×

জাতীয়

নকল-ভেজাল ওষুধ চক্র সক্রিয়

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৮:৪৬ এএম

কাটতি বেশি এমন ওষুধ নকল হচ্ছে র‌্যাবের অভিযানে আটক ঔষুধ প্রশাসন খবরই রাখে না!

বাজারে নকল ও ভেজাল ওষুধ চক্রের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। এই চক্রকে থামাতে মাঠে নেমেছে প্রশাসনও। গত কদিন ধরে চলছে অভিযান। এর আগেও এমন অভিযান চালানো হয়েছে। নকল-ভেজাল ওষুধ তৈরি ও বিক্রির দায়ে জেল-জরিমানার আওতায় আনা হয়েছে কয়েকজনকে। কিন্তু এসব ঝটিকা উদ্যোগ যে খুব একটা কাজে আসে না তা স্পষ্ট।

রাজধানীর কাজলা, আরামবাগ ও মিটফোর্ড এলাকায় অভিযান চালিয়ে পহেলা সেপ্টেম্বর চক্রটির সাতজনকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়ন্দা শাখার লালবাগ বিভাগ। এর আগে ডিএমপি গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) গুলশান বিভাগ ১২ আগস্ট রাজধানীসহ ঢাকার সাভার ও পিরোজপুরের নেছারাবাদ বিসিকশিল্প এলাকায় ধারাবাহিক অভিযান চালিয়ে মানুষের জীবন রক্ষায় বহুল ব্যবহৃত মন্টিলুকাস্ট, ওমিপ্রাজল ও সেফিক্সিম গ্রুপের নকল ওষুধ তৈরি ও বিক্রয়ের অভিযোগে আটজনকে গ্রেপ্তার করে।

রাজধানীর মিটফোর্ড এলাকার ১৭/১ ডি সি রায় রোডের উদয় মেডিসিন কর্নারে এক বিক্রেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, যারা ওষুধের ব্যবসা করে তারা জানে কে বা কারা এই অফকর্মের সঙ্গে জড়িত। র‌্যাব বা ম্যাজিস্ট্রেট অভিযান চালালে কিছু দিন এসব বন্ধ থাকে। দোকানদারও জানে কোনটা নকল ওষুধ। অভিযান চালালে তারা ওই ওষুধগুলো লুকিয়ে রাখে। কিছু দিন পর অভিযান ঝিমিয়ে পড়লে গুদাম থেকে ওষুধও আসে ফার্মেসির শোকেসে। পরে তা যায় মানুষের হাতে।

মিটফোর্ডের তাসলিমা মেডিকেল হলে ওষুধ কিনতে এসেছিলেন সিরাজউদ্দিন (৬৫)। এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা সিরাজউদ্দিন জানান, প্রতি মাসে তার ও তার স্ত্রীর ওষুধ বাবদ খরচ হয় প্রায় ১২ হাজার টাকা। ডায়াবেটিসের জন্য ইনসুলিন, উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগের জন্য ওষুধ খেতে হয় তাদের। সিরাজউদ্দিন বলেন, ওষুধের নামে কী খাচ্ছি আল্লাহ মালুম। তারপরওতো খেতে হয়। আমার জন্ম এই এলাকায়। আগে এত ভেজাল ছিল না। গত কয়েক বছর ধরে এসব বেশি হচ্ছে।

এম এইচ মেডিকেল হলের বিক্রেতা দেলোয়ার হোসেন বলেন, ওষুধ কোনটা নকল আর কোনটা আসল সেটা বোঝার উপায় নেই। বুঝব কীভাবে? পরিচিত কিংবা আত্মীয়দের মধ্যে কেউ বেকার বসে থাকলে তাকে এনে বসানো হয় ফার্মেসিতে। সাধারণ মানুষের পক্ষে তো আসল নকলের তফাত বোঝা সম্ভব নয়। তাঁতি বাজার এলাকার রংধনু ফার্মেসির বিক্রেতা চন্দ্র পোদ্দার বলেন, কোম্পানির লোকজন এসে ওষুধ দিয়ে যায়। অনেক সময় আমরা নিজেরাও মিটফোর্ড থেকে ওষুধ কিনে আনি। শুধু সাধারণ মানুষ নয়; আমরা বিক্রেতারাও তো ঠকছি।

প্রচলিত-কাটতি বেশি এমন ওষুধগুলোই নকল হচ্ছে বেশি : বাজারে প্রচলিত ও কাটতি বেশি এমন ওষুধগুলোই টার্গেট করে নকল করছিল একটি চক্রটি। আর বাজারজাত করার জন্য দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেকে বেছে নিয়েছিল তারা। চক্রটি স্বনামধন্য বা পরিচিত ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান দ্য একমি ল্যাবরেটরিজ লিমিটেডের ১৬ টাকা দামের মোনাস-১০ ওষুধ ২ টাকা ৫০ পয়সা, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের ৬ টাকা দামের ওষুধ এক টাকা ২৫ পয়সা, জেনিথ ফার্মাসিউটিক্যালসের ১৬ টাকা দামের ন্যাপ্রোকোসন প্লাস ৩ টাকা ও অ্যাম্বি ফার্মাসিউটিক্যালসের ৩০ টাকার এজিথ্রোমাইসিন ৪ টাকা ২৫ পয়সায় বিক্রি করছিল বাজারে।

