দেখেন, অথচ খবর রাখেন না! খবর পড়েন না! অতঃপর শান্ত হয়ে গাড়িতে স্টার্ট দিলেন। সিএনজির যন্ত্রণাদায়ক আওয়াজের সঙ্গে রুস্তম আলীর কথা কানে এলো, পুলিশ মাদক ব্যবসায়ীদের ধরে। আবার নিজেও মাদক ব্যবসা করে। নারীকে ধর্ষণের হাত থেকে রক্ষা করে, চান্স পাইলে নিজেও ধর্ষণ করে। দেখলেন না এএসপি অপহরণ করে চাঁদাবাজি করল! কত জায়গায় টাকা আত্মসাৎ করে, মিথ্যা মামলা দেয়, তদন্তে টাকা খায় আরো কত কী করে। কত অভিযোগ! মানুষ তার নিরাপত্তার জন্য কই যাইব, কন? করোনাকালে লকডাউনে পুলিশরে যে কত টাকা দিছি। ডাকাত নয়, এখন পুলিশ দেখলে ডর করে। বললাম, ভালো পুলিশ সদস্য কিন্তু আছে। যারা ভালো কাজ করেছেন, করছেন। করোনাকালে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে কিন্তু অনেক পুলিশ সদস্য মারাও গেছেন। রুস্তমের কথাটা এমন, সেই সব ভালো পুলিশ সদস্যের অবদান মানুষ ভুলে যায় এমন কিছু সদস্যের অনৈতিক ও বিধিবহির্ভূত কাজের কারণে। কোনো কোনো পুলিশ সদস্য এমন সব নেতিবাচক কাজ করে বসেন, যা সমাজের মস্ত অপরাধীকেও হার মানায়। মানুষ কিন্তু তার ভয়ংকর ও তিক্ত অভিজ্ঞতা দ্বারাই বেশি ভাবনায় পড়েন। নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হন। রুস্তম আলীর অনুভূতি মোটেও অহেতুক নয়। বরং বেশ যৌক্তিক। রুস্তম আলী অনেক কথা বলে গেলেন যার সারমর্ম হলো, জনগণকে যার নিরাপত্তা দেয়ার কথা, জনগণকে নিরাপত্তা দেয়ার জন্য রাষ্ট্র যাকে নিয়োগ দিয়েছেন, হাতে বন্দুক ধরিয়ে দিয়েছেন, সুসজ্জিত পোশাক দিয়েছেন এবং যার বেতন সেই জনগণের টাকায় হয়, তার দ্বারা জনগণের নিরাপত্তা লঙ্ঘনের বিষয়টি সত্যিই একটি রাষ্ট্রের জন্য যেমন চরম হতাশার এবং ব্যর্থতাকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, ঠিক তেমন জনগণের জন্য আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। রক্ষক যে ভক্ষক হয়নি, হয় না কখনো তা কিন্তু নয়। রক্ষক ভক্ষক হয়েছে। অতীতে তার মাত্রা, ধরন ও কৌশল কী ছিল সেটা প্রচারমাধ্যমে প্রকাশিত না হওয়ার কারণে হয়তো ততটা জানা সম্ভব হয়নি। এখন প্রচারমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার কারণে যতটা জানা সম্ভব হয় বা হচ্ছে। অপরাধকে দৃশ্যমান করার জন্য প্রচারমাধ্যমগুলো তুলনামূলকভাবে যথেষ্ট সক্রিয় এখন। তবে সব প্রচারমাধ্যম যে সবসময় নৈতিকতার জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে বা আছে তা কিন্তু নয়। সেখানেও ব্যতিক্রম আছে। আছে অসততা, দুর্নীতি ও অপরাধপ্রবণতা। মূলত ব্যক্তিদোষে পেশার সুনাম ক্ষুণ্ন হয়, হচ্ছে। কতিপয় পুলিশ সদস্যের কারণে ‘পুলিশ’ শব্দের প্রতি মানুষের যেমন আতঙ্ক, ভয় ও ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে, তদ্রƒপ কিছু সাংবাদিকের অর্থলোভে ব্লাকমেইলিং আচরণে ‘সাংবাদিক’ পেশা নিয়ে মানুষের ভেতর ভয়, সংশয় তৈরি হয়েছে। মানুষ বাধ্য না হলে সহজে এখন পুলিশের দ্বারস্থ হন না। হয়রানি ও অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের সম্ভাবনার ভয়টা রয়ে যায়। কতিপয় সাংবাদিকের ক্ষেত্রেও কথাটা প্রযোজ্য। রুস্তম আলী প্রসঙ্গক্রমে দুয়েকটা ঘটনার কথা উল্লেখ করলেন। প্রচারমাধ্যমে এমন সংবাদ প্রকাশিত হলো যে, মৃত ব্যক্তির দেখা মিলেছে। মৃত ব্যক্তি ফেরত এসেছেন। মৃত ব্যক্তিকে নিয়ে হইচই পড়ে গেছে। হত্যা করা হয়েছে এমন মামলায় আসামিরা শাস্তি ভোগ করে আসলেও তার মাঝেই যে ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ, সেই ব্যক্তির দেখা মিলেছে। এ যেন আইনি প্রক্রিয়ার প্রতি নতুন করে জনগণের মনে আস্থাহীনতার জন্ম দেয়ার রূপকথার গল্প। সেটা কেমন? কিছুদিন আগে শোনা গেল যখন একটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিরীহ ব্যক্তিরা আসামি হিসেবে শাস্তি ভোগ করে আসছেন তার মাঝেই তখন মৃত ব্যক্তির খোঁজ পাওয়া গেল। হত্যাকাণ্ডের মামলায় আসামিরা দোষী সাব্যস্ত হয়ে রীতিমতো বিচারিক প্রক্রিয়ায় শাস্তি ভোগ করতে শুরু করেছেন, তার মাঝে মৃত ব্যক্তির এই সাক্ষাৎ ঘটার পেছনের বিস্ময়কর কারণ কী? রুস্তম আলী শুনেছেন, পুলিশের তদন্ত প্রক্রিয়ায় হত্যাকারী হিসেবে তাদের কাছ থেকে জোর করে স্বীকারোক্তি নেয়া হয়েছে যে, তারাই অমুক ব্যক্তিকে হত্যা করেছেন। কীভাবে হত্যা করেছেন তারও বর্ণনা দেয়া হয়েছে। বাধ্য হয়ে স্বীকারোক্তি দেয়া ও শাস্তি ভোগ করা নিশ্চিত হয়েছে। ফলে প্রকৃত আসামি নন, এমন কিছু নিরীহ ব্যক্তি আসামি হয়ে শাস্তি ভোগ শুরু করেন। যখন মৃত ব্যক্তির দেখা মেলে তখন আসল ঘটনা সবাই জানতে পারেন। তারপর কী হয়? প্রশ্নটা আমার কাছে রুস্তম আলীর। উত্তর আমার জানা নেই। সংশ্লিষ্টরা জানতে পারেন। বলতে পারেন। তদন্ত ও বিচারিক প্রক্রিয়া সুষ্ঠু এবং আইনসিদ্ধভাবে হলে এমন প্রশ্নের অবতারণা হয় না, শুধু এটুকু বলা যায়। আমার মতন সাধারণ মানুষ বলতে পারে। মামলার তদন্ত প্রক্রিয়া নিয়ে অনেক সময় অনেক ধরনের অভিযোগ শোনা যায়। অসন্তুষ্টি প্রকাশ পায়। যেটা আইনি প্রক্রিয়ার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা হারাবার একটা কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়া দেশের কোনো কোনো বড় অপরাধের পেছনে কোনো কোনো পুলিশ সদস্যের সহায়তা ও সমর্থন এবং অংশীদারিত্বের অভিযোগ উঠে মাঝেমধ্যে, যা জনগণ আশা করেন না। উপরন্তু ভীতসন্ত্রস্ত হন। সামাজিক অবক্ষয় ও বিপর্যয় নিয়ে বুদ্ধিওয়ালারা, রাজনীতিবিদরা, সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্তরা অনেক কথা বলেন। বুলি আউড়ান, পরামর্শ দেন। যার অধিকাংশই বুকিশ ও রাজনৈতিক কথা। মূল জায়গায় কেউ হাত দেন না। যিনি বা যারা দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত, তার বা তাদের দ্বারা আইনশৃঙ্খলা লঙ্ঘিত হওয়াটা কিন্তু কোনো সাধারণ অপরাধের ঘটনা নয় যে, সাধারণ অপরাধের মতন বিষয়টি দেখতে হয় বা হবে। বরং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীর কোনো সদস্য দ্বারা সংঘটিত অপরাধের বিষয়টি অন্য ব্যক্তির কাছে সহজতর হয়ে ওঠে এবং যা সহজেই সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে যায় বিধায় গুরুতরভাবে বিষয়টি নিতে হবে। দেখতে হবে। রুস্তম আলীর আরো একটা প্রশ্ন ছিল, এত নিয়ম কানুনের ভেতর থেকে কী করে কোনো পুলিশ অপরাধ করতে পারেন? এই উত্তরটাও আমি তাকে দিলাম না। দিতে পারলাম না। তবে এই লেখার মাধ্যমে প্রশ্নটা আমি পুলিশ প্রশাসনের কাছে রাখতে চাই। পুলিশ প্রশাসনের কাছে আমাদের প্রত্যাশা অনেক সামাজিক নিরাপত্তা প্রশ্নে। একটি রাষ্ট্রের সব জনগণ যখন আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠবে তখন রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। আইনের প্রতি জনগণের শ্রদ্ধাশীল হয়ে ওঠাটা কিন্তু সুষ্ঠু আইন প্রয়োগ ও প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভরশীল। জনগণের নিরাপত্তা মানেই রাষ্ট্রের নিরাপত্তা। রাষ্ট্রে কোনো ব্যক্তি যেন অপরাধপ্রবণ হয়ে না ওঠেন তার জন্য অপরাধ নির্মূলকারীদের আদর্শের জায়গায় অবস্থান নিতে হবে, ভূমিকা রাখতে হবে। রুস্তম আলী আমাকে গন্তব্যে পৌঁছে দিলেন। রাস্তার দুর্বিষহ যানজটে রুস্তম আলীর ভয়ের টুকরো টুকরো কথা শোনা হলো। মনে হলো রুস্তম আলীর সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। জরিপ হলে বড় সংখ্যা নির্ঘাত দৃশ্যমান হবে।

স্বপ্না রেজা : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App