ফার্মেসির সংখ্যা জানা নেই অধিদপ্তরের : ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তথ্য মতে, বর্তমানে সারাদেশে ১ লাখ ৫১ হাজার নিবন্ধিত ওষুধের দোকান রয়েছে। এর মধ্যে গত দুই বছরে নতুন নিবন্ধন পেয়েছে ৩২ হাজার ৫৩৫টি। এই সময়ে আরো ৪৩৬টি মডেল ফার্মেসির অনুমোদন দিয়েছে অধিদপ্তর। তবে দেশে নিবন্ধন ছাড়া কতগুলো ওষুধের দোকান রয়েছে তার সঠিক হিসাব নেই ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কাছে।

ফার্মেসি খোলারও আছে শর্ত : ফার্মেসি খুলে ব্যবসা করতে হলেও কিছু যোগ্যতা প্রয়োজন। পাইকারি-খুচরা দুই ধরনের লাইসেন্স রয়েছে। যা ড্রাগ লাইসেন্স নামেই বেশি পরিচিত। খুচরা ওষুধ বিক্রির জন্য দুই ক্যাটাগরিতে এ লাইসেন্স দেয় ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। একটি মডেল ফার্মেসির, আরেকটি মেডিসিন শপের। মডেল ফার্মেসির জন্য প্রয়োজন হয় ৩’শ ফুটের একটি দোকান, পৌরসভার ভেতরে ও বাইরে ভ্যাটসহ নির্ধারিত অর্থ দিতে হয়। এর বাইরে আরো কিছু নিয়ম রয়েছে। একটি খুচরা বা পাইকারি দোকানের ড্রাগ লাইসেন্স নেয়ার পর প্রতি দুই বছর পরপর তা নবায়ন বাধ্যতামূলক। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নবায়ন না হলে বিলম্ব ফি দিয়ে নবায়নের সুযোগ আছে। কিন্তু বছরের পর বছর পার হলেও লাইসেন্স নবায়ন করছেন না অনেক ব্যবসায়ী। এতে সমস্যা হচ্ছে না। যেখানে লাইসেন্সই লাগছে না, সেখানে তাদের মধ্যে লাইসেন্স নবায়নের গরজই হারিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া যারা ওষুধ বিক্রি করবেন তাদের ফার্মাসিস্ট প্রশিক্ষণ থাকতে হবে।

নিয়ম মানছে না মডেল ফার্মেসিও : ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ২০১৬ সাল থেকে ‘দ্য বাংলাদেশ ফার্মেসি মডেল ইনিশিয়েটিভ’ দিশারি প্রকল্পের মাধ্যমে দেশে মডেল ফার্মেসি ও মডেল মেডিসিন শপ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এরই মধ্যে সারাদেশে দেয়া হয়েছে প্রায় সাড়ে ৪’শ মডেল ফার্মেসির লাইসেন্স। শর্তগুলোর মধ্যে একটি হলো, মডেল ফার্মেসিগুলোয় একজন ফার্মাসিস্ট রাখা বাধ্যতামূলক। তবে হাতে গোনা কয়েকটি ফার্মেসি ছাড়া অধিকাংশই এ শর্ত মানছে না। জাতীয় ওষুধনীতি অনুযায়ী মডেল ফার্মেসিতে ৩৯টি ওষুধ ছাড়া কোনো ওষুধ প্রেসক্রিপশন ছাড়া বিক্রি করা যাবে না। ওষুধের দোকানে খাদ্যসামগ্রী, নিবন্ধনহীন ওষুধ, সরকারি ওষুধ ও চিকিৎসককে দেয়া কোম্পানির নমুনা ওষুধ বিক্রি করা যাবে না। তবে এসব ফার্মেসিতে আলাদা কর্র্নার করে ওটিসি, প্রেসক্রিপশন আইটেম, মেডিকেল ডিভাইস-নন ফার্মাসিউটিক্যালস পণ্য ও কিছু বেবি ফুড বিক্রির অনুমতি রয়েছে। শাহবাগের মডেল ফার্মেসি সুপর্ণা ড্রাগ হাউজের প্রবেশ পথে মডেল ফার্মেসির ফলক লাগানো থাকলেও দেখা গেছে প্রেসক্রিপশন ছাড়া শুধু মুখের কথাতেই দেয়া হচ্ছে ওষুধ। জানা যায়, ২০১৭ সালে ভেজাল, নিষিদ্ধ ও অনুমোদনহীন ওষুধও বিক্রির দায়ে শাহবাগের অন্য আরো কয়েকটি ফার্মেসির পাশাপাশি এই সুপর্ণা ড্রাগ হাউসকেও জরিমানা করা হয়েছিল।

‘ঠুঁটো’ জগন্নাথের ভূমিকায় ঔষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর : সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ কেমিস্ট এন্ড ড্রাগিস্ট সমিতির দুর্বলতার কারণে লাইসেন্সবিহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে বহু ফার্মেসি। অবৈধভাবে পরিচালিত প্রায় ৫০ হাজার দোকান রয়েছে। যেগুলো একেবারেই মানসম্পন্ন নয়। বিষয়টি তদারকির দায়িত্ব ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের। কিন্তু এক্ষেত্রে জনবল সংকটের দোহাই দিয়েই ক্ষান্ত থাকছে প্রতিষ্ঠানটি। জানা যায়, অধিদপ্তরের জুনিয়র কর্মকর্তাদের প্রতিদিন কমপক্ষে চার ঘণ্টা তাদের মাঠে থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক লে. জেনারেল (অব.) মোস্তাফিজুর রহমান। তাদের প্রতি নির্দেশনা ছিল ওষুধের দোকানগুলোতে ভাউচার দেখার। তাহলে নকল ওষুধ বেরিয়ে আসবে। কিন্তু সেটিও কার্যকরি হয়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিয়মিত অভিযান না থাকার সুযোগে অসাধু ব্যক্তিরা নকল ও ভেজাল ওষুধ উৎপাদন ও বিপণনের কাজটি নির্বিঘেœ করে যাচ্ছে। এছাড়া অভিযান না থাকায় মডেল ফার্মেসিও মুখ থুবড়ে পড়ছে।

বাংলাদেশ কেমিস্টস এন্ড ড্রাগিস্টস সমিতির সাবেক কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভোরের কাগজকে বলেন, দেশে নকল বা ভেজাল ওষুধের বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলার বিধান আছে। আর এই আইনে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু এখনো পর্যন্ত এই আইনে নকল ও ভেজাল ওষুধের ব্যাপারে কেউ শাস্তি পেয়েছে বলে আমার অন্তত জানা নাই। মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে কয়েক হাজার টাকা জরিমানা করে ছেড়ে দেয়া হয়। গ্রেপ্তার হলে কিছু দিন জেলে থাকার পর আসামিরা খালাস পেয়ে যায়। অনেক প্রভাবশালী ব্যবসায়ীও এই নকল ও ভেজাল ওষুধ উৎপাদনের ব্যবসা করছেন।

এই বিষয়ে নজরদারির জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান হলো ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। কিন্তু তারা কোনো দায়িত্ব পালন করছে না। কারা নকল ওষুধ উৎপাদন করছে অধিদপ্তরের এক শ্রেণির কর্মকর্তা বিষয়টি জানেন। তারা নিয়মিত মাসোহারা নেন ওইসব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে।

এ বিষয়ে ঔষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের বক্তব্য জানতে প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান এবং পরিচালক ও মুখপাত্র মো. আইয়ুব হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

যা বলছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী : এ বিষয়ে র‌্যাব লিগ্যাল এন্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন ভোরের কাগজকে বলেন, ভেজালবিরোধী অভিযানে র‌্যাব সবসময় সোচ্চার। যেখানেই খবর পাই সেখানে অভিযানে যাই আমরা। তবে ওষুধের ক্ষেত্রে আমরা সংশ্লিষ্ট ঔষধ প্রসাশন কর্তৃপক্ষকে সঙ্গে নিয়েই অভিযান চালিয়ে থাকি। তবে আমরা সাবধান করতে চাই, যারা এ ধরনের কাজ করছে তাদের নিস্তার নেই। র‌্যাব গোয়েন্দা দল সার্বক্ষণিক ওষুধ বা অন্যান্য ভেজালকারীদের বিরুদ্ধে নজরদারী অব্যাহত রেখেছে।

এ বিষয়ে ডিএমপি মিডিয়া এন্ড পাবলিক রিলেশন্স শাখার মুখপাত্র উপকমিশনার ফারুক হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, ভেজাল বা নকল ওষুধের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক অভিযান চালাচ্ছে আমাদের গোয়েন্দা বিভাগ। ইতোমধ্যে ৩টি অভিযানে আমরা ১১ জনকে গ্রেপ্তার করেছি। নকল ওষুধ সেবন মানে মানুষের জীবন নিয়ে খেলা। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ডিএমপি কমিশনার এ বিষয়ে শুন্য সহিষ্ণু নীতিতে রয়েছেন। আমাদের গোয়েন্দা নজরদারী অব্যাহত রয়েছে। ভেজাল বা নকল ওষুধ চক্রের বিরুদ্ধে আমাদের সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত থাকবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